Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রাম নগরের আবাসন উন্নয়ন ও লোকাল রেল ব্যবস্থা প্রসঙ্গে

কানু কুমার দাশ | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল জনবহুল দেশে আবাসন সংকট তীব্রতর হওয়া থেকে পরিত্রাণ হিসাবে যে রেল ব্যবস্থা কাজ করতে পারে তার উদাহরণ হতে পারে বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রাম ও তার আশেপাশের উপশহর। নগর পরিকল্পনায় একটা শহরের উন্নয়নে উপশহরের সাথে টেকসই যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্রিটিশ আমল থেকে রেল ছিল বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের অন্যতম প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু ভারত বিভাগের পর বিশেষত বাংলাদেশ অংশে অবিভক্ত বাংলায় রেলপথসমূহ বাধার সম্মুখীন হয় মানচিত্রের দাগের জন্য, বন্ধ হয়ে যায় অনেক রেলপথ। সংকুচিত হতে থাকে এর উন্নয়ন ও রেলপথের দৈর্ঘ্যসহ অবকাঠামো। পরিবর্তিত হয় মানুষের গন্তব্যস্থল, আর দেশের স্বাধীনতার পর রাজধানী ঢাকামুখী যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলের থেকে বেশি গুরুত্ব পায় সড়ক পথ। দিন দিন কমতে থাকে রেলের উন্নতি, পরে অবশ্য লোকসানেই চলে রেল। সময়ের তাগিদে নির্মিত রেল লাইন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি না পেয়ে বিভিন্ন সময় তা আরো সংকুচিত হয়েছে দিনের পর দিন, কী তার কারণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও নদীমাতৃক দেশে প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা হওয়ার কথা প্রধানত নৌ ও রেল কেন্দ্রিক, আর সড়ক যোগাযোগ হবে সহায়ক। কিন্তু জনবহুল এই দেশে সিংহভাগ যোগাযোগ সড়কের উপর হওয়াতে সড়ক এই বিশাল জনসংখ্যার প্রতিদিনকার চাপ নিতে হিমশিম খাচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত জনগণ সম্মুখীন হচ্ছে অসহনীয় যানজটের। যেখানে উন্নয়নের ধারায় এই রেল পরিষেবা আরও উন্নত হওয়ার দরকার ছিল সেখানে উল্টো আরও ট্রেনের সংখ্যা কমিয়ে ফেলা হয়, যার প্রভাব পড়ে সড়ক যোগাযোগের উপর। ফলে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়।

আশার কথা হলো গত দশ বছর আগে বর্তমান সরকার তৈরি করে নতুন রেলপথ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে রেলে নতুন রেলপথ নির্মাণ, অবকাঠামো নির্মাণ (স্টেশন, প্লাটফর্ম, সেতু ইত্যাদি)সহ রেলের নতুন বগি ও ইঞ্জিন ক্রয় করাসহ অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়। কিন্তু তারপরও বৃহৎ জনগোষ্ঠির এই দেশে তা খুবই অপ্রতুল। তাই প্রতিনিয়ত রেলের টিকিটের ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে। কিছু নতুন ট্রেন চালু ও পুরনো ট্রেনে নতুন বগি সংযোগ করার পরেও কোনো ট্রেনেই টিকিট খালি থাকে না। ট্রেন এখন অনেক সময়ানুবর্তিতা মেনে চলে এবং নিরাপদ হিসাবে মানুষের প্রথম পছন্দ এই রেল যোগাযোগ। তবে এখনও লোকাল ট্রেনের অবস্থা তথৈবচ। লোকাল ট্রেনের সংখ্যা অত্যন্ত কম আবার যাও আছে তাতে বগির সংখ্যাও যাত্রীর তুলনায় অনেক কম। অনেক লোকাল রেল লাইন বন্ধ না হয়ে কোনো মতে একখানা ট্রেন চালিয়ে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। শুধুমাত্র আন্তঃনগর বা বড় বড় শহরগুলোর সাথে যোগাযোগকে গুরুত্ব দিয়েছে। সেটা অবশ্যই প্রয়োজনীয় ও প্রথম চাহিদা কিন্তু নগরীর জনগণকে নগর থেকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে তার কর্মস্থল ও আবাসস্থলের নিবিড় যোগাযোগ দরকার। আর সে জন্য মানুষকে নগর থেকে দূরে উপশহর বা গ্রামের আবাসনে ফেরত পাঠাতে হলে উপশহর বা গ্রামের সাথে শহরে/নগরে যাতায়াতের গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। যাতে করে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠি একইভাবে কম সময়ে ও অল্প খরচে প্রতিদিন কর্মস্থলে ও আবাসস্থলে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। আর তখন মানুষ একটু দূরের উপশহরে থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে। তবে সব জায়গায় যে রেল নিয়ে যেতে হবে তা নয়। যেখানে রেলপথ বর্তমান আছে সেখানে ভালো লোকাল বা কমিউনিটি রেলের ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে সড়কের উপর চাপ কমবে এবং যেখানে রেলপথ নেই সেখানে নৌ কিংবা সড়কও যানজটবিহীনভাবে যোগাযোগ করতে পারবে। এমন একটা উদাহরণ হতে পারত চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের আশেপাশের উপশহরের রেল ব্যবস্থাপনা। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে উপশহর হল-সীতাকুন্ড, মীরসরাই, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া ইত্যাদি আর দক্ষিণে পটিয়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ইত্যাদি। বৃটিশ আমলে রেলপথ নির্মাণ করে অত্যন্ত চমৎকারভাবে উত্তর ও দক্ষিণের প্রধান প্রধান বেশিরভাগ উপশহরগুলোর সাথে সংযুক্ত এবং তখন ৬-৮ জোড়া লোকাল ট্রেন নগরের সাথে ঐ উপশহরগুরোর মধ্যে চলমান ছিল। ফলে মানুষ দৈনিক যাতায়াত করে শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে শহরে চাকরি করত। কিন্তু দিন দিন এই রেল সেবা বৃদ্ধি না পেয়ে কমতে কমতে এক জোড়া লোকাল ট্রেনে নেমে আসে এবং মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয় সড়ক। ফলে সড়কের যানজটে অতিষ্ট হয়ে মানুষ বাধ্য হয়ে শহরে আবাসন খোঁজে। অপ্রতুল আবাসন কারণে মানুষের চাহিদার তুলনায় ঘরবাড়ির সংখ্যা অনেক কম। যে সমস্যা সমাধান করা খুবই কঠিন। এখানে প্রভাবক হিসাবে কাজ করতে পারে সমন্বিত কমিউনিটি রেল ব্যবস্থা।

