Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কিসের সঙ্কেত পাওয়া যায়?

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

লোকে বলে, বাংলাদেশের মাটিতে সোনা ফলে। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এমন দেশ আর কোথাও নেই। এ দেশের ৬ ঋতু পৃথিবীর সকল দেশের নাগরিকদের নিকট সমভাবে সমাদৃত। এর দু’টি সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর যে কোনো সৈকতের চেয়ে আলাদা। রয়েছে পৃথিবীর সেরা বনাঞ্চল। রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার নজির, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার গৌরবও এ দেশবাসীর রয়েছে। রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করে বেঁচে থাকার অদম্য সাহস। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অনেক রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার দৃষ্টান্ত বিরল। সরকারের ভাষ্য মতে, উন্নয়নের গতি সমান্তরালে চলছে। পক্ষান্তরে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির কঠিন অভিযোগ। কিন্তু যে বিষয়টির অভাব জনগণ গভীরভাবে অনুভব করে, তা হলো গণতন্ত্র তথা নির্ভয়ে কথা বলা এবং নিজ চাহিদা মতো প্রার্থীকে ভোট দেয়ার স্বাধীনতা। অন্যদিকে রয়েছে শাসকদের নির্যাতনের আতঙ্ক, যার জন্য জনগণ হক কথা বলা বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশ ও মিথ্যা মামলাই যেন সরকার রক্ষার রক্ষাকবজ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উন্নয়নের গলাবাজির সাথে গণতন্ত্রের নির্বাসন এখন দৃশ্যমান।
সরকারের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপিকে কোণঠাসা করে সরকার নিরবে, নিভৃতে, নিশ্চিতে থাকলেও কোথায় যেন ‘ফাঁকা’ পড়ে আছে, যা ডাইগনসিস করতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এর মূল কারণ সরকারের একমাত্র টার্গেট বিএনপি। এ জন্য অন্য কোনো দিকে সরকারের এজেন্সিগুলি মনযোগ দেয়ার ফুসরৎ পাচ্ছে না। শয়নে-স্বপনে সরকার যদি বিএনপিকে একমাত্র টার্গেট করে সর্বোচ্চ মনোনিবেশ করতে থাকে, তবে দেশ রক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলির অন্যদিকে মনযোগ দেয়ার অবকাশ কোথায়?
পীলখানার সেনা কর্মকর্তা হত্যাজজ্ঞ, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা বা রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশাল গণজামায়েতের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটছে, যা সম্পর্কে সরকারের নিকট কোনো পূর্বাভাস ছিল না। সরকারি গোয়েন্দারা শুধু পূর্বাভাস পাচ্ছে কখন কোথায় বিএনপি/জামায়াত রয়েছে, যা দিয়ে পুলিশ গায়েবি বা ভূয়া মামলা সৃজনের নিমিত্তে এজাহারের পান্ডুলিপি তৈরি করে উপর তলার কর্মকর্তাদের খুশি রাখে। পুলিশের উপর সরকারের নির্ভরশীলতা এখন দৃশ্যমান। সরকার পুলিশ নির্ভর হলেও আখের গুছাতে তারা (পুলিশ) যত ব্যস্ত, পক্ষপাতিত্বহীন আইনের সঠিক প্রয়োগে ততটাই অনাসক্ত।
সম্প্রতি কিছু ঘটনা সম্পর্কে সরকারের আগাম তথ্য নেই বলেই প্রতিয়মান। অন্যদিকে আগাম তথ্য জানা থাকলেও সরকারের ভূমিকা কী? নাকি সরকারের ভিতর থেকেই ঘূণে ধরার ভূমিকা পালিত হচ্ছে? আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নিকট প্রিয়া সাহার অভিযোগ, যা সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কিন্তু অতো লম্পঝম্পের পরেও তো এর কোনো বিচার বা কোনো প্রকার অ্যাকশন পরিলক্ষিত হলো না। ১৮ জুলাই ২০১৯ পত্রিকান্তরে প্রকাশ যে, ‘আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ’ (ইস্কন) চট্টগ্রামের বেশ কিছু স্কুলে ফুড কর লাইফ কর্মসূচির অধীনে শিক্ষার্থীদের ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে, মাতাজি প্রসাদ কি জয়’ প্রভৃতি ধ্বনি দিয়ে খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। স্কুলে যেখানে সকল ধর্মের ছাত্রছাত্রী রয়েছে সেখানে একটি বিশেষ ধর্মের শ্লোগান দিয়ে খাদ্য বিতরণকে চট্টগ্রামবাসী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানি মনে করে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেনের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেছে। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি অসাম্প্রদায়িক। ক্ষমতার দাপটে যারা হিন্দুর সম্পত্তি বা দেবত্তোর সম্পতি দখল করেছে, গণমানুষ তাদের পছন্দ করে না, কিন্তু বন্ধুরাষ্ট্র ভারত, মায়ানমার, নেপালে এর ভিন্ন চিত্র।
সম্প্রতি ভোলায় ঘটে যাওয়া ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতায় মানুষের প্রাণহানি, বুয়েটে আবরার হত্যা, অতি সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চ কর্তৃক ডাকসু কার্যালয়ে নির্বাচিত ভিপিকে মারধর প্রভৃতিতে অন্তর্নিহিত শক্তির উসকানি আছে কিনা তাও দুরদৃষ্টিসম্পন্ন নজরে সরকার দেখতে পাচ্ছেন কি না তাও এখন প্রশ্ন। স্বপদে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর সরকারি দলের মুখপাত্র ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, সংখ্যালঘুরা ভারত থেকে ফেরৎ আসলে তাদের জায়গা দেয়া হবে। এ কথায় তিনি বাংলাদেশকে কোন বাস্তবতার মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তাও পরিষ্কার নয়। ভারত থেকে মুসলিম বিতাড়িত করায় মোদি সরকারের প্রস্তুতি সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং বাস্তবতায় কোনো সংঙ্গতি নেই। মন্ত্রী বলছেন, ভারতে এনআরসি হওয়ার কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, অথচ পত্রিকান্তরে প্রকাশ যে, প্রতিনিয়তই ভারত থেকে মুসলমানদের জোরপূর্বক বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ওবায়দুল কাদের জাতীয় পার্টির কাউন্সিলে বলেছেন যে, ‘গণতন্ত্রে সরকারি দল একা শক্তিশালী হলে হবে না। গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতে হলে শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন।’ সরকারি দলের মুখপাত্র যদি স্টেজ ফিটিং হিসাবে এ কথা বলে থাকেন, তবে তিনি কোনো ভুল করেছেন বলে কেউ মনে করবে না। কিন্তু সরকার যদি গণতন্ত্রকে অর্থবহ করাকে সঠিক মনে করে তবে গৃহপালিত বিরোধীদল সৃষ্টিতে ব্যস্ত না থেকে প্রকৃত বিরোধীদলকে নীতিগতভাবে স্পেস দিতে হবে। রাষ্ট্রের উচ্চ আসনে বসে কে কখন সত্য বলে বা কে কখন অসত্য কথা বলে তা আঁচ করা অত্যন্ত কঠিন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যখন মানুষ মিথ্যা কথা বলে তখন সত্যের মতই মনে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থে গাড়ি-বাড়ি ব্যবহারকারীদের মঞ্চের বক্তৃতা বাস্তবে যখন ১০০% গড়মিল হয় তখনই রাজনীতির প্রতি গণমানুষের শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থা থাকে না।
প্রতিপক্ষকে দুর্বল করলে নিজেই দুর্বল বা গুরুত্বহীন হয়ে যাওয়ার প্রবাদটি আজকের নয়। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্ব কমে যাওয়া বা না যাওয়া দু’টিই নির্ভর করে সরকারের নিজ আচরণের উপরে। সরকার বিনা ভোটে তথাকথিত নির্বাচিত এবং প্রতিপক্ষকে মিথ্যা মামলা ও লাঠির জোরে দাবিয়ে রাখার যে অভিযোগ, তা খ-ানের জোরালো যুক্তি সরকার আন্তর্জাতিক দরবারে দাঁড় করাতে পেরেছে কি? সরকার চেষ্টা করেও রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে নাই, অথচ, এব্যাপারে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালত পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছে গাম্বিয়া।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, গত ৪ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪৫২ জন বাংলাদেশি অভিবাসী নিহত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তারা দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে উদ্বেগ তুলে ধরার ব্যবস্থা নিয়েছেন। আরব বিশ্ব, মালোয়শিয়া, যেখানে শ্রমবাজার রয়েছে সে সকল রাষ্ট্র প্রতিনিয়তই শ্রমজীবী বাংলাদেশিদের দেশে ফেরৎ পাঠাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম বাজার সৃষ্টিতে বা রক্ষার্থে বাংলাদেশ সরকার কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। এ ব্যর্থতার দায় কার উপর বর্তাবে? বৈদেশিক ঋণের উন্নয়নে যদি আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝা বাড়ে তবে এ ঋণ কাকে পরিশোধ করতে হবে? নাকি এ ঋণ পরিশোধের কোনো প্রয়োজন হবে না? সরকারের চাহিদা পূরণে নানাভাবে ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হয়েছে, যথা- ভ্যাট, পৌর ট্যাক্স, ভূমি ট্যাক্স, অধিকন্তু ওহপড়সব ঞধী তো রয়েছেই। ওহপড়সব ঞধী অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তারা এখন নিজেরাই দালালী করে। অন্যদিকে আইনজীবীর দায়িত্ব তারাই পালন করছে। ফলে ন্যায্য ট্যাক্স প্রদান করতে সরকারি ট্যাক্সের চেয়ে ঘুষের পরিমাণ বেশি নির্ধারিত হয় বলে ওহপড়সব ঞধী ঙভভরপব এর নাম শুনলেই জনগণ আৎকে উঠে। ওহপড়সব ঞধী অফিসে ঘুষ সহনীয় থাকলে জনগণ ট্যাক্স প্রদানে অধিক মাত্রায় উৎসাহ বোধ করতো। হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি পাওয়ায় বাসা ভাড়া বৃদ্ধি পাচ্ছে, জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য। যুব সমাজের একটি অংশ মাদকে জড়িয়ে পড়ায় প্রতি পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে গ্যাং স্টার। বর্ডার সংরক্ষিত না থাকার কারণে মিয়ানমার থেকে অহরহ আসছে মাদক দ্রব্য, যার সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে প্রতিনিয়ত। পিতামাতা কর্তৃক সন্তান হত্যা, সন্তান কর্তৃক পিতামাতা হত্যার ঘটনা ইতোপূর্বে এতো প্রকট আকার ধারণ করে নাই, যা বর্তমানে একদিকে ঘটছে অভাবের তাড়নায়, অন্যদিকে রয়েছে মাদকের প্রভাব। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পণ্য নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। এ প্রচন্ড শীতেও রাজপথে খোলা আকাশের নিচে ছিন্নমূল মানুষের ঘুমাতে হয়, ক্ষুদা নিবারনের জন্য এখনো অসহায় মানুষদের কাঠের নৌকায় সমুদ্র পাড়ি জমাতে গিয়ে সাগরে ডুবে মরতে হয়। সরকারের সাবেক মন্ত্রী, ১৪ দলের অন্যতম নেতা ও নীতি নির্ধারক নিজেই স্বীকার করেছেন যে, বিগত ১০ বছরে ৯ লক্ষ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বিষয়গুলি একটি জাতির জন্য কি সংকেত প্রদান করছে?
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

 



 

Show all comments
  • jack ali ৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:২৩ পিএম says : 0
    We claim ourselves that we are muslim=== but we did not establish the Divine Law of Allah [SWT] as such the government is oppressing the people of Bangladesh--- Unfortunately muslim in our beloved country they also do not follow Qur'an And Sunnah of our Beloved Prophet.....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাষ্ট্রভাষা
আরও পড়ুন