Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিক্ষোভে গুলির কথা স্বীকার পুলিশের

আন্দোলনে এবার মাঠে নামছে রাজনৈতিক দলগুলোও ষ সিএএ গ্রহণযোগ্য নয় : ওআইসি

মুহাম্মদ সানাউল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

রাজধানী দিল্লিতে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেও কলকাতায় বিশাল মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, প্রাণ থাকতে তিনি পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হতে দেবেন না।
বিক্ষোভকারীরা দিল্লির মান্ডি হাউস এলাকায় সমবেত হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। স্বরাজ ইন্ডিয়া দলের নেতা যোগেন্দ্র যাদবসহ বিক্ষোভকারীরা অনেকেই ১৪৪ ধারা ভেঙে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেন। জেএনইউ, জামিয়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও তাতে যোগ দেন। এর আগে ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং এনআরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য মান্ডি হাউস এলাকায় সমবেত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো বিক্ষোভকারীরা।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভে গুলি চালানোর কথা প্রথম বারের মতো স্বীকার করেছে ভারতের উত্তর প্রদেশ পুলিশ। এই বিক্ষোভে রাজ্যটিতে ১৬ জন নিহত হয়েছে। এদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও রাজ্য পুলিশের দাবি ছিলো তাদের তরফে একটি গুলিও ছোঁড়া হয়নি। তবে উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা বিজনর পুলিশ স¤প্রচারমাধ্যম এনডিটিভিকে বলেছেন, ওই শহরে নিহত দুই জনের একজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালিয়েছে বলে দাবি করেছেন জেলা পুলিশ প্রধান। গত ১২ ডিসেম্বর ভারতে সিএএ-এর পর থেকেই দেশটির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ চলছে। এসব বিক্ষোভে সহিংসতায় অন্তত ২৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু উত্তর প্রদেশেই নিহত হয়েছে ১৬ জন। গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজ্যটিতে নতুন করে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিনের বিক্ষোভে বিজনরে নিহতদের মধ্যে ছিল সুলেমান নামে ২০ বছরের এক তরুণ। বিজনর জেলা পুলিশের প্রধান সঞ্জিব ত্যাগী বলেন, আত্মরক্ষার্থে সুলেমানকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় এক কনস্টেবল।
তিনি বলেন, ‘ছিনিয়ে নেয়া একটি বন্দুক কেড়ে নিতে আমাদের এক কনস্টেবল বিক্ষোভকারীদের দিকে এগিয়ে গেলে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। তার পালানোর উপায় ছিলো না। আত্মরক্ষার্থে দাঙ্গাকারীকে গুলি করা হয়। তার বন্ধুরা তাকে নিয়ে যায়। তার নাম সুলেমান। পরে সে মারা যায়। আরেক বিক্ষোভকারী আনিস ভিড়ের মধ্য থেকে ছোঁড়া গুলিতে নিহত হয়’। শুক্রবারের ওই বিক্ষোভে হতাহতের পর শনিবার উত্তর প্রদেশ রাজ্য পুলিশের প্রধান ওপি সিং দাবি করেন, আমরা একটা গুলিও ছুড়িনি। তিনি বলেন, কেবলমাত্র বিক্ষোভকারীরাই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। গুলিতে বেশ কয়েকজন পুলিশও আহত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে সিএএ বাতিলের আন্দোলনে ছাত্র-জনতার পর এবার মাঠের আন্দোলনে যুক্ত হতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। প্রকাশ্যে এই আইনের বিরোধিতার পর এবার অহিংস আন্দোলনে নেমেছে বিরোধী দল কংগ্রেস। গত সোমবার মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধ রাজঘাটে ধরনা বা ‘সত্যাগ্রহ’ কর্মসূচি পালন করেছে তারা। এদিন সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী, সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রসহ দলটির শীর্ষ নেতারা সত্যগ্রহে অংশ নেন। নেতারা সংবিধানে দেয়া জনগণের অধিকার রক্ষার দাবি জানান। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে দেশের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন তারা। মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা কমল নাথ এবং রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী আরেক কংগ্রেস নেতা অশোক গেহলত বলেছেন, তাদের রাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন বাস্তবায়িত হবে না। কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম সংবিধান রক্ষায় বিজেপি ছাড়া সব দলকে একত্রিত হওয়ার আহŸান জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি সব বিরোধী দলকে একসঙ্গে কাজ করতে বলেছেন। তবে এই আইনের বিরুদ্ধে তামিল নাড়ুর চেন্নাইয়ে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিরোধী দল ডিএমকে। দলের নেতা এ কে স্ট্যালিন ২০ হাজারের বেশি মানুষের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। তিনি শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আরো বড়ো প্রতিবাদ কর্মসূচি করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে, বিক্ষোভকারীদের ওপর বলপ্রয়োগের সময় সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের জন্য সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা করেছে ভারতের এডিটরস গিল্ড।
এদিকে বিক্ষোভের পালটা হিসেবে নাগরিকত্ব আইনের ‘প্রকৃত সত্য’ তুলে ধরতে পথে নেমেছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। গত সোমবার কলকতায় মিছিলে নেতৃত্ব দেন দলটির সর্বভারতীয় কার্যকরী সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডা। বিজেপি নেতারা বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, গত ১২ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব সংশোধিত আইন হওয়ার পর থেকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ-আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। বিক্ষোভে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ২৫ জন নিহত হয়েছেন।
