পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নাগরিক বিড়ম্বনা নিরসন এবং সিটি কর্পোরেশনের সেবা নাগরিকদের জন্য সহজলভ্য করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অবিভক্ত ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করা হয়েছিল। গত এক দশকে বিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের সেবার মান বাড়েনি এবং নাগরিক বিড়ম্বনাও কমেনি। নির্বাচন যেমনই হোক, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে যারা অধিষ্ঠিত হয়েছেন বরাবরই তারা সরকারি দল এবং প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনপুষ্ট ও আস্থাভাজন লোক। তা ছাড়া রাজধানীকে যানজটমুক্ত, ঝঞ্জাটমুক্ত, পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলা ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে গণ্য। ২০১৬ সালের সিটি নির্বাচনে দক্ষিণের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, উত্তরের সাবেক মেয়র আনিসুল হক নগরবাসীকে প্রতিশ্রুুতির বন্যায় ভাসিয়েছিলেন। সরকারি দলের প্রার্থী হওয়ায় তাদের পক্ষে অনেক সমস্যা উত্তরণ সম্ভব হতে পারে বলে অনেকের ধারণা ছিল। ফুটপাত দখলমুক্ত করা, অবৈধ বাস-ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ, যানজট নিরসন, সামান্য বৃষ্টিতে সৃষ্ট পানিবদ্ধতা নিরসন, দখল হয়ে যাওয়া নদী ও খাল পুনরুদ্ধার এবং দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মতো অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রতিশ্রুতিগুলো কেউই রক্ষা করতে পারেননি। অনেক ব্যর্থতার মধ্যেও ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আনিসুল হক কিছুটা আশার আলো জ্বালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার দেখানো পথে ঢাকা দক্ষিণেও অল্প সময়ের জন্য হলেও কিছুটা পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছিল। আনিসুল হকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের সব প্রত্যাশা আবারো রুদ্ধ হয়ে যায়।
বেশ কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষণ কবলিত ও বসবাসের অযোগ্য নগরীর তালিকায় স্থান পাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়া, ইয়েমেন বা আফগানিস্তানের রাজধানী শহর থেকেও ঢাকার বাসযোগ্যতার অবস্থান নিচে। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জা, হতাশা ও অবমাননাকর। ঢাকায় গণপরিবহনের গতি ঘণ্টায় ৬ কিলোমিটার, যা পায়ে হাঁটার গতির প্রায় সমান। এমন শহরে বিদেশি বিনিয়োগকারী বা পর্যটকদের কোনো আগ্রহ থাকে না। বিশেষ অর্থনৈতিক জোন ও রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর কথা বাদ দিলে এহেন বাস্তবতার চিত্র আমাদের বিনিয়োগ পরিস্থিতিতেও দৃশ্যমান। বৈদেশিক বিনিয়োগ বা বাণিজ্য পরিস্থিতি যাই হোক, আমাদের নাগরিক সমাজের নিরাপত্তা, জীবনমানের উন্নয়ন ও স্বাচ্ছন্দ রক্ষা আমাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমাদের রাজধানী শহরের কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি ব্যর্থ। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে বেশকিছু ফ্লাইওভার নির্মাণ, রাস্তায় পানিবদ্ধতা নিরসন, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, শহরের চারপাশের নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্তকরণ এবং খাল ও জলাভূমি পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও যানজটমুক্ত ঢাকা গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মেয়র-কাউন্সিলরদের প্রতিশ্রæতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি হিসেবেই দেখা যাচ্ছে।
ভোটের মাঠে মেয়র প্রার্থীরা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। ফ্লাইওভার নির্মাণের পরও যেমন যানজট নিরসনে তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি, ঠিক একইভাবে কথিত পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নের পরও যানজটমুক্ত, পরিবেশবান্ধব, বাসযোগ্য, নিরাপদ ও আধুনিক নগরী গড়ে তোলার স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হবে নগরবাসী তা নিয়ে আশ্বস্ত হতে পারছে না। হাই প্রোফাইল মেয়র নির্বাচনের পর গত ৩-৪ দিনে ঢাকার নাগরিক জীবনে তেমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়নি। উপরন্তু সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা আরো তীব্রতর হয়ে দেখা দিচ্ছে। নামবিও নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি বিশ্বের ২২৮ শহরের সড়কচিত্র নিয়ে একটি জরিপ রিপোর্ট ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০২০ প্রকাশ করেছে। সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ ট্রাফিক ব্যবস্থার শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১০ম। একদিকে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ের প্রায় প্রতিটি জরিপে ঢাকার অবনমন ঘটছে, অন্যদিকে প্রতিটি নির্বাচনের আগে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা, বাসযোগ্যতা, আধুনিকতা ও পরিবেশগত উন্নয়নে সব প্রার্থীই প্রতিশ্রæতির তুবড়ি ছোঁটালেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যত একটি মাফিয়া চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এদের হাতে ঢাকার দুই কোটি নগরবাসী এবং সারাদেশের পরিবহন যাত্রীরা জিম্মি। বেপরোয়া গাড়ি চালনা, যথেচ্ছ ভাড়া নির্ধারণ, যথেচ্ছ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের খেসারত দিচ্ছে পুরো দেশ। শুধুমাত্র ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিবছর দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণহানি ও বিকলাঙ্গতার শিকার হচ্ছে। এ কারণে বছরে জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৪ শতাংশ, টাকার অংকে যা লক্ষকোটি টাকা। শুধু কতিপয় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নাগরিক বিড়ম্বনা নিরসন করা সম্ভব নয়। পরিবহন মাফিয়াদের বেপরোয়া কার্যক্রম, অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।