পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশের প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ প্রবাসে কাজ করে। বিদেশে কর্মরত এই বাংলাদেশি মানুষেরা তাদের অর্জিত অর্থ দেশে প্রেরণ করে। তাকে আমরা রেমিট্যান্স বলি। এটা আমাদের জাতীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। জাতীয় বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশ যোগান দেয় এই রেমিট্যান্স। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং একই সাথে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে এই রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রেমিট্যান্স হচ্ছে এদেশের অর্থনীতির প্রাণ এবং প্রধান চালিকাশক্তি। এই রেমিট্যান্সই ফরেন কারেন্সি রিজার্ভের প্রধান অংশ। আমদানির বিপরীতে বৈদেশিক দেনা পরিশোধে এই রেমিট্যান্স প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। বিদেশে কর্মরত লাখো মানুষের কষ্টার্জিত টাকা এদেশকে বছরের পর বছর ধরে উন্নত করে চলেছে। তাদের পাঠানো টাকায় সচল আমাদের অর্থনীতির চাকা এবং সচল আমাদের জীবন। বিদেশে কর্মরত এই সব মানুষের অর্জিত টাকা তাদের পরিবারের লোকজনের জীবনকে যেমন করেছে দারিদ্র্যমুক্ত এবং সচ্ছল, ঠিক তেমনি এদেশের আর্থসামাজিক অবস্থানকে করেছে উন্নত। বিদেশে কর্মরতদের পাঠানো টাকায় তাদের ছেলেমেয়েরা আজ ভালো স্কুলে পড়াশোনা করছে, উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে, তারা গ্রামে বা শহরে পাকা বাড়ি নির্মাণ করছে, তাদের পরিবারের লোকজন উন্নত জীবন যাপন করছে এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ব্যবহার করছে। শহর তো বটেই, গ্রামের জীবনযাত্রায় আজ যে উন্নয়ন, তা বিদেশে কর্মরত এই সব মানুষদের পাঠানো টাকারই প্রতিফলন।
প্রবাসীরা তাদের অর্জিত অর্থ দুই ভাগে দেশে প্রেরণ করে থাকে। প্রথমত ব্যাংকিং চ্যানেলে এবং দ্বিতীয়ত হুন্ডি চ্যানেলে। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে যে পরিমাণ টাকা দেশে আসে, তার প্রায় সমপরিমাণ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে আসে। হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত টাকা দেশের অর্থনীতিতে পরোক্ষভাবে অবদান রাখলেও তার প্রত্যক্ষ অবদান কম। তাই প্রবাসীদের সকল অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে প্রেরণের জন্য প্রবাসীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সরকার ইতোমধ্যেই এর জন্য কাজ শুরু করেছে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা প্রেরণের জন্য দুই শতাংশ নগদ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। একজন প্রবাসী এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে যে পরিমাণ টাকা প্রেরণ করবে তিনি তার সাথে দুই শতাংশ বেশি টাকা পাবেন। একজন ব্যক্তি যদি বিদেশ থেকে এক লক্ষ টাকা প্রেরণ করে, তাহলে বাংলাদেশে তার একাউন্টে এক লক্ষ দুই হাজার টাকা জমা হবে। এভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে একজন প্রবাসী যেই পরিমাণেই টাকা প্রেরণ করুক না কেন তিনি এবং তার বেনিফিসিয়ারি সেই টাকার অতিরিক্ত দুই শতাংশ বেশি টাকা পাবেন। এই প্রণোদনা সরকারের অত্যন্ত একটি ভালো উদ্যোগ। আমরা সরকারকে এজন্য ধন্যবাদ জানাই। এখন সরকারের এই দুই শতাংশ প্রণোদনা প্রদানের বিষয়টি বেশি বেশি করে প্রচার করতে হবে, যাতে করে দেশের সকল মানুষ এবং সকল প্রবাসী এই খবর জানতে পারে। তাছাড়া প্রবাসীদের অর্জিত সকল অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রেরণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একই সাথে প্রবাসীরা যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে সহজে টাকা পাঠাতে পারে, সেই সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে এবং বিদেশে অনেক এক্সচেঞ্জ হাউজের সাথে রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য চুক্তি করেছে। রেমিট্যান্স প্রেরণের জন্য বর্তমানে বিশে^ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক ও বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজ খুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক শীর্ষ রেমিট্যান্স সংগ্রহকারীদের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে। তবে এসবের পরিমাণ আরো বাড়াতে হবে।
পুরুষের পাশাপাশি প্রতিবছর অনেক নারী শ্রমিক সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজের সন্ধানে যায়। সেখানে তারা মূলত গৃহকর্মীর কাজ করে থাকে। কিন্তু এসব নারী শ্রমিক প্রায়ই নির্যাতনের শিকার হয়। এসব নারী শ্রমিক বাসায় ভালোভাবে কাজ করা সত্তে¡ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক সময় তাদেরকে ঠিক মতো খেতেও দেওয়া হয় না। তারা গৃহকর্তা এবং বাড়ির পুরুষ কর্তৃক কখনো কখনো শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। অনেক নারীকে সেখানে যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। ইতোমধ্যে অনেক নারী শ্রমিক বাধ্য হয়ে চাকরি বাদ দিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। অনেকে লাশ হয়ে ফিরেছে আবার অনেকে দেশে এসে আত্মহত্যা করেছে। গত ২৫ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নারী শ্রমিক কণ্ঠ’ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রাহেলা রাব্বানী বলেন, বিগত দশ বছরে ২৬ হাজার ৭৫২ জন নারী কর্মী লাশ হয়ে বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে। ২০১৯ সলের নয় মাসেই প্রায় তিন হাজার নারী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছে। আর যারা জীবিত অবস্থায় দেশে ফিরেছে তারা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব নারীরা দেশে ফিরে আসার পর পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছে অবহেলা, অবজ্ঞা এবং অপমানের শিকার হয়। ফলে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। উন্নত জীবনের আশায় অনেক নারী ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রেখে বিদেশে গিয়ে সবই হারিয়ে ফেলেছে। এ বিষয়টির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এক্ষেত্রে আরো বেশি মনিটরিং এবং কেয়ারিং বাড়াতে হবে। কোন নারী কর্মী বিদেশে গিয়ে যেন কোন ধরনের বিপদের মুখোমুখি না হয়, সে বিষয়টি অবশ্য অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সুষ্ঠু পরিকল্পনার আলোকে এই খাতের উন্নয়নে আরো বেশি কাজ করতে হবে। আরো বেশি বাংলাদেশি যেন চাকরি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেতে পারে তার জন্য সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
বিদেশে জনশক্তি প্রেরণ এবং তাদের সমস্যা-সম্ভাবনাকে দেখাভাল করার জন্য সরকারের জনশক্তি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় রয়েছে। কিন্তু এই মন্ত্রণালয়ের কাজকে আরো বাড়াতে হবে। বিশে^র কোন কোন দেশের কোন কোন সেক্টরে কোন সময়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে, তার আপ টু ডেট খবর নিতে হবে এবং তা জনগণকে জানাতে হবে। সেখানে যাতে বাংলাদেশি লোকেরা চাকরি নিয়ে যেতে পারে, তার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লোকজনকে দক্ষ করার জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে বাংলাদেশি লোকজন যাতে সহজে ভিসা পায় এবং কম খরচে বিদেশে যেতে পারে সেই বিষয়ে সরকারের তত্ত¡াবধান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি লোকটি বিদেশে গিয়ে তার কাক্সিক্ষত চাকরিতে যাতে যোগদান করতে পারে সে বিষয়টি ও সরকারকে মনিটরিং করতে হবে। বিদেশ যেতে এবং বিদেশে গিয়ে সে যেন কোনরকম বিপদের সম্মুখীন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে অবস্থিত দুতাবাসগুলোর দায়িত্ব এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিটির সুখে-দুখে যেন দুতাবাসের কর্মকর্তারা পাশে থাকেন সেই বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। এর জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি। এই জনগণকে সম্পদে পরিণত করতে হবে। ঘনত্বের দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবসতির দেশ বাংলাদেশ। এখানে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ বেকার রয়েছে। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিদিনই লোকজন কর্মসংস্থানের জন্য ছুটছে। অপরদিকে বিশ^বাজারে কর্মসংস্থান দিন দিন বাড়ছে। আর এই কর্মসংস্থান পূরণের মতো জনবল পৃথিবীর অনেক দেশেরই নেই। জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং অধিক সন্তান নিতে নারীদের অনিহার কারণে ইউরোপের অনেক দেশে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। আবার যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে অনেক মানুষ নিহত এবং আহত হবার কারণে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অপরদিকে আফ্রিকার দেশগুলোসহ বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং বিদেশের শ্রমবাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের বেকার যুবকদেরকে বিদেশে পাঠানোর বিরাট একটি সুযোগ রয়েছে। এজন্য সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকতে হবে। এদিকে প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে অনেক যুবক সুযোগ থাকা সত্তে¡ও বিদেশে যেতে পারছে না। এমনকি অনেকে বিমান ভাড়ার টাকাটাও যোগাড় করতে পারে না। সরকার যদি বিদেশে যাবার জন্য একটি ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে তাহলে সেই লোনের টাকা দিয়ে একজন ব্যক্তি বিদেশ যাবে এবং পরবর্তীতে বিদেশে গিয়ে টাকা আয় করে সেই লোন পরিশোধ করবে। বিদেশ গমনকারী ব্যক্তিটির দেশে অবস্থানরত নিকট আত্মীয়-স্বজন এই লোনের বিপরীতে গ্যারান্টার হবে। সরকার অতি সহজেই এ জন্য একটি স্কিম ঘোষণা করতে পারে। সরকার ইচ্ছা করলেই এই সেক্টরের জন্য ৫০০০ কোটি টাকার একটি বরাদ্দ করতে পারে। সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংকও বিদেশ যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য এই লোনের ব্যবস্থা করতে পারে। বর্তমানে এদেশের অনেক ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের কাছে ব্যাংকগুলোর অনেক টাকা পাওনা আছে এবং শুধুমাত্র খেলাপী ঋণের পরিমাণই এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি। আর এই টাকা বছরের পর বছর ধরেই অনাদায়ী। অথচ বিদেশে যাবার জন্য ব্যাংকগুলো অতি সহজেই ব্যক্তি প্রতি দুই লাখ টাকা করে লোন দিতে পারে। পাশাপাশি বিদেশে গিয়ে এদেশের লোকজন যাতে দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে, সে জন্য লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর ইংরেজি ভাষায় দক্ষতাসহ যে দেশে যাবে সেই দেশের ভাষা সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সরকারসহ আমরা সবাই যদি এই সেক্টরকে একটু বেশি গুরত্ব দেই, তাহলে আরো অনেক বেশি লোক বিদেশ যেতে পারবে এবং তারা নিরাপদ পরিবেশে কাজ করতে পারবে। এতে অনেক বেশি রেমিট্যান্স আহরণ সম্ভব হবে, যার ফলে উন্নত হবে আমাদের জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্র।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।