বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
খুব ভোরে নাশতা সেরে বাইরে বেরুবার তাড়া থাকত। আমাদের গাড়ি, পথচারী, দু’পাশের বিল্ডিং মার্কেট এবং প্রতিষ্ঠানের লোকজন কৌত‚হল নিয়ে দেখত, ভাবত পাগড়ি টুপি আবা জুব্বা শেরওয়ানি ওভারকোট গায়ে শশ্রুধারী বর্ণাঢ্য চেহারা রং ও রূপধারী এরা কারা যাচ্ছেন।
পর পর ১০/১২টি গাড়ি, সামনে পেছনে পুলিশ এসকট, সবার আগে হাইওয়ে পুলিশের পেট্রোল কার, এরপর অ্যাম্বুলেন্স, তারপর আমাদের সব গাড়ি। ওয়াকিটকি হাতে প্রতি গাড়ির গাইড গোটা কনভয়টির সমন্বয় করছে। রোড ক্রস ও বড় মোড়গুলোয় ট্রাফিক আটকে রাখা হয়েছে। আমাদের বহর যাওয়া পর্যন্ত ১০/১৫ মিনিট অন্যরা থমকে দাঁড়িয়ে।
কোনো ব্যানার ফেস্টুন বা গাড়ির গায়ে কোনো ডিজিটাল প্রিন্ট না থাকায় কেউ বুঝত না আমরা কারা, কোথায় যাচ্ছি। এটি অবশ্য নিরাপত্তার জন্যই করা হয়েছিল। শুধু সরকার ও পুলিশ প্রশাসন জানত। বোখারা সমরকন্দের বাইরে দূরবর্তী প্রদেশ, জেলা বা গ্রামাঞ্চলে গেলে সাথে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সশস্র সৈন্যরাও কনভয়ে থাকত। যেমন, তিরমিয, কাশকেদরিয়া, সুরখনদরিয়া, কারশ, শহরে সবজ, দেনোভা ইত্যাদিতে এলিট ফোর্সের গাড়িও কনভয়ে দেখেছি।
বিশেষ করে ইমাম আবু ঈসা তিরমিজি রহ. এর কমপ্লেক্সে আমরা রাতে যাই। ওজুর জায়গা থেকে বিদায় পর্যন্ত উজবেক এলিট ফোর্স সদস্যরা নীরবে পাহারায় ছিল। গোটা কমপ্লেক্সের প্রতিটি কোণায় তাদের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।
যেমন কারশ শহরে পাঁচ সাত গাড়ি পুলিশ আমাদের চারপাশে সবসময় থেকেছে। নকশবন্দী ট্যুরিজম ফেস্টিভালের বিদেশি মেহমানদের নিরাপত্তা বিধানকে উজবেক সরকার খুব সিরিয়াসভাবে নিয়েছিল। হালাল ট্যুরিজম প্রমোশনের বিষয়টি এখন তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যে রূপ দিতে চাচ্ছে উজবেকরা।
নাসাফ বা কারশ শহরে আমরা আধ্যাত্মিক মনীষী আবু মুঈন নাসাফী রহ. এর কমপ্লেক্সে যাই বেলা ১১টার দিকে। সুন্দর রোদ ছিল সেদিন কিন্তু ঠান্ডা হাওয়া এতই হিম বয়ে আনত যে আমরা মোটা ও ভারি জামা-কাপড় গায়ে দিয়েও রীতিমত কাঁপছিলাম।
চেহারা, ঠোঁট, মুখ, হাতে যেন থেকে থেকে বরফের স্পর্শ লাগাচ্ছে কেউ। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কমপ্লেক্স। বিশাল এলাকাজুড়ে সুসজ্জিত বাগান। ফুলে ফুলে ভরা। মহিলাদের জন্য ওজুখানা। এরপর পুরুষদের। ভেতরে বাইরে তারকা হোটেলের পরিবেশ।
মূল ফটকে অভ্যর্থনা জানান মহিলা একজন পুলিশ অফিসার। তিনিই তখন এ শহরে মেহমানদের নিরাপত্তা ডিউটিতে ছিলেন। কী বিনয় নম্র আদব তার। তরুণী অফিসার যদিও ইউনিফর্মে ছিলেন কিন্তু তার পর্দা সচেতনতা, সম্ভ্রমবোধ ও উন্নত শালীন অভিব্যক্তি সব দেশের মাশায়েখগণকে সাবলীলভাবে জিয়ারত ও নামাজ বন্দেগী করতে সাহায্য করে।
প্রথমে রিসিভ করেই পর্দা সচেতন অফিসারটি মাশায়েখদের জন্য গাইড নির্ধারণ করে নিজে দূরে অবস্থান নেন। কমপ্লেক্স অফিসের একটি কক্ষে দেখলাম সব নারী শ্রমিক, মালি ও কর্মীরা ভিড় করে রয়েছে। কেউ কেউ দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুকি মেরে মাশায়েখ কাফেলাকে দেখার চেষ্টা করছিল।
আমাদের ভ্রমণ উপলক্ষে কিছু সময় বাগান, কমপ্লেক্স ও মসজিদে কাজ বন্ধ রেখে কর্তৃপক্ষ একটি নীরব শান্তিময় আবহ তৈরি করে রেখেছিলেন। তত্ত¡াবধায়ক পর্যায়ের একজন নারী কর্মকর্তা, সম্ভবত তিনি আর্কিওলোজি বিভাগের হবেন, আমাদের কাফেলার তুর্কী ও আরব নারীদের সাথে কথা বার্তা বলছিলেন।
আমরা আবু মুঈন নাসাফীর কবরগাহে গেলাম। পশ্চিমের সীমানায় অসাধারণ সুন্দর মসজিদটি সত্যিই নয়নাভিরাম। বাইরের চত্বরের কারুকাজে প্রচুর কাঠের ব্যবহার হয়েছে। মসজিদ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। চোখ আর হৃদয় শীতল হল গোটা কমপ্লেক্সের স্থাপত্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে।
অভিভূত হলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়। অকল্পনীয় প্রশান্তি ও নীরবতা সমস্ত অনুভ‚তিকে স্পর্শ করল। আমরা গাড়িতে ওঠে ৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে জাতীয় মহাসড়কে পৌঁছে রওনা হলাম নতুন গন্তব্যের পানে। বিদায়ের সময় তরুণী পুলিশ অফিসার দৃশ্যমান হয়ে তার গাড়ি নিয়ে আমাদের কনভয়ে শামিল হন।
আমাদের নতুন এক শহরের সীমানা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তিনি তার স্টেশনে ফিরে যান। তার ধর্মীয় আত্মমর্যাদাবোধ এবং উলামা পীর মাশায়েখদের সাথে এতটা মানানসই আচরণ ছিল সত্যিই লক্ষ্য করার মতো। ওলী আউলিয়া ও আইম্মাদের দেশের মানুষের মন-মনন এবং আচরণও হয়ে তাকে পরম স্বস্তিময় দ্বীনি ভাবধারার। এমন ভদ্রতা অনুসরণীয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।