পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের মানুষ যে এখন নিদারুণ পেরেশানিতে রয়েছে, তা প্রতিদিনের পত্র-পত্রিকায় তাদের জীবনের টানাপড়েনের চিত্র দেখে বোঝা যায়। চরম দুর্ভোগের মধ্যে তাদের দিন কাটছে। বিভিন্ন যাতাকলে পিষ্ট হয়ে তাদের জীবনযাপন দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। দেশ উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে অবস্থান করছে। অথচ গত সপ্তাহে একটি পত্রিকা দেশের বর্তমান অর্থনীতির চিত্র তুলে ধরে দেখিয়েছে, অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নমুখী। আমদানি, রফতানি থেকে শুরু করে অর্থনীতির মূল খাতগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। প্রতিবেদনে যেসব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে, তাতে উন্নয়নের হাড়গোড় বের হয়ে পড়েছে। জোয়ারের পর পানি নেমে গেলে যেভাবে মাটির জীর্ণশীর্ণ দৃশ্য ফুটে ওঠে, অনেকটা তেমন। বৃহৎ পরিসরে অর্থনীতির যখন এই দুর্দশা, তখন এর প্রভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে যে পড়েছে তাতে সন্দেহ থাকার কারণ নেই। তবে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনীতির এই দুর্দশা স্বীকার করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। কেউ নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না। তবে বাইরের মানুষের চোখে তা ধরা পাড়ে। অর্থনীতি যে একটা চরম খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা ওয়াচ ডগ হিসেবে পত্র-পত্রিকা ও অর্থনীতিবিদদের চোখে তা ধরা পড়ছে। কেউ বলে, কেউ বলে না। বলতে গেলে সরকারের বিরূপ আচরণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ দেশে বাকস্বাধীনতা সংকুচিত অবস্থায় রয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন আর্টিক্যাল-১৯ তার বিশ্ব মত প্রকাশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মত প্রকাশের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থা নিম্ন অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ মত প্রকাশ করতে গেলে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এ অবস্থায় পত্র-পত্রিকাগুলো অনেকটা সেল্ফ সেন্সরশিপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও মাঝে মাঝে কোন কোন পত্রিকা তথ্য-উপাত্তসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের প্রকৃত চিত্র তুলে আনে। বছর খানেক আগে একটি পত্রিকা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছে, রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় গরিব লোকের সংখ্যা বাড়ছে। জেলাগুলো হচ্ছে, কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। এর মধ্যে আবার কুড়িগ্রামে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭১ জনই গরিব। অথচ সরকার স্পষ্ট করেই বারবার বলেছে, উত্তরবঙ্গে মঙ্গা বলে কিছু নেই। পত্রিকাটি বছরওয়ারি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছে যে, জেলাগুলোতে প্রতি বছরই গরিব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশে দরিদ্র সংখ্যা আরও বেশি। সংখ্যাটি ৫ থেকে ৬ কোটি হবে। অর্থাৎ দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষ দরিদ্র রয়ে গেছে। এর মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার দেশের উন্নতি দেখছে ধনীদের উন্নতির সূচক দিয়ে। জিডিপির প্রবৃদ্ধিও দেখাচ্ছে ধনীদের আয় ও সম্পদ দিয়ে। এই জিডিপির মধ্যে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের সব মানুষের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ আয় করে ১০ শতাংশ ধনী মানুষ এবং বেশির ভাগ সম্পদই তাদের অধীনে। অর্থাৎ সরকার দেশের উন্নয়ন দেখাচ্ছে ধনীদের আয় ও উন্নতির সূচকের মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ পড়েছে বিপাকে। কারণ সরকার তাদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করছে না। সরকারের উন্নয়নের সূচক দেখানোর দরকার তা দেখিয়ে দিচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ অর্থনীতির দুরবস্থাকে যে দুঃস্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেবে, তার কোন জো নেই। তারা ঘুমেও দুঃস্বপ্ন দেখছে, বাস্তবেও তার মুখোমুখি হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এখন মানুষের কাছে খরচ কমানো অটোমেটিক চয়েস হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষকে বাধ্য হয়ে খরচ কমাতে হচ্ছে এবং তারাই বেশি দুঃসময়ের শিকার।
দুই.
যে কোনো সরকারের জন্য একটানা ক্ষমতায় থাকা বিরাট সৌভাগ্য এবং চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। অতীতে আইয়ুব খান একনাগাড়ে দশ বছর ছিলেন। একনায়ক শাসকরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে মানুষকে উন্নয়নের কথা শোনায়। এরশাদ ও আইয়ুব খান তেমনটি করেছিলেন। আইয়ুব খান উন্নয়নের দশকপূর্তি উৎসব করেছিলেন। গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা বঞ্চিত মানুষ আইয়ুব খান ও এরশাদের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মেনে না নিলেও তারা সহ্য করেছিলেন। অবশ্য তাদের মধ্যে এই সান্ত¦না ছিল, তারা স্বৈরাচার, তারা এমন করতেই পারে। তবে গণতান্ত্রিক কোনো রাজনৈতিক দল যদি এমন আচরণ করে, তবে তাদের দুঃখের সীমা থাকে না। বর্তমান সরকারও দেশের মানুষের সামনে উন্নয়নের ব্যাপকতা তুলে ধরছে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে-এ কথা বারবার বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার যেভাবে উন্নয়নের জোয়ার তুলছে, সেভাবে হচ্ছে কিনা? গণতন্ত্র, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বজায় থাকলে যে হারে উন্নয়ন হওয়ার কথা, তা হচ্ছে কিনা? কিংবা এসব দমিয়ে যে গতিতে উন্নয়ন হওয়ার কথা, সে গতি পাচ্ছে কিনা? এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব দেয়া মুশকিল। সরকারি দল নিশ্চিতভাবেই বলবে, যেভাবে উন্নতি হওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি হয়েছে। এর বিপরীতে সরকারের বাইরে যারা রয়েছে এবং নির্মোহভাবে যারা বিচার করেন, তারা বলবেন দশ বছরের সময়কালে যেভাবে উন্নতি হওয়ার কথা, সেভাবে হয়নি। অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্নীতি, একশ্রেণীর মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়া প্রবণতা বড় হয়ে উঠেছে। অনেকেরই ধারণা, সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উন্নয়নকে কাগজে-কলমে বেশি দেখানো যার সাথে বাস্তবতার যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশ যে স্বল্প উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে, তা আরও পাঁচ বছর আগে দেখালেও এমন কোনো হেরফের হতো না। এ ঘোষণা দেয়ার পর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সাধারণ মানুষের জীবনমান যে রাতারাতি বদলে গেছে, এমন মনে করার কারণ নেই। অবশ্য সরকারকে এ ঘোষণা দিতেই হতো। তা নাহলে দশ বছরে সে কি উন্নয়ন করল তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়া স্বাভাবিক। সরকারকে দেখাতে হবে, সে ব্যাপক উন্নয়ন তো করেছেই এবং বাংলাদেশও ধনী হয়েছে। এখন দেখা যাক, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে হলে কী শর্ত পূরণ করতে হয়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উন্নয়ন নীতিবিষয়ক কমিটির (সিডিপি) শর্ত অনুযায়ী মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, এই তিনটির যে কোনো দুইটির নির্ধারিত পয়েন্ট অর্জন করলেই উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি লাভ করা যায়। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তিনটি শর্ত পূরণ করেছে বলে দেখানো হয়েছে। ফলে আমরা উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি এবং তা পরবর্তী ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাব। বলা বাহুল্য, এসব সূচকের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়, তা সাধারণত সরকারের দেয়া পরিসংখ্যানের ওপরই সিডিপি নির্ভর করে। আমরা জানি, কোনো সরকারই পরিসংখ্যানে তার উন্নয়নের চুল পরিমানও কম দেখায় না, বরং যতটা সম্ভব বাড়িয়েই দেখায়। এ প্রেক্ষিতে, সরকার তার মতো করে উন্নয়নের সূচক দেখিয়েছে এবং তা মেনে সিডিপি উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি দিয়েছে। পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। তবে বাস্তব চিত্র কি, তা সাধারণ মানুষের চেয়ে ভাল আর কে জানে? সে কেবল দেখছে, জিনিসপত্রের দাম তার সাধ্যের মধ্যে নেই। গত সপ্তাহে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন পণ্য কেনা বিক্রি কমে গেছে। তার অর্থ হচ্ছে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের মানুষের বড় একটি অংশের কাছে বাড়তি অর্থ খরচ করার মতো টাকা নেই। অথচ সরকার বলছে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে। আমরা যদি মাথাপিছু আয়ের কথা ধরি, তবে দেখা যাবে তা শুভংকরের ফাঁকির মধ্যে রয়েছে। এখন মাথাপিছু আয় ১৯০৯ ডলার। পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারের মাথাপিছু আয় যদি ১৯১৯ ডলার ধরা হয়, তবে এই পরিবারের মাসে আয় দাঁড়ায় (এক ডলারের ৮৫ টাকা মূল্যমান ধরে) ১ লাখ ৬২ হাজার ২৬৫ টাকা। এখন এমন আয়ের পরিবার বাংলাদেশে কয়টি আছে, তা হিসাব করা পাঠকের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। আবার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৯০ ভাগই রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে কম মানুষের কাছে। তাহলে সরকারের মাথাপিছু এই আয়ের হিসাবটি কি সঠিক? এখন সরকার যদি এই ১০ শতাংশ মানুষের উন্নতিকেই গোটা বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হিসেবে ধরে নেয় তবে কিছু বলার নেই। অবশ্য সরকার তার উন্নয়ন দেখাতে এ ঘোষণা দিতে পারে। যদি চার হাজার ডলারও ঘোষণা করে দেয়, তাতেও কিছু আসবে যাবে না। কারণ এ আয়ের চেয়ে বেশি আয় হয় ঐ ১০ শতাংশ মানুষের। এদের আয় ধরে যদি মাথাপিছু আয় ঘোষণা করা হয় তবে তা কে হিসাব করতে যাবে? দারিদ্র্যতার হিসাবের বিষয়টিতেও এমন ফাঁকফোকর রয়েছে। দরিদ্ররা তো পরিশ্রম করে হলেও কিছু আয় করে, বেকারদের তো সেই সুযোগও নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ৬ কোটির বেশি। এদের মধ্য থেকে কর্মে যোগদানের হার খুবই কম। তাছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রের দুর্দশার চিত্র নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। গত সপ্তাহে একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখন প্রায় আড়াই কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারে না। সুষম খাবার কেনার সামর্থ্য দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের নেই। এখন সরকারের কথা মতো দেশ যদি উন্নয়নের জোয়ারে ভাসে, তাহলে কোটি কোটি মানুষ কেন অপুষ্টিতে ভুগবে এবং বেকার থাকবে? সরকার বলতে পারে, এসব প্রতিবেদন নিছকই সরকারের বিরোধিতা করার জন্য করা হয়েছে। সরকারের ভাল চায় না বলে, এসব অপপ্রচার করা হচ্ছে।
তিন.
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারের দশ বছরের শাসনামলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যেভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেভাবে পায়নি। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ও আমদানি-রফতানির চিত্র দেখলেই তা বোঝা যায়। সরকার তা স্বীকার করবে না, এটাই স্বাভাবিক। স্বীকার করার অর্থ ব্যর্থতা। সরকার কেন ব্যর্থ হতে চাইবে? সে দেখাবে এবং বলবে, দেশ শনৈশনৈ উন্নতি করছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলেন, সুশাসন এবং যথাযথ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বা এর যে মৌলিক বিষয়, সেগুলো পেছনে ঠেলে সরকার কেবল উন্নয়নকে আঁকড়ে ধরেছে। যদি সুশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন চলত, তবে সরকার যে উন্নয়নের কথা বলছে, তা যথার্থ ও টেকসই হতো। এর সুফল কম-বেশি সবাই পেত এবং হঠাৎ করে অর্থনীতির মন্দার চিত্র প্রকাশিত হতো না। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনীতি সুষমভাবে এগুচ্ছে না। একটি শ্রেণী দুর্নীতি ও অসৎ উপায়ে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে এবং বিদেশে টাকা পাচার করে দিচ্ছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ কেবল পিছিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। তার প্রতিক্রিয়া এখন ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষের চিরায়ত চাওয়াই হচ্ছে, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে সমান তালে এগিয়ে নেয়া। তা নাহলে যে উন্নয়ন হয়, তাতে জবাবদিহিতা থাকে না, টেকসইও হয় না। উন্নয়নমূলক যেসব প্রকল্প ও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, সেগুলো কতটা টেকসই হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের সব মত-পথের মানুষকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারলে তার সুফল খুব কমই পাওয়া যায়। আইয়ুব খানের আমলেও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। তাতে মানুষ খুশি হতে পারেনি। এর কারণ, তার শাসনের ধরন এবং আচরণ মানুষ পছন্দ করেনি। তারাই পছন্দ করেছিল, যারা সরকারকে টিকিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পেরেছিল। সরকারও তাদের এন্তার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। এ সরকারের সময়ও এমন একটি প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিরোধী মত দমনে রাষ্ট্রের যেসব ইন্সট্রুমেন্ট যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য যেসব বাহিনী রয়েছে, তাদের সুযোগ-সুবিধা শত গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এদের অসামান্য উন্নতি হয়েছে। সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস, এসব রাষ্ট্রযন্ত্র তার পক্ষে থাকলে অন্য কারো পক্ষে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব হবে না। আর জনগণের পক্ষে কথা বলার রাজনৈতিক দল ও মতকে যদি দমিয়ে রাখা যায়, তবে জনগণেরও কথা বলার সুযোগ থাকবে না। বরং নিজেদের কথা জনগণের বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। আর সরকারকে ঘিরে গড়ে ওঠা স্বার্থেন্বেষী মহলও তার গুণগান গাইছে। কেউ কেউ সরকারকে বোঝাতে চাচ্ছে, বিশ্বে গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়ছে, কাজেই সরকার যেভাবে দেশ চালাচ্ছে, এটাই ঠিক আছে। তারা এ উদাহরণ দিয়ে বলছেন, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া এভাবেই উন্নতি করেছে। তারা এ কথা বলছেন না, এ দুটি দেশ বিগত দশ বছরে যে হারে উন্নতি করেছে, বাংলাদেশ তার ধারে কাছে আছে কিনা। তারা এটা ভাবেন না, ঘোড়ার গাড়ির সাথে সুপার সনিক বিমানের তুলনা চলে না। আমাদের দেশের গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রকামী মানুষের সাথে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের তুলনা করার অর্থই হচ্ছে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। আমাদের দেশকে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, আইনের শাসনকে ধারণ করেই দেশ পরিচালনা ও উন্নতি করতে হবে। এসব স্তব্ধ করে বা মানুষকে অসন্তুষ্ট রেখে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। যদি তাই হতো, তবে আইয়ুব খান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেই জনগণ চিরকাল ক্ষমতায় বসিয়ে রাখত। এতো আন্দোলন করত না, জীবনও দিত না।
চার.
নিজের উন্নতি চায় না, এমন একজন মানুষও পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়ন স্পৃহা আকাশ ছোঁয়া। উন্নতির জন্য তারা দিনরাত পরিশ্রম করে। তাদের এই উন্নতির আকাক্সক্ষাকে যে সরকার ধরতে পারবে, তার সাফল্য অবশম্ভাবী। যদিও ক্ষমতাসীন দল প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে, কেবল তারাই দেশের উন্নয়ন করেছে। অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিল, সে সময় কিছুই হয়নি এবং তারা নিজেদের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি তাই হয়, তবে বাংলাদেশ যে স্বল্প উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পা দিয়েছে, এটা কি শুধু এই সরকারের কারণেই হয়েছে? অতীতের সরকারগুলোর কি কোনোই অবদান নেই? বাস্তবতা হচ্ছে, একটি দেশ হুট করেই উন্নতি করে না। উন্নতি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ও কার্যক্রম। অনেকে বলেন, এ সরকারের আমলে ব্যাংক লুটসহ আর্থিক খাতে যে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও পাচার হয়েছে, তা যদি না হতো এবং গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সুশাসন মানসম্পন্ন অবস্থায় থাকত, তাহলে সার্বিক অর্থনীতি মন্দাবস্থায় থাকত না। সাধারণ মানুষের কষ্টে জীবনযাপন করতে হতো না। উন্নয়নের সুষম অবস্থা বজায় থাকত। বিনিয়োগে মন্দাবস্থা, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠিত কল কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, টাকার মান কমে যাওয়া, মানুষের জীবনযাপনে টানাপড়েন সৃষ্টিসহ নানা সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিত না। জীবনযাপন করতে গিয়ে মানুষের সঞ্চিত অর্থ নিঃশেষ হয়ে যেত না। আয়ের সাথে ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না। সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের এই কষ্টের জীবন সম্পর্কে কি সরকার জানে?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।