ধর্মের নামে বিভেদের রাজনীতি করছে বিজেপি, বললেন মমতা
বাংলায় কোনও ভাবেই সিএএ এবং এনআরসি আইন কার্যকর করতে দেবেন না বলে ফের দাবি করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে তার দাবি, বিজেপি ধর্ম নিয়ে খেলা করছে, তা নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করছে।
গতকাল সিএএ ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে ফের পথে নামেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন দুপুরে মিছিল করেন তিনি। মিছিল শুরুর আগে বিধান সরণিতে স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ির সামনে এক জমায়েতে বিজেপি বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানালেন মমতা। এরপর মিছিলে অংশ নেন তিনি। বেলেঘাটায় মিছিল শেষে ফের মমতার দাবি, বাংলায় এনআরসি বা সিএএ আইন চালু করা হবে না। উত্তরবঙ্গে মিছিল করারও ঘোষণা দেন মুখ্যমন্ত্রী। বছরের শেষ তিনদিন অর্থাৎ ২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়িতে মিছিলে হাঁটবেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, গতকালই শিলিগুড়িতে এনআরসি এবং সিএএ’র সমর্থনে মিছিল করেছে বিজেপি। অভিনন্দন যাত্রায় হাঁটেন মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়ণবিস, দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, উত্তরবঙ্গে কামতাপুরী-রাজবংশীদের মতো শরণার্থীদের বাস। বিজেপি শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ইস্যুতে ফ্রন্টফুটে রয়েছে। তাই জনগোষ্ঠীদের মন পেতে এবার ময়দানে তৃণমূলও। একইসঙ্গে গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে খাতা খুলতে পারেনি ঘাসফুল শিবির। সবকিছুকে মাথায় রেখেই উত্তরবঙ্গে মিছিলের ঘোষণা করেছেন মমতা।
এর আগে সিএএ ও এনআরসি প্রশ্নে সমগ্র ভারতের সকল বিরোধী ও সহযোগী দলকে একতাবদ্ধ হবার আহŸান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চিঠিতে তিনি গণতন্ত্র বাঁচাতে সকল দলকে একটি বৈঠকে মিলিত হবার আহŸানও জানিয়েছেন। চিঠিতে মমতা লেখেন, ‘অত্যন্ত উদ্বেগ নিয়ে আমি আপনাদের কাছে চিঠি লিখছি। ধর্ম, সিএএ ও এনআরসি ইস্যুতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।’ ‘... কঠোর এই আইনের বিরুদ্ধে আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে। সমস্ত প্রবীণ নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক দলকে সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আমি আন্তরিকভাবে অনুরোধ করছি। ...আসুন কেন্দ্রের অসৎ প্রচেষ্টার শান্তিপূর্ণ এবং অর্থবহ বিরোধিতা করি এবং ভারতের গণতান্ত্রিক আত্মাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসি।’ চিঠিতে মমতা আরও লেখেন, ‘যুবক ও শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রের বর্বর ও হিংস্র শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। পুরো বিশ্ব আমাদের দেখছে ... আসুন আমরা ভারতকে বাঁচাতে সোচ্চার হই।’ চিঠির অনুলিপি কংগ্রেস প্রধান সোনিয়া গান্ধী, এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার এবং জাতীয় সম্মেলনের ফারুক আবদুল্লাহকে পাঠানো হয়েছে।
এনপিআরের কাজ শুরু করল ভারত
ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার আপডেটের জন্য অর্থবরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশেই ছাড়পত্র দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট। সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের রিপোর্ট অনুসারে এনআরপি আপডেট করতে ৮ হাজার ৫’ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র।
এনপিআর হল দেশের সাধারণ বাসিন্দাদের এক তালিকা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বক্তব্য অনুযায়ী, যারা অন্তত গত ৬ মাস ধরে একটি এলাকায় থাকছেন, বা পরবর্তী ৬ মাস ধরে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় থাকার পরিকল্পনা করছেন তারাই দেশের সাধারণ বাসিন্দা। এনআরসি-তে যেমন নাগরিকত্বের বিষয় রয়েছে, এনপিআর তেমন কিছু নয়। ৬ মাসের বেশি সময় ধরে কোনও ভিনদেশি কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাস করলে তার নামও এ তালিকায় নথিভ্ক্তু হবে।
সিএএ গ্রহণযোগ্য নয় : ওআইসি
ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোÐঅপারেশন (ওআইসি)। স¤প্রতি পাস হওয়া সিএএ ও অযোদ্ধার বাবরি মসজিদ মামলার রায়ে মুসলিমদের স্বার্থহানি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে ওই সংগঠনটি। গত রোবার সউদী আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসির সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে এ ব্যাপারে উদ্বেগ জানানো হয়।
ওআইসির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ ও অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের চার্টারের মাধ্যমে প্রত্যেকটি দেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষিত করেছে। তার বিপরীতে ভারতের এমন আচরণ কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সংগঠনটি। অবিলম্বে মুসলিমদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করা ও তাদের পবিত্র স্থানগুলো সংরক্ষণ করতে ভারতের প্রতি আহŸান জানানো হয়েছে। ৫৭টি মুসলিম দেশের ওই সংগঠনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ সনদের নীতিমালা, দায়বদ্ধতা, বাধ্যবাধকতাগুলো তুলে ধরে কোনও রকম বৈষম্য ছাড়া ভারতে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন পালনের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। অন্যথায় ওই অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি এবং এটা গোটা অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। সূত্র : বিবিসি, পিটিআই, রয়টার্স, এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এবিপি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