১
কাশ্মীরে সশস্ত্র পন্থার শুরু হয় ১৯৮৮ সালে। এর আগে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছিল। পাকিস্তানের পতাকা উঠিয়ে ‘তেরি জান, মেরি জান/পাকিস্তান পাকিস্তান’ শ্লোগানও হয়েছে। এখনও মাঝেমধ্যে হয়। কিন্তু, সশস্ত্র পন্থা ছিল না। ১৯৫৩ সালে শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেপ্তারের পর তার দল ন্যাশনাল কনফারেন্সকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরে শেখ-এর এক সাগরেদ মির্জা আফজাল বেগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গণভোটের দাবিতে পিলবিসাইট ফ্রন্ট। ১৯৬৪ সালে শেখকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তান পাঠিয়েছিলেন নেহরু। উদ্দেশ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে শেখের উদ্যোগে আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার একটা সমাধান হবে। কিন্তু, যখন শেখ পাকিস্তানে পেঁৗঁছালেন তখনই নেহরু মারা গেলেন। আলোচনা ভেস্তে গেল। এরপর থেকে শেখও গণভোটের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। এরই মধ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলো ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর নিয়ে। তাসখন্দ ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধ থামল। আবদুল্লাহ তখনও আশা করেছিলেন গণভোট পাবেন। কিন্তু পাননি। বরং নিক্ষিপ্ত হয়েছেন জেলে।
১৯৭১ সালে শুরু হলো বাংলাদেশ যুদ্ধ। শেখ আবদুল্লাহ লিখেছেন, ‘১৯৭১-এ যুদ্ধের মাধ্যমে দুর্র্ভাগ্যজনকভাবে সকল উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেল’। শিমলায় চুক্তি হলো ১৯৭২-এর। তাতে বলা হলো, দুই দেশ তাদের মধ্যকার বিভেদগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে ‘দ্বিপক্ষীয়ভাবে’ অথবা ‘দুই পক্ষের ঐক্যমতে অন্য কোনোভাবে সমাধান করবে। কিন্তু সমাধান হলো না। বরং, ভারতীয় রাজ্য হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরে ভোটের ঘোষণা দিলেন ইন্দিরা গান্ধী। শেখ আবদুল্লাহর দল তখনও নিষিদ্ধ। তাই তারা প্রতিদ্ব›িদ্বতা করতে পারেনি। ইন্দরা গান্ধীর তত্ত¡াবধানে সরকার গঠন করল কংগ্রেস। আবদুল্লাহ দিল্লিকে জানালেন, ‘ভারতে যোগ দেওয়া নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। আমি শুধু চেয়েছিলাম ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩৭০ (স্বায়ত্তশাসন) তার মূল অবস্থায় