Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রফিক আজাদ এক বিপ্লবী কবি

সা য়ী দ আ বু ব ক র | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

সমগ্র বিশ্বের প্রকৃত কবিরা হলেন একসাথে একটি সমুদ্রের মতো। সবাই মিলে একই পানিতে নতুন নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করেন তারা, যার ধ্বনি আমাদের কানকে বিমোহিত করে, হৃদয়কে আন্দোলিত করে এবং চক্ষুকে শীতল করে। কতিপয় কবিতার কারণে রফিক আজাদও বিশ্বকবিতার মহাসমুদ্রে একটি আলাদা তরঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। ষাটের দশকের উজ্জ্বলতম কবি রফিক আজাদ কবি হিসেবে ছিলেন সবার থেকে আলাদা। অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের এ কবি ছিলেন সমুদয় শোরগোল ও প্রচারপ্রপাগা-ার বিপরীতে। তাঁর কবিতাই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল এদেশবাসীর কাছে।

অনেকগুলো জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থের জনক কবি রফিক আজাদ। অসম্ভবের পায়ে, সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে, হাতুড়ির নিচেয় জীবন, খ্বু বেশি দূরে নেই, অপার অরণ্য প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা হলো ‘ভাত দে হারামজাদা’। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এ কবিতা দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করে বৈশ্বিক হতে পেরেছে এর সার্বজনীন আবেদনের কারণে। অন্তরের তাগিদে কোনো কবিতা রচিত হলে তার ফলাফল এরকমই হয়; নজরুলের ‘বিদ্রোহী’র ক্ষেত্রেও এরকমই হয়েছিল। কবিতা কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় ও মৃত্তিকাকে বুকে ধারণ করে সৃজিত হয় বটে; কিন্তু তা যদি শিল্পের মানদ-ে একবার টিকে যায় তাহলে সাম্প্রতিকতার তুচ্ছতা সে-কবিতাকে গ্রাস করতে পারে না কিছুতেই।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তাঁর এ কবিতাটি আঠারো মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ও অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা। স্রেফ একটি গদ্যকবিতা। তারপরও কবিতাটি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে একটুও অসুবিধে হয়নি এদেশে। কবিতা গদ্য কি পদ্য, এটা বড় কথা নয়; আসল কথা হলো, যে-ধরনেরই হোক না কেন, কবিতা যদি মানবিক আবেদনে পরিপূর্ণ হয় তা পাঠকের হৃদয়তন্ত্রীতে টান না মেরে পারে না। কবি আজাদ কত সহজেই বুভুক্ষাপীড়িত মানুষের কণ্ঠকে আত্মস্থ করে উচ্চারণ করতে পারেন বিদ্রোহীর মতো-
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনো দাবি,
অনেকে অনেক কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়;
বাড়িগাড়ি, টাকাকড়িÑকারু বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবি: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তরÑ
ভাত চাইÑএই চাওয়া সরাসরিÑঠা-া বা গরম,
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চালে হ’লে
কোনো ক্ষতি নেইÑ মাটির শানকিভর্তি ভাত চাই;
দু’বেলা দু’মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো অন্য সব দাবি।
দু-ছত্র প্রেমের কবিতা যে-কেউই লিখতে পারে; গীতিকবিতাকে তো গ্রিক ক্লাসিক সাহিত্যে তৃতীয় শ্রেণির কবিতা বলেই গণ্য করা হতো; এ ধরনের কবিতা মুহূর্তের মধ্যে ভুরি ভুরি রচনা করা যায়; কিন্তু ‘ভাত দে হারামজাদা’র মতো বৈপ্লবিক কবিতা যখন তখন সৃজন করা যায় না। এ ধরনের কবিতার জন্য চাই আলাদা মাহেন্দ্রক্ষণ, আলাদা সাধনা। রফিক আজাদ আপদমস্তক ছিলেন মানবতাবাদী; তাই তাঁর কাব্যখ্যাতি বাংলা ভাষায় স্থিত হয়ে যায় গণমানুষের কবি হিসেবে। তাই তিনি অগ্নির মতো জ্বলে উঠতে পারেন ক্ষুধার্তের কণ্ঠ হয়ে:
