চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
শেষ
ইংরেজদের আগমনের পর খৃস্টান মিশনারী স্কুলসমূহে ইংরেজী শিক্ষা দেয়া হতো। সেখানে কেউ বিনা বেতনে পড়াশুনা করতে পরতো না। কেউ খৃস্টধর্ম গ্রহণ করলে তার সন্তানাদীর বিনা বেতনে পড়াশুনার সুযোগ দেয়া হতো। মুসলমানদের এই যে বিনে পয়সার অথবা অতি অল্প খরচে বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ ছিলো তার একমাত্র কারণ হলো মুসলিম শাসকগণ এবং বিত্তশালী মুসলমানগণ বিদ্যাশিক্ষার উদ্দেশ্যে অকাতরে ধনসম্পদ, জমিজমা প্রভৃতি দান করতেন।’ আমাদের অতীতের ওয়াকফের ইতিহাসের উপর আরো গবেষণা হওয়া অতি জরুরী। আজকে যারা শিক্ষার নামে অসম ব্যবঁসাক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করছেন কিংবা কর্মক্ষেত্র সৃষ্টির নামে পকেট ভারী করার মেকানিজম পরিচালনা করছেন তাঁদের একটু গভীরভাবে আত্মপর্যালোচনা করা উচিত। তাঁরা কি জাতির উপকার করছেন? অথচ তাঁদের উপকার কি খারাপ ফলাফল (ৎবধপঃরড়হ) মুক্ত? তাঁদের কি আরো উদারতার পরিচয় দেয়া উচিত নয়?
প্রবন্ধের বিষয়ের সাথে জড়িত না হলেও কয়েকটি কথা বলা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। একটি অপপ্রচার মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত যে, বাংলার মুসলমানরা শিক্ষাবিমুখ ছিলো। প্রমাণ স্বরূপ বৃটিশ শাসনামলের মুসলমানদের শিক্ষাচিত্র তুলে ধরা হয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো ঘরের শত্রæ বিভীষণদের ঘৃণ্য অন্তর্ঘাতী তৎপরতা ও পলাশীর প্রান্তরে বাংলার মুসলিম শাসনের পতনের পর মুসলমানদের আর্থ সামাজিক ও শিক্ষা ব্যবস্থা সবই তছনছ করে দেয়া হয়। অতঃপর বেঁচে থাকাই যেখানে ছিলো দূরূহ সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন সম্ভব ছিলো না। ড. ড, ঐঁহঃবৎ তাঁর গন্থে বলেন, ‘(ইংরেজদের বিজয়ের পর) শত শত প্রাচীন মুসলিম পরিবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। ফলে লাখেরাজ ভূসম্পত্তির দ্বারা মুসলমানদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছিল তাও চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।’ আরেকটি অপপ্রচারও বেশ জোরালো, তা হলো; মুসলমানরা নাকি ইংরেজী শেখাকে হারাম মনে করতেন। আলেমদের একটি অংশ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এরূপ ফতোয়া দ্বারা দিয়েছিলেন বটে কিন্তু এটা মূল চিত্র নয়। মূল চিত্র হলো পলিসির মাধ্যমে শুধু ইংরেজী নয় সার্বিক শিক্ষা ক্ষেত্রেই মুসলমানদের অগ্রগতি এমনকি প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করা হয়েছিলো। বিশেষত ইংরেজী স্কুল কলেজে অধ্যয়ন করা ছিলো অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ এবং মুসলমানরা ছিলো দারিদ্র্য জর্জরিত।
১৯৩৪ সালে ‘বেঙ্গল ওয়াকফ ত্র্যাক্ট’ নামক আইনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান তৎকালীন বাংলার নিবন্ধিত ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশুনা করতো। এর পূর্বে ১৯২৩ সালেও একটি ওয়াকফ আইন ছিলো। পাকিস্তান আমলে আইনগুলো আরো সংস্কার করে ১৯৬২ সালে ‘পূর্ব পাকিস্থান ওয়াকফ অধ্যাদেশ’ নামে ঘোষণা করা হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দদ্বয় বাদ দিলেও ওই অধ্যাদেশ দ্বারাই এখনও দেশের সকল তালিকাভুক্ত (নিবন্ধিত) ওয়াকফ সম্পদগুলো দেখাশোনা করা হয়। বাংলাদেশের ওয়াকফ প্রশাসন ‘ধর্ম মন্ত্রণালয়ের’ অধীন একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এর সর্বোচ্চ পদের নাম ‘ওয়াকফ প্রশাসক’। তিনি সরকারের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকতা। বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত ওয়াকফ এস্টেটের সংখ্যা ১৯, ৭৩৮ টি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী অনিবন্ধিত ওয়াকফ এস্টেটের সংখ্যা ১, ৫০, ৫৫৩টি। দেশের ওয়াকফ প্রশাসনের অফিস সংখ্যা প্রধান কার্যালয়Ñ১, বিভাগীয় কার্যালয়Ñ৪, জেলা কার্যালয়Ñ২৪। সাংগঠনিক কাঠামো ঃ ওয়াকফ প্রশাসকÑ১, উপÑপ্রশাসকÑ২, সহকারী প্রশাসকÑ৬, ওয়াকফ পরিদর্শকÑ১৮, হিসাব পরীক্ষকÑ১৮, অন্যান্যÑ৫৪। মোট বিচারাধীন মামলাÑ৬০১টি, ওয়াকফ অফিসেÑ২০১টি, জেলা জজ আদালতেÑ২৫০টি, সুপ্রীম কোর্ট/হাইকোর্ট ডিভিশনেÑ১৫০টি, দেশের বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ এস্টেটের তুলনায় প্রশাসনের অফিস সংখ্যা ও জনশক্তি অতি অল্প। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কোন প্রকার ওয়াকফ সম্পদের মোট পরিমাণও হিসাব ওয়াকফ দফতরে নেই। অথচ এটা মৌলিক একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। দেশের বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পদের চিত্র উপস্থাপন ও ব্যবহারের কার্যকর উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের থাকা উচিত।