তারই একটা উদাহরণ প্রকল্প প্রস্তাবনা হতে পারে দোহাজারী রেল লাইন। এই রেল লাইনে বর্তমানে একখানা ট্রেন দুই বার করে আসা যাওয়া করে। পূর্বে এ পথে একখানা ট্রেন ৩-৪ বগি একবার যাতায়াত করত। যার শিডিউল ঠিক থাকত না এবং বেশিরভাগ মানুষ টিকিট ছাড়া যাতায়াত করত। কিন্তু ২০০৮ সালের দিকে দোহাজারী রেল যাত্রী পরিষদ নামে সাধারণ যাত্রীরাই স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে টিকেট চেকের ব্যবস্থা করে। ফলে রেলের এ রুটে মাসিক আয় ২ লক্ষ থেকে বেড়ে ৬-৭ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়। পরবর্তীতে ঐ ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা বাড়ায় ২ বার আসা যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, ফলে রেলের আয় আরও বেড়ে ১০ লক্ষ অতিক্রম করে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার এবং এখন রেল যাত্রী পরিষদের যাত্রীরা যেখানে ভিড়ের মধ্যে বিনা বেতনে টিকিট চেক করে যাচ্ছে, সত্যিই তাদের কাজ রেলের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তারা এই কাজ করছে শুধু নিজেদের একটু কম খরচে, নিরাপদে যাতায়াতের জন্য। চট্টগ্রাম-দোহাজারী এই রুট শহরের সাথে প্রধানত কালুরঘাট, মোহরা, বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, দোহাজারী এলাকাকে সংযুক্ত করছে তারও পাশাপাশি সুদূর সাতকানিয়া থেকেও লোক দোহাজারী হয়ে শহরে যেতে এই ট্রেন ব্যবহার করে। কিন্তু দিনে মাত্র দুই বার আসা যাওয়া করে বিপুল জনগণকে যাতায়াত সেবা পরোপুরি দেওয়া সম্ভব নয়।

বর্তমানে ট্রেনটি দোহাজারী হতে সকাল ৬টায় ছেড়ে ৭টায় পটিয়া অতিক্রম করে ৯টায় চট্টগ্রাম পৌঁছে। আবার ১০টায় (বেশির ভাগ সময় ১১ টায়) চট্টগ্রাম ছেড়ে দুপুর ১২টায় পটিয়া অতিক্রম করে দুপুর ১টায় দোহাজারী পৌঁছে আর ২টার দিকে আবার দোহাজারী ছেড়ে বিকাল ৩টার দিকে পটিয়া অতিক্রম করে ৫টার দিকে চট্টগ্রাম পৌঁছে। আবার চট্টগ্রাম থেকে ৬টায় ছেড়ে রাত ৮টার দিকে পটিয়া অতিক্রম করে রাত ৯টায় দোহাজারী পৌঁছে। যদি পটিয়াকে মাঝখানে স্টেশন ধরে নিই তাহলে মাত্র দিনে দুইবার শহরে যাওয়ার জনগণ সুযোগ পায়, যা এ ট্রেনে কোনো মতেই শহরে যাওয়া যাত্রীদের চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। আবার শহর থেকে সকালে চাকরিরত জনগণের এ ট্রেনে করে উপশহরগুলোর দিকে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই রেল যাত্রী পরিষদের দাবি, যদি আরও একখানা রেল দিয়ে আরও দুই জোড়া ট্রেন এই রুটে চলে তবে শহর থেকে উপশহর/গ্রামে যাওয়া জনগণের সকল সময় সময়ে যাওয়া সম্ভব। বর্তমানে এই রুটে ট্রেনের যাত্রাকাল ৩ ঘণ্টারও বেশি, যেখানে গতিবেগ ঘণ্টায় মাত্র ২০ কি.মি. থেকে ৪০ কি.মি.। নতুন রেলপথ পুনর্বাসনের পরেও এই গতিবেগ! তাই গতিবেগ ঘণ্টায় গড়ে ৪০ থেকে ৫০ কি.মি. করলে অনায়াসে ২ ঘণ্টায় এই দূরত্বে রেল যাত্রা শেষ করা সম্ভব।