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পারিণতি নিয়ে আসে নিমস্ত্রণ ক’রে।
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী,
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়িÑ
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।
ভাত দে হারামজাদা, তা-না হ’লে মানচিত্র খাবো।
সত্যি বলতে কি, ফররুখ আহমদের ‘লাশ’ কবিতার পর বাংলা ভাষায় সবচেয়ে উজ্জ্বল বিপ্লবী কবিতা রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা’। কবিতাটি দীর্ঘদিন ধরে ঘোরের মধ্যে রেখেছিল ষাটোত্তর তরুণ কবিদেরকে। এটা একজন বড় কবির লক্ষণ, সন্দেহ নেই। তবে ভুলে গেলে চলবে না, রফিক আজাদের অনেক আগে প্যালেস্টাইনের কবি মাহমুদ দারবিশ এ ধরনের একটি বিপ্লবী কবিতা লিখেছিলেন তাঁর জন্মভূমির হারানো স্বাধীনতা নিয়ে, যেখানে কবি ফেটে পড়েছিলেন তীব্র বিক্ষোভে। কবিতাটির নাম ‘পরিচয়পত্র’। এ কবিতায় মাহমুদ দারবিশ বলেন:
লিখে রাখুন!
আমি একজন আরব।
আপনি চুরি করে নিয়েছেন আমার পূর্বপুরুষদের ফলের বাগান
এবং আমার জমি-জায়গা যেখানে আমি আমার সন্তানদের সাথে
চাষবাস করতাম।
এবং আপনি আমার জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি
কেবল পাহাড়গুলো ছাড়া।
রাষ্ট্র কি সেগুলোকে সেভাবেই ব্যবহার করবে
যেমনটি বলা হয়েছে?
সুতরাং
লিখে রাখুন প্রথম পৃষ্ঠার উপর:
আমি মানুষকে ঘৃণা করি না
সীমা লংঘনকারীও আমি নই।
কিন্তু আমি যদি ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ি
দখলকারীর মাংসই হবে আমার খাদ্য
সাবধান...
সাবধান হয়ে যান
আমার খিদে এবং আমার ক্রোধের ব্যাপারে।
রফিক আজাদ ছিলেন অত্যন্ত ছন্দ সচেতন কবি। তথাকথিত মাথামু-ুহীন গদ্যকবিতার বিরুদ্ধে তাঁকে বিদ্রোহ করে উঠতে দেখি তাঁর ‘গদ্যের অরণ্যে হারিয়ে-যাওয়া আমি এক দিগভ্রান্ত পথিক’ কবিতায়। তাঁর হৃদয় কত ক্ষত-বিক্ষত, তা আমরা টের পাই যখন কবি এরকম করে বলে ওঠেন:
‘মানুষ’ শব্দটিও ক্রমশই
বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেÑ
পথের পরিবর্তে ‘রাস্তা’
মানুষের পরিবর্তে ‘লোক’
ব্যবহৃত হয়ে আসছে আজকাল,
‘মানুষ’ ক্রমশ স্থায়ীভাবে
অভিধানে চলে যাচ্ছেÑ
গদ্যকবিতার কথা বলতে গিয়ে কবি রূপকাশ্রয়ী হয়ে ওঠেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে। তাঁর চোখে-মুখে ফুটে ওঠে বিধ্বস্ত স্বদেশ, প্রিয় দেশমাতৃকার সকরুণ ছবি। তাই তাঁর বিক্ষুব্ধ উচ্চারণÑ
বড় বেশি গদ্য-চর্চা হচ্ছে আজকাল
প্রবাদপ্রসিদ্ধ এই দেশে।
যার ফলে আমরা একজন বজ্রকণ্ঠ, স্বপ্নদ্রষ্টা
নেতার পরিবর্তে পাচ্ছি অসংখ্য ছোট-ছোট গদ্য নেতা,
একজন সিরাজদ্দৌলার পরিবর্তে
অসংখ্য মীরজাফর,
একজন ভাসানীর পরিবর্তে পাচ্ছি
অসংখ্য ফেরেব্বাজ,
একজন বাংলার বাঘের পরিবর্তে
অসংখ্য মেষ-শাবকÑ
একজন চ-ীদাসের পরিবর্তে
অসংখ্য আবৃত্তিকারÑ
আমরা রুদ্ধবাক হয়ে তাঁর কথামালা শুনি আর নড়েচড়ে উঠি নিরাভরণ সত্যের উত্তাপে। প্রকৃতপক্ষে রফিক আজাদ ছিলেন স্বভাবে বিপ্লবী, অন্তরে খাঁটি মানবতাবাদী। এ শ্রেণির কবির অভাব অন্য কিছু দিয়ে পুরা করা যায় না। এ ধরনের কবির মৃত্যুও হয় না কখনও কোনো ভাষায়, কোনো দেশে। বরেণ্য এ কবি সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৪), কবি আহসান হাবীব পুরস্কার (১৯৯১) কবি হাসান হাফিজুর রহমান পুরস্কার (১৯৯৬), বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা পুরস্কার (১৯৯৭) ও একুশে পদক (২০১৩)। শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও কবি রফিক আজাদ মৃত্যুহীন হয়ে থাকবেন বাংলা কবিতার বিশাল ভুবনে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন