Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাস

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশ ও ভারত। শুধু দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম নয়। একই সাথে প্রতিবেশী রাষ্ট্র। শুধু এখানেই শেষ নয়। দু’টি রাষ্ট্রই পরস্পর পরস্পরকে বন্ধু রাষ্ট্র বলে দাবি করে। এর পরও কিন্তু কথা থেকে যায়। একটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র। আরেকটি হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র। এর ফলে বাস্তবক্ষেত্রে দুই রাষ্ট্রের গৃহীত নীতি ও কর্মসূচির মধ্যে যতই দিন যাচ্ছে ততই পার্থক্য বেড়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্যভাবে।
এই পার্থক্য কেন ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে, তা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে আমাদের ইতিহাসের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় নেই। ইতিহাসের গবেষক মাত্রই জানেন, এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভের পূর্বে প্রায় পৌনে দুইশত বছর সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের শাসনাধীন ছিল।

যদিও সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের দখলে যাওয়ার ফলে তদানীন্তন এ উপমহাদেশের প্রধান দু’টি ধর্ম সম্প্রদায় মুসলমান ও হিন্দু উভয়ই সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী বৃটেনের বিরুদ্ধে প্রথম দিকের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রধানত মুসলমানরা যতটা সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যায় হিন্দুরা বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে ততটা আগ্রহ দেখায়নি।
এর অন্যতম কারণ ছিল উপমহাদেশের সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসনের সূত্রপাত হয় যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা তথা সেই পলাশী বিপর্যয়ের পূর্বে এদেশের স্বাধীন শাসক (নওয়াব) ছিলেন মুসলমান। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা। একথাও এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইংরেজরা এদেশের সাথে বাণিজ্য করার নামে কলকাতায় অবস্থান গ্রহণ করলেও তারা গোপনে সেখানে দুর্গ নির্মাণ শুরু করে এখানকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যে।

এর বিরুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলা ইংরেজ-বিরোধী কর্মপন্থা গ্রহণ করলেও তাঁর অনেক অমুসলমান অমাত্যর সঙ্গে সা¤্রাজ্যবাদী ইংরেজরা গোপন যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করে। নবাব সিরাজুদ্দৌলার এইসব অমুসলমান অমাত্যদের মধ্যে ছিলেন জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লব, উমিচাঁদ প্রমুখ। এভাবে অমুসলমান অমাত্যদের হাত করার পর সর্বশেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি (আত্মীয়) মীর জাফর আলী খাঁকে সিরাজের পরিবর্তে নবাব করার লোভ দেখিয়ে সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করতে সম্মত করান।

এই গোপন চুক্তির মর্মানুসারে পলাশী রণক্ষেত্রে নবাব বাহিনীর বিরুদ্ধে ইংরেজরা যখন পরাজয়ের মুখোমুখি হয়, তখন আকস্মিকভাবে মীর জাফর আলী খাঁ নবাবের কাছে সেদিনকার মতো যুদ্ধ বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন। সিরাজুদ্দৌলা এই অদ্ভুত প্রস্তাবের কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজে না পেয়ে কিছুটা ইতস্তত করলে মীর জাফর আলী খাঁ তাকে এই বলে ভয় দেখান যে, তার প্রস্তাবে সম্মত না হলে তার যে পরিণতি হবে তার জন্য তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।

অগত্যা নবাব প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁর যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব মেনে নেন। এর ফলে নবাব সৈন্যরা রাতে বিশ্রাম নিতে গিয়ে যখন ঘুমে অচেতন, তখন হঠাৎ ইংরেজ বাহিনী নবাব বাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে বসে। নবাব ততক্ষণে ইংরেজদের সাথে মীর জাফরের গোপন ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে ও পলায়ন পর সেন্যদের যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগে বাধা দিতে সক্ষম না হওয়ায় নিজ প্রাণ বাঁচাতে যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করে পরবর্তীকালে সৈন্য সংগ্রহ করে ইংরেজদের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অবশ্য সেভাবে তাঁর আত্মরক্ষার চেষ্টা সফল হয়নি। তিনি পলায়নরত অবস্থায় ইংরেজ বাহিনী ও মীর জাফরের গুপ্তচরদের হাতে ধরা পড়েন এবং মোহাম্মদী বেগ নামের এক কুলাঙ্গারের হাতে নিহত হন।

সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর মীর জাফর অবশ্য নবাবের সিংহাসনে বসতে সক্ষম হন। কিন্তু মীর জাফর সিংহাসনে বসার পরপরই বুঝে উঠতে সক্ষম হন যে, তিনি নামকাওয়াস্তে নবাব হলেও নবাবের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সব চলে গেছে ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ ও তার এদেশি হিন্দু সহযোগীদের হাতে। এর পরও তিনি নবাবী ফলাতে চেষ্টা করাতে তাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে সে স্থানে তার জামাতা মীর কাসেমকে বাংলার নবাব করা হয়।
মীর কাসেম ছিলেন অবশ্য ভিন্ন ধাতুর মানুষ। তিনি ইংরেজদের অন্যায় বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ইংরেজদের সাথে তার সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। মীর কাসেম ইংরেজদের মূল ষড়যন্ত্র টের পেয়ে এদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রধানদের কাছে আকুল আবেদন জানালেও ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর সে আবেদনে কেউ সাড়া না দেয়ায় তাকেও শেষ পর্যন্ত করুণ পরাজয় বরণ করতে হয়। এমনিভাবে সমগ্র ভারত বর্ষে ইংরেজ শাসন শুরু হয়।

১৭৫৭ সালে পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রথমে বাংলা, পরে অন্যসব অঞ্চলে ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। এভাবে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শুরু হলেও উপমহাদেশের অমুসলমানরা প্রথম প্রথম অনেক দিন পর্যন্ত বৃটেনের শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হননি। তাদের কাছে সম্পূর্ণ ঘটনা মনে হয়েছিল শাসক বদল মাত্র। ফলে ইংরেজ বিরোধী প্রথম দিকের সমস্ত সংগ্রামে অংশ নেন শুধু মুসলমানরা। পলাশী বিপর্যয়ের একশত বছর পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলতে থাকে বিচ্ছিন্নভাবে।

এসব সংগ্রামের মধ্যে ছিল মজনু শাহের নেতৃত্বাধীন ফকীর আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার সংগ্রাম, হাজী শরীয়ত উল্লাহ-দুদুমিয়া প্রমুখের নেতৃত্বাধীন ফারায়েজী আন্দোলন, দাক্ষিণাত্বের হায়দার আলী-টিপু সুলতান প্রমুখের সংগ্রাম, শহীদ সৈয়দ আহম্মদ ব্রেলভী প্রমুখের জেহাদ আন্দোলন এবং সর্বশেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব। প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের অসহযোগিতার কারণে এসব স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং উপমহাদেশের মুসলমানরা সাময়িকভাবে হলেও বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম থেকে বিরত থাকে। ফলে উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন পাকাপোক্ত হয়ে যায়।

এই পর্যায়ে মুসলমানদের সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার করার লক্ষ্যে সাময়িকভাবে হলেও কিছুদিনের জন্য ইংরেজ শাসকদের প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও উন্নত করে তুলতে এগিয়ে আসেন উত্তর ভারতের স্যার সৈয়দ আহম্মদ খান এবং বাংলার নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখ মুসলিম মণিষীবৃন্দ। এদের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের প্রধান কীর্তি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। নবাব আবদুল লতিফ সে ধরনের কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করলেও ইংরেজ সরকারের প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজকে প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত করে সেখানে মুসলিম শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার পথ উন্মুক্ত করে দেন।
এভাবে ইংরেজদের সঙ্গে মুসলমানদের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আগ্রহ দেখে এক শ্রেণীর খৃস্টান মিশনারীরা দেশে খৃস্টান ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামের শেষ নবী সম্পর্কে অপপ্রচার চালাতে চেষ্টা শুরু করে দেন। দেশে তখন আলেম-উলামা অনেক থাকলেও তারা কেউ কেউ ইসলাম বিরোধী এসব অপপ্রচারের জবাব দিতে এগিয়ে আসেননি। মুসলমানদের সেই দুর্যোগের মুহূর্তে এগিয়ে আসেন যশোরের এক গ্রাম্য দর্জী, যিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন মুন্সী মেহেরুল্লাহ নামে। মেহেরুল্লাহকে গ্রাম্য অর্ধশিক্ষিত দর্জী মনে করে তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বাহাছ বা বির্তকে আহ্বান জানান খৃস্টান মিশনারীরা।

কিন্তু পরপর একাধিক বাহাছে পরাজিত হয়ে খৃস্টান মিশনারীরা এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। অনেকটা এই সময়েই সিরাজগঞ্জের সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর আবির্ভাব হয় মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত হিসাবে। সিরাজীর পর তাঁর অভিভাবকত্বে জন্ম হয় বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলামের। এর পর আর বাংলা সংস্কৃতি অঙ্গনে মুসলমানদের অগ্রগতির পথে কোনো বাধা থাকে না।

কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা, সঙ্গীত, নাটক প্রভৃতি শিল্পকলার সকল ক্ষেত্রেই বিপ্লবী অবদান রেখে বাঙ্গালী মুসলমানের উন্নতির ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রাখেন। সেজন্য তাকে আমরা আজ যে স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক, নজরুল ইসলামকে সে স্বাধীন বাংলাদেশের সংস্কৃতিক জনক হিসাবে জাতীয় কবি আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়েছে।

সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের এ অনন্য অবদানের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নবাব সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শাহ আজিজুর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ প্রবীণ ও নবীন উভয় পর্যায়ের নেতৃত্বাধীন পৌনে দুইশত বছরের বৃটিশ শাসনের অবসানে প্রথমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান নামে যে প্রদেশের সৃষ্টি হয়, তারই সর্বশেষ রূপান্তর ঘটেছে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে।

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর থেকে শুরু করে প্রথমে সা¤্রাজ্যবাদী বৃটেনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হিসাবে এবং পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে যে স্বাধিকার চেতনার জন্ম হয় তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পশুবলে ধ্বংস করে দিতে অপচেষ্টা চালালে সে চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ মরণপণ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জনগণের সকল অংশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংগ্রামের ফলে এককালের সেই পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানই মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আজ বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র নামে বিশ্ব মানচিত্রে পরিচিতি লাভ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস অনুধাবন না করে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন বা উন্নত ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করা কিছুতেই সম্ভব নয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাধীন


আরও
আরও পড়ুন