এই ট্রেনে পুরুষ যাত্রীর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু যাত্রী যাতায়াত করে। কিন্তু নারী ও শিশুদের জন্য তা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। তাই নারী ও শিশুর জন্য একটি বগি সংরক্ষণ করতে হবে। এই ট্রেন (বিকালের) অনেক সময় বিলম্ব করে। তারপরও অনেক যাত্রী আধাঘণ্টার পথ এক ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, যা সত্যিই অভাবনীয়। তাই ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা যতটুকু সম্ভব মেনে চলার ব্যবস্থা নিতে হবে। একটা শহরকে প্রাণবন্ত করতে হলে তার আশেপাশের উপশহরের সাথে যোগাযোগ হতে হবে সহজ, সময়মত, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী। তাহলে মানুষ শহরের উপর চাপ না বাড়িয়ে আশেপাশে বিকেন্দ্রীভূত হবে। প্রধানমন্ত্রীও এই বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছেন। সে জন্য পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন দরকার। রেল লাইন বর্তমান থাকার পরও তার সর্বোচ্চ ব্যবহার না করে সড়কের উপর চাপ বাড়ানো কোনোভাবেই কাম্য নয়। দোহাজারী রেললাইনসহ সব রেললাইনকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। আন্তঃনগর ট্রেনের পাশাপাশি লোকাল/ডেমু ট্রেনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, নি¤েœ চট্টগ্রাম শহরের সাথে উত্তর আর দক্ষিনে লোকাল রেলপথের চিত্র দেওয়া হলো যার মাধ্যমে নি¤œ উল্লেখিত উপশহর সমূহ সরাসরি রেল সংযুক্ত হবে।
চট্টগ্রাম স্টেশন: ১. বোয়ালখালী পৌরসভা এবং বোয়ালখালী উপজেলার বিভিন্ন গ্রোটসেন্টার। ২. পটিয়া পৌরসভা এবং পটিয়াউপজেলার বিভিন্ন গ্রোটসেন্টার। ৩. চন্দনাইশ ও দোহাজারী পৌরসভা এবং চন্দনাইশ উপজেলার বিভিন্ন গ্রোটসেন্টার। ৪. হাটহাজারী পৌরসভা এবং হাটহাজারউপজেলার বিভিন্ন গ্রোটসেন্টার। ৫. নাজিরহাট পৌরসভা এবং হাটহাজারী-ফটিকছড়ি উপজেলার বিভিন্ন গ্রোটসেন্টার। ৬. সীতাকুন্ড পৌরসভা এবং সীতাকুন্ড উপজেলার বিভিন্ন গ্রোটসেন্টার। ৭. মীরেরসরাই পৌরসভা এবং মীরেরসরাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রোটসেন্টার। ৮. কালুরঘাট শিল্প এলাকা ও মোহরা আবাসিক এলাকা। ৯. ভাটিয়ারি ও ফৌজদারহাট শিল্প ও আবাসিক এলাকা।

এভাবে লোকাল ট্রেন ব্যবস্থা করলে যেগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের সাথে সাথে আবাসনে বিকেন্দ্রীকরণ সহজ হবে। মানুষ শহর থেকে দূরে থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। আবার শহর থেকে দূরে উপশহরসহ গ্রামে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্য চাকরিরত মানুষও উৎসাহ পাবে। যা হবে নগরের আবাসন সমস্যা সমাধানের একটা সহজতম উপায়। এটা সবাই সহজভাবে বুঝলেও কোনো অদৃশ্য কারণে বাস্তবায়িত হয় না। কিন্তু আশার কথা, সাধারণ জনগণ যেহেতু পরিষদ গঠন করে স্বেচ্ছায় টিকেট চেকের মাধ্যমে রেলের আয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, রেল কর্তৃপক্ষ আরও ট্রেনের ব্যবস্থা করে জনগণের এই ভালোবাসাকে সম্মান দেখাতে পারে। উপভোগ্য, উন্নত, টেকসই আবাসনের জন্য অন্যতম প্রভাবক লোকাল ট্রেন হোক শহর, উপশহর ও গ্রামের প্রধান যোগাযোগ।
লেখক: স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ, সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চুয়েট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আবাসন

২৮ ডিসেম্বর, ২০২১
২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন