Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কার্গো নিষেধাজ্ঞা : রফতানিখাত ও ভাব-মর্যাদার সংকট

প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের পর এবার জার্মানীও বাংলাদেশে তার কার্গো বিমান ওঠানামায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এতদিন বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দুর্বলতার কথা বলা হলেও এখন পুরো বাংলাদেশকেই একটি নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করছে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক অংশীদার জার্মানী। গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, জার্মানীর সরকারী বিমান সংস্থা লুফথানসা বাংলাদেশে তাদের কার্গো পরিবহন বন্ধ রাখার যে ঘোষণা দিয়েছে সেখানে শুধু বিমানবন্দর নয় পুরো বাংলাদেশকেই একটি রিস্কি কান্ট্রি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের বরাত দিয়ে এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রফতানীমুখী গার্মেন্ট পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই নিষেধাজ্ঞা দেশের কর্মসংস্থান ও রফতানীমুখী শিল্পখাতে জন্য খুবই এলার্মিং। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ইতিমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পরও দীর্ঘ হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশের তালিকা। ফ্রান্স, কানাডা ইতালিও বাংলাদেশ থেকে কার্গো পরিবহন নিষিদ্ধ করতে পারে বলে গতকাল প্রকাশিত রিপোর্টে আশঙ্কা করা হয়েছে। এমনকি কার্গো পরিবহনের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে যাত্রী পরিবহন বন্ধের কথাও ভাবছে বলে জানা যায়। বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়নের পরও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বদলে পশ্চিমাদেশগুলোর নতুনভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের এই ধারাবাহিক ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাব-মর্যাদা বড় ধরনের সংকটে পড়তে শুরু করেছে। সেই সাথে  বিনিয়োগ, রফতানী বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবণতার আশঙ্কা রয়েছে।
দেশে কোন শ্রেণী পেশার মানুষই নিরাপদ নয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় সকল স্তরে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতাবোধ বিস্তার লাভ করছে, যা’ দেশের সীমা ছাড়িয়ে এখন আন্তর্জাতিক মহলেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে কথিত জঙ্গিবাদ ও গুপ্তহত্যাকারী দমনের নামে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সাঁড়াশি অভিযানের নামে প্রকারান্তরে গণগ্রেফতার ও গ্রেফতার বাণিজ্যের সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। জঙ্গিবাদ দমনের নামে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতারের ফলে দেশে যেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে প্যানিক সৃষ্টি হয়েছে, একইভাবে বিদেশিরাও বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করছে। বিভিন্ন দেশের কার্গো নিষেধাজ্ঞার ঘটনার নেপথ্যে রাজনীতি রয়েছে বলে মনে করছেন সরকারের নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা বন্ধ রাখার পেছনেও রাজনীতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, চলমান বিশ্বব্যবস্থায় রাজনীতি ও অর্থনীতি পারস্পরিক নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা জিইয়ে রেখে দেশের সামাজিক নিরাপত্তা, কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া অসম্ভব। একটি একতরফা ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের বদলে পুলিশি ব্যবস্থায় বিরোধীদল দমন ও নিপীড়নের পথ বেছে নেয়ায় দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে টার্গেট কিলার ও গুপ্তঘাতকদের ধরার বদলে প্রায় প্রতিটি হত্যাকা-কে রাজনৈতিক ব্লেইম গেমে পরিণত করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকেই উস্কে দেয়া হয়েছে। এহেন পরিস্থিতি দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির গ-ি পেরিয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ, রফতানী বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। জার্মানীর কার্গো নিষেধাজ্ঞা সেই নেতিবাচক ধারারই অংশ।
এমনিতেই দেশের রফতানীমুখী তৈরী পোশাক শিল্পখাত নানাভাবে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্রেক্সিটের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশের রফতানীকারকরা যখন অজানা আশঙ্কায় রয়েছেন তখন বাংলাদেশের উপর ইউরোপীয় দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান কার্গো নিষেধাজ্ঞার ঘটনা সে আশঙ্কা আরো বহুগুণ বাড়িয়ে তুলছে। সরকার দেশকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে বলে দাবী করছে। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে ইতিবাচকভাবে ব্রান্ডিং করতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা কিংবা সদিচ্ছার অভাব দেশের সামগ্রিক সম্ভাবনাকেই বাধাগ্রস্ত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা রহিতকরণ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের নানা শর্ত এবং নিরাপত্তার নামে রেড এলার্ট ও কার্গো নিষেধাজ্ঞার পেছনে রাজনীতি থাকতেই পারে। কিন্তু সেই রাজনীতিকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে কার্যকর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি দেশের তৈরী পোশাক রফতানীকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতারাও নিজেদের শিল্পরক্ষায় নিজস্ব উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করার পাশাপাশি তৈরী পোশাকশিল্পের বাজার ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিজিএমইএ তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে দেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে তার দৃষ্টান্ত রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে দেশের ভাব-মর্যাদা, রফতানী বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যখন মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম, তখন আমাদের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের দল নিরপেক্ষ সাহসী উদ্যোগ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি ইতিবাচক সমাধানের পথে নিয়ে যেতে পারে। নানাবিধ সংকটে ইতিমধ্যে হাজার হাজার গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। ভারতসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো বাংলাদেশের বাজার দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ব্রেক্সিটের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা এবং বিভিন্ন দেশের কার্গো নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের তৈরী পোশাক রফতানীখাতসহ বৈদেশিক বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। বিশেষত: জননিরাপত্তা ও সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার দৃশ্যমান প্রতিফলন থাকতে হবে। দেশের স্বার্থে একগুঁয়েমী পরিহার করে সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক সমঝোতার পথে আসতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কার্গো নিষেধাজ্ঞা : রফতানিখাত ও ভাব-মর্যাদার সংকট
আরও পড়ুন