Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও আজকের মুসলমান

প্রকাশের সময় : ২৮ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
॥ দুই ॥
মধ্যযুগে ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞনের উন্নতি সাধনের জন্য মুসলিম বিশ্বের উপর নির্ভর করতে হতো। জড়মবৎ ইধপড়হ কিংবা এবৎধৎফ এর ন্যায় বৈজ্ঞানিক এবং প-িত ব্যক্তি সকলেই স্পেনের ইসলামী ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষা লাভ করেন। অথচ বর্তমানে গোটা মুসলিম বিশ্ব উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। এমন কি ইসলামী ইতিহাসের উপর গবেষণা বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার ইউনিভার্সিটিগুলোতেই হচ্ছে। যেখানে মুসলিম প-িত বুদ্ধিজীবীরা অংশগ্রহণ করাকে গৌরবের বিষয় মনে করে থাকেন। প্রাচীন ইসলামী পঠন সামগ্রীগুলোর সিংহভাগও ঐসকল ইউনিভার্সিটিতে সংরক্ষিত আছে। এক সময় এমন ছিল যে, বাগদাদের রাজপথে দু’শত লাইব্রেরি ছিল। এ লাইব্রেরিগুলোতে পবিত্র কুরআন মজীদ থেকে নিয়ে জ্যোতির্বিদ্যা, ফিজিক্স, কেমিস্ট্র্রি, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ বহু বিষয়ের পুস্তকের ব্যাপক সমাহার ছিল। আজ ইবনে হিশাম এবং জাবির ইবনে হাইয়্যানের রচনাবলী পাওয়া খুবই দুষ্কর। কেননা, জনৈক ইউরোপীয়ান ঐতিহাসিকের অভিমত হলো, অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের পতন এত তীব্র ছিল যে, না সে সময় নতুন নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে তাদের খবর ছিল, না তাদের পুরাতন বৈজ্ঞানিক সফলতা সম্পর্কে জ্ঞান ছিল। মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত মনীষী মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর অভিমত হলো, “ইতিহাসের বিস্ময়কর ঘটনা হলো, বিজ্ঞানের ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দেয়ার পর মুসলমান স্বীয় গবেষণালব্ধ বিষয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যবহারকে বিস্মৃত করে ফেলেছে। কেবল অনুসরণ এবং অতীত বর্ণনানীতিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে তারা বিজ্ঞান এবং এর আবিষ্কারের ময়দানে পশ্চিমাদের থেকে একেবারে পিছিয়ে পড়ে।” ঊফপধৎফ অঃরুধ এবিষয়ের উপর আলোচনায় মুসলমানদের পতনের যুগকে খড়হম ংষববঢ় (দীর্ঘ নিদ্রা) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি আরো বলেন, বর্তমান যুগে মুসলমানরা চিন্তা এবং আবিষ্কারের যোগ্যতাও খুয়ে বসেছে। তারা কেবল পুরাতন পুস্তক থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতি আহরণ করাকেই জ্ঞান-বিজ্ঞনের চর্চা মনে করে থাকে। এখন তারা পুরাতন পুস্তকের ব্যাখ্যা লেখা শুরু করেছে এবং এ ব্যাখ্যা গ্রন্থের আরো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ গ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করছে। তাদের নিকট এরূপ করাই হলো, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উত্তম নমুনা। সৃজনশীল এবং গবেষলামূলক রচনাবলী “অতীত রূপকথার এক কাহিনী” হয়ে আছে মুসলিম সমাজে।
সে যুগে ‘বাইতুল হিকমাহ’র ন্যায় বহু একাডেমি গোটা মুসলিম জাহানের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে ছিল। আজ মুসলিম সমাজে বৈজ্ঞানিকদের বিজ্ঞান একাডেমির গুরুত্ব একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিকদের কোনো মর্যাদা সমাজে নেই বললে চলে। এমন কি বিজ্ঞানকে শিক্ষার তালিকায় রাখাকেও সমীচীন নয় বলে মনে করে থাকে। ১৯৪০ সালে একজন বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা বিজ্ঞানকে বিদ্যা বা জ্ঞান মনে করা ভুল বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এক সময় আধুনিক শিক্ষার কেন্দ্রগুলোকে শিক্ষালয় না বলে জল্লাদখানা বলা হয়েছিল। বর্তমানে মুসলমানদের অবস্থা ঐ রকম হয়ে গিয়েছে, যেমন রোমান সা¤্রাজ্যের পতনের সময় ইউরোপীয়দের হয়েছিল। তারা খ্রিস্টধর্মকে কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য গ্রহণ করেছিল। পার্থিব উন্নতির জন্য নয়। ফলে খ্রিস্টানদের পার্থিব বিষয়ের জ্ঞান সম্পর্কে এমন ঘৃণা জন্মেছিল যে, তারা উকলিদাস, আফলাতুন এবং জালিয়ানুছ প্রমুখের রচনাবলী পশ্চাতে ফেলে দেয়। তাদের এ অযৌক্তিক ভূমিকার কারণে রোমানরা পঞ্চম শতাব্দীতে ইস্কান্দারিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরিতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং পরবর্তীতে যখন তারা তাদের এ কর্মের জন্য লজ্জিত হয়, তখন হযরত আমর ইবনুল আস রাযি. এর সৈন্যদের উপর আগুন লাগানোর অপবাদ দেয়। মুসলমানরা ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে মিসর জয় করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মুসলমানরা পুরাতন রোমান এবং গ্রিক লিটারেচারকে কেবল সংরক্ষণই করেননি; বরং এগুলোকে আরবীতে অনুবাদ করিয়ে গোটা মুসলিম জাহানে জ্ঞানচর্চার জন্য প্রেরণ করেন। ইউরোপের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্রাউন লিখেন, মুসলিম সৈন্যরা যখন নতুন কোনো এলাকা জয় করত তখন সন্ধিনামায় যে সকল শর্ত লেখা হতো, তার মধ্যে একটি শর্ত এও থাকত যে, অত্র এলাকার বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রিক গ্রন্থগুলো মুসলমানদের নিকট হস্তান্তর করতে হবে। পরাজিত খ্রিস্টানরা এ শর্তকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিত। কেননা এ গ্রন্থগুলো তাদের জন্য সম্পূর্ণরূপে বেকার ছিল। এ ছিল মুসলিম জাগরণের স্বরূপ। বিংশ শতাব্দীতে যখন মুসলমানদের পতন শুরু হলো, তখন মুসলমানদের ঐ অসস্থার সম্মুখীন হতে হলো, যা মধ্যযুগে খ্রিস্টানদের হয়েছিল। এ পরিস্থিতির করুণ বিবরণ দিতে যেয়ে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রহ. বিভিন্ন প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন; জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আধ্যাত্মিক এবং দ্বীনি কেন্দ্রসমূহের সাথে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়। যার ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার গতি মন্থর হয়ে যায়। আধুনিক জ্ঞান এবং বিজ্ঞানকে ধর্ম বিরুদ্ধ মনে করা হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি কলেজের লাইব্রেরি লুট করা হয়। ইংরেজি এবং বিজ্ঞানের গ্রন্থগুলোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতিকে শয়তানের যন্ত্র বলে ধ্বংস করে দেয়া হয়। বিদ্রোহীরা আরবী-ফারসী গ্রন্থগুলো সাথে করে নিয়ে পুরাতন সামগ্রী হিসেবে বিক্রী করে দেয়। মুসলমানদের এ কর্ম অনুরূপ সে রকম হয়েছে, যে রূপ খ্রিস্টানরা ইস্কান্দারিয়ার লাইব্রেরি জ্বালানোর সময় করেছিল। “ইসলাম তো অতীত রূপকথার এক কাহিনী” হয়ে রইল।
ইসলামী রেনাসাঁর যুগে যখন ইসলামকে প্রকৃতপক্ষে স্বভাবজাত ধর্ম ভাবা হতো, তখন প্রত্যেকটি কর্ম বিবেক-যুক্তির উপর ভিত্তি করেই করা হতো। বু আলী সীনা মস্তিষ্ক বিকৃতির রোগকে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অন্যান্য রোগের ন্যায় একটি রোগ হিসেবে শনাক্ত করে এবং ঝার-ফুঁকের উপর নির্ভর না করার ঘোষণা দিয়ে ওষুধ এবং উত্তম পরিচর্যার মাধ্যমে রুগীকে চিকিৎসা করার প্রতি গুরুত্ব দেন। কিন্তু ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানরা খ্রিস্টানদের যুগে ফিরে যায়। বিভিন্ন আমল-তদবিরের মাধ্যমে চিকিৎসা করার পিছনে পড়ে যায়। রুগীর রোগ নির্ণয়ের জন্য ‘রুহানী পদ্ধতি’ জানার পেছনে পড়ে যায়। তারা এমন তেল তৈরিতে লেগে যায় যা মাথায় লাগানোর দ্বারা বালা-মসিবত দূর করার দাবি করত। জিন্নাতকে বশে রাখার অথবা বোতলে বন্দি করে ‘আলগা বাতাস’ কিংবা ‘খবিস জিনের আসর’ থেকে মুক্তি পাওয়ার পদ্ধতি নিয়ে সাধনায় মেতে উঠে। চন্দ্রমাসের প্রথম বৃহস্পতিবার চামেলী ফুলকে কবরে পুঁতে মনে করা হতো এর দ্বারা তার দিলের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে। সত্যিই “ইসলাম অতীত রূপকথার এক কাহিনী” বনে যায়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষার আলোকে এক সময় মুসলিম সমাজে এতো জোর দেয়া হতো যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মুসলমানদের ইউনিফর্ম বনে গিয়েছিল। বলা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে খ্রিস্টানরা স্পেন দখল করার পর যখন কোনো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ দেখতে পেত, তখন তারা তাকে মুসলমান বলে ধারণা করত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এ চিত্রের রূপ সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন হয়ে যায়। এখন বলা হয়, মুসলমানরা নোংরা পোশাককে পরহেযগারীর পোশাক বলে গ্রহণ করে নিয়েছে। “ইসলাম তো অতীত রূপকথার এক কাহিনী” হয়ে গেল।
ইমাম গাজালী এবং অল ফারাবীর ন্যায় মনীষীগণ দর্শন-যুক্তিবিদ্যাকে ইসলামীকরণ করেছিলেন। কিন্তু ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে যখন আল্লামা ইকবালের ন্যায় দার্শনিকগণ বিবেক-বুদ্ধি এবং যুক্তি নির্ভরতার প্রতি জোর দিলেন, তখন স্বজাতীয়দের নিকট থেকে ভর্ৎসনা পেতে হয়েছে তাদের। কেননা “ইসলাম অতীত রূপকথার এক কাহিনী” হয়ে গেল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ও আজকের মুসলমান
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