আল্লাহর সন্তুটির জন্য ওয়াকফ প্রদান ও সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচনের যে অভূতপূর্ব নজির আমাদের ইতিহাসে রয়েছে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। ওয়াকফ সম্পদের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন ও শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি সাধনের উদ্দেশ্যে সুপুরিকল্পিত জরিপ কার্যক্রম, গবেষণা ও কার্যকর পদক্ষেপ পরিচালনা করতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, শিক্ষা বলতে দীনি ও দুনিয়াবী শিক্ষা এরূপ আলাদা কোন ধারণা ইসলামে নেই। কিতাব ও সুন্নাতের ভিত্তিতে দুনিয়ার কার্যাবলী পরিচালনা করাই দীন। আরএ উদ্দেশ্যে যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচলনা করা হয় এর সবই দীনি শিক্ষা। নিবন্ধিত ও অবিন্ধিত উভয় প্রকার ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ রেকর্ডের জন্য সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারী ওয়াকফ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের সার্বিক কার্যক্রমের রিপোর্ট এবং বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর হতে ওয়াকফ সম্পদ ব্যবস্থাপনার অগ্রগতির সারাংশ জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রকাশ করা প্রয়োজন। সরকারী ওয়াকফ প্রশাসনের অফিসের সংখ্যা ও জনশক্তি আরো বাড়ানো প্রয়োজন। ওয়াকফ আইন ও বিধিমালাকে আরো সুন্দর ও কার্যকর করার উদ্দেশ্যে গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৬২-র পর ওয়াকফ আইনের আর কোন সংস্কার সম্পন্ন হয়নি। ওয়াকাফ কার্যক্রমের সাথে সুদের সম্পর্ক বন্ধ করতে হবে। কারণ ওয়াকিফ নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করেন। এই সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সুদকে এড়িয়ে চলাটা তাই আরো অধিক গুরুত্বের দাবীদার। ওয়াকফ আইন, ১৯৬২-র কোন কোন ধারা ও বিধিমালার সুদের উপস্থিতিকে মেনে নেয়া হয়েছে। যেমনঃ ‘ধারা-৭২’ বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসন বিধি, ১৯৭৫-এর ‘বিধি-৮’ এর ৯-ক, ১১-ক ও খ, ১২-ক, ১৩, ১৮-গ, ১৯-গ ও ঘ ইত্যাদি। ৮. বস্তুবাদ ও বস্তুবাদ প্রভাবিত আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে উপকার গ্রহণকারীদের মনে সাধারণত দীনতাবোধ সৃষ্টি হয়। তাই এরূপ যৌক্তিক উপস্থাপনা থাকা জরুরী যাতে করে ওয়াকফ হতে উপকৃত ব্যক্তিদের মনে হীনমান্যতা সৃষ্টি না হয়। যেমন- রসূলুল্লাহ স. বলেছেন যে, দুর্বল ও নিঃস্বদের উছিলাতেই স্বচ্ছল ব্যক্তিরা রিয়ক ও সাহায্যপ্রাপ্ত হয়। এছাড়াও ওয়াকফ সম্পদ দ্বারা মানুষের শুধু তাৎক্ষণিক উপকার সাধন করাই হবে না বরং এই সম্পদকে সুদক্ষ মানবসম্পদ তৈরীর হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করা হবে। এতে করে উপকৃত ব্যক্তিরা নিজেদেরকে নিছক দানপ্রাপ্ত অসহায় আদম সন্তান মনে না করে মানব সভ্যতার উন্নয়ন কর্মী বলে ভাবতে পারবেন। আর আমাদের অতীতে এর যথেষ্ট নজির আছে।
ওয়াকফ ক্ষেত্রে আমাদের জাতির রয়েছে স্বর্ণালী ইতিহাস। বর্তমান পৃথিবীতেও ওয়াকফ খাতে প্রদত্ত দান দ্বারা বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠছে। আরব মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশসহ দরিদ্র মুসলিম দেশসমূহে মানব সম্পদ উন্নয়নে বিষেশ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশও রয়েছে যথেষ্ট ওয়াকফ সম্পদ। এই সম্পদের পরিমাণ রেকর্ড ও ব্যবহার মাধ্যমে আমাদের জাতির অগ্রগতিতে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে সবাই সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা পালন করবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমীন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।