Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও আজকের মুসলমান

প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া

॥ শেষ কিস্তি ॥
এক সময় এমন ছিল (প্রায় হাজার বছর পর্যন্ত) ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতরা জাগতিক শিক্ষায় পারদর্শী হতেন। অথবা এভাবেও বলা যায় যে, জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিতরাও ধর্মীয় শিক্ষা সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান রাখতেন। আল কিন্দী, আল বিরুনী, বু আলী সীনা, ইবনে রুশদ, জাবির ইবনে হাইয়্যান এবং যাকারিয়া প্রমুখের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষায় বুৎপত্তি থাকার কারণে মুসলিম বিশ্ব সে সময় অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির অধিকারী ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর পর আধুনিক তথা জাগতিক জ্ঞান থেকে মুসলমানদের নিরুৎসাহ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এক শ্রেণীর লোকেরা বলতে থাকে কুরআন-হাদীসের বাণী অনুযায়ী যে শিক্ষার কথা বলা হয়েছে, তার সম্পর্ক কেবল দ্বীনের সাথে, জাগতিক শিক্ষার সাথে নয়। জাগতিক শিক্ষার প্রতি তাদের অনীহা এতই বৃদ্ধি পেতে লাগল যে, আধুনিক শিক্ষাকে ফিরিংগীদের শিক্ষা বলতে শুরু করল। জাগতিক শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহের ফলশ্রুতিতে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে মুসলমানদের রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি সম্পূর্ণরূপে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয় সৈন্যরা (অষষপফ ঊড়ৎপবং) বায়তুল মুকাদ্দস দখল করে নেয়। উড়সব ড়ভ জড়পশ এর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাদের সৈনিকদের প্রধান ফিল্ড মার্শাল অষষবহনু ঘোষণা করেন, “এ যুদ্ধ ছিল অষ্টম ক্রসেড। এতে আমরা পূর্ণরূপে বিজয়ী হয়েছি।” এ বছরই স্মিথ (ঝসরঃয) নামক আমেরিকান এক ঐতিহাসিক ইসলামের উপর একটি বই লিখে ঘোষণা করেন যে, “বায়তুল মুকাদ্দাসের বিজয় মূলত শেষ ক্রুসেড ছিল।” মোটকথা মুসলমানদের স্থায়ীভাবে পশ্চাদপদ জাতি হিসেবে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের পর মুসলমানরা পশ্চিমাদের দিকে নযর উঠিয়ে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না। তবে হ্যাঁ মুসলমানরা পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ করে রক্তপাত করে যাচ্ছে অবলীলায়। তাও আবার ইউরোপ-আমেরিকা থেকে অস্ত্র ক্রয় করে। দুটি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশতো প্রায় আট বছর যুদ্ধ করল। এ যুদ্ধে প্রায় দশ লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। মুসলমানদের অবস্থা এমন হয়েছে যা মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের মধ্যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত যেরূপ যুদ্ধ-বিদ্রোহ লেগে থাকত। মোটকথা মুসলমানরা অতীত ইউরোপীয়দের চরিত্রকেই অবলম্বন করে চলছে। এদিকে পশ্চিমা শক্তি মুসলমানদের জঙ্গি, সন্ত্রাসী অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে। তারা স্বৈরাচারী এবং আগ্রাসী মনোভব নিয়ে মুসলিম দেশগুলোতে আক্রমণ করে বর্বর তাতারী হালাকুর লোমহর্ষক ইতিহাসের পুরাবৃত্তি ঘটিয়ে চলছে। এর বিপরীতে উম্মতে মুসলিমা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাইতো বলা হয় “ইসলাম তো অতীত রূপকথার এক কাহিনী” হয়ে রয়েছে।
ক্যাম্বল, ব্রাইফন্ডসহ অন্যান্য ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীরা মধ্যযুগের ইসলামী শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্বের চিত্র কিছুটা এভাবে তুলে ধরেছেন, যা পাঠ করে বর্তমান অবস্থার সাথে তুলনা করে রীতিমত হতবাক হতে হয়। ক্যাম্বল লিখেন, দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এত ব্যাপকভাবে হতো যে, দশলাখ লোকের বাগদাদ এবং কর্ডোভা শহরে শতকরা একশতজন লোকই শিক্ষিত ছিল। ১২ বছরের ঊর্ধ্বে প্রত্যেক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া জানত। এটা ঐ সময়ের কথা যখন ইউরোপের খড়ৎফং ধহফ ইধৎধহং রাণী, রাজকন্যা, রাজপুত্ররা নিজেদের নাম খুব কষ্টে লিখতে সক্ষম হতো। বিংশ শতাব্দীর শুভাগমনের সাথে সাথে মুসলিম জনসাধারণ অশিক্ষার অন্ধকারে যেন ডুব দিয়ে বসল।
বর্তমানে মুসলিমদের ঐ অবস্থা যা পূর্বে ইউরোপীয়দের ছিল। মুসলিম জনসংখ্যার দশ শতাংশ পুরুষ এবং দুই শতাংশ নারী শিক্ষিত বের করা খুবই কষ্টসাধ্য হবে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে এক জরিপে দেখা যায়, ভারতীয় দু’শত মহিলার মধ্যে মাত্র তিনজন লেখাপড়া জানত। মুসলমানরা ইবনে মাজা’র ঐ হাদীসের প্রতি গুরুত্ব দেয়নি, যাতে জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয করে দেয়া হয়েছে। মায়ের কোল থেকে নিয়ে কবরে যাওয়া পর্যন্ত জ্ঞান শিক্ষার গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। তাইতো বলা হয় “ইসলাম অতীত রূপকথার এক মর্মান্তিক কাহিনী।”
এক যুগ এমন ছিল, যখন মুসলিম দেশগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো। মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন ফসলাদির প্রচুর চাষাবাদ হতো। বিভিন্ন প্রকারের ফল-ফুলের সমাহার ছিল মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুরম্য অট্টালিকা, নদ-নদী, রাস্তা-ঘাট, বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্র, হাসপাতাল, ধাতব পদার্থের ফ্যাক্টরি, লৌহ, তামা, পিতল ইত্যাদির কারখানা, নৌকা এবং কাগজ তৈরির কল-কারখানা, প্লেট তৈরির কারখানা মোটকথা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যা একটি উন্নত দেশের জন্য অপরিহার্য হয়ে থাকে, সবকিছুই মুসলিম দেশগুলোতে সহজলভ্য ছিল।
কাগজ তৈরির শিল্প ৭৫২ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম দেশেই সর্বপ্রথম শুরু হয়। দেড়শত বছরের মধ্যেই মুসলিম বিশ্বের সকল দলিল-দস্তাবেজ কাগজের মাধ্যমে সম্পাদন শুরু করে দিয়েছিল। ৯১২ খ্রিস্টাব্দে দামিশকে রঙিন কাগজ তৈরি হতে থাকে। এর বিপরীতে খ্রিস্টান বিশ্ব প্রায় পাঁচশত বছর পর অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের সহায়তায় কাগজ তৈরিতে সক্ষম হয়। সামরিক আসবাবপত্রের বেলায়ও এরূপ অবস্থা ছিল। মুসলিম জাহানেই সর্বোৎকৃষ্ট তরবারী তৈরি হতো। শক্তিশালী কামান তৈরি হতো। আকর্ষণীয় বর্ম তৈরি করা হতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সামরিক অশ্ব এবং তোপখানা এমন ছিল, যে সবের সমক্ষতা করা অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। ইউরোপীয়ান সম্রাটরা এগুলো ক্রয় করার জন্য মুসলিম দেশগুলোতে বিশেষ দূত প্রেরণ করে থাকত। মূলত মুসলিম বিশ্ব অন্য দেশগুলো থেকে অগ্রসর ছিল। বিংশ শতাব্দীর অবস্থা হলোÑ লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়। মুসলিম বিশ্বকে তাদের প্রয়োজনীয় সবধরনের দ্রব্যসামগ্রী ইউরোপ থেকে ক্রয় করে আনতে হয়। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য পশ্চিমাদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। মুসলিম দেশগুলো তাদের জাতীয় আয়ের পঁচিশ শতাংশ অস্ত্রক্রয়ের পেছনে ব্যয় করে থাকে। এ ব্যয়ের পুরাটাই পশ্চিমা বিশ্বে চলে। এর বিপরীতে পশ্চিমা দুনিয়া তাদের জাতীয় আমদানির এগার শতাংশ নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ব্যয় করে থাকে। তাও নিজেদের অঞ্চলেই থেকে যায়। এ চিত্র সম্ভবত এ কারণে হয়েছে যে, মুসলমানরা দীর্ঘ নিদ্রায় বিভোর হয়ে আছে।
বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব অসহায়, অন্যের আশ্রয়ে এবং অমুসলিম শক্তির তোপের মুখে দিন অতিবাহিত করছে। কোনো কোনো মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ দুরাবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ কেবলমাত্র আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। বিশাল বিশাল মাহফিল করা হয়। এসব মাহফিলে কেবল আধ্যাত্মিকতার সবক দেয়া হয়। সাইয়িদ হামিদের মতে শতাব্দী ধরে অনর্থক, বেহুদা বিষয়াবলী নিয়ে মুসলমানরা বাক-বিত-ায় লিপ্ত। যে কারণে মুসলিম দুর্গ ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। কিন্তু দ্বীনদার শ্রেণীর লোক মনে করে থাকে দ্বীনের সেবা একমাত্র তাদের দ্বারাই হচ্ছে। (তাহযিবুল আখলাক-১৯৮৬ইং) এক প্রবন্ধে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (রহ.) লিখেন, শুধু দোয়া আমল-কর্মহীন এবং শিক্ষাহীন মানুষের শক্তি অর্জনের পথ রুদ্ধ এবং কর্মস্পৃহা ত্যাগ করার একটি মাধ্যম হয়ে থাকে। কেবল দোয়ার উপর ভরসা করার ফলে আজ মুসলমানদের এ পরিণতি এবং তার কর্মস্পৃহাকে খুয়ে বসতে চলছে। অথচ আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হলো, কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তন ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ না করে। (সুরা রাদ)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও আজকের মুসলমান
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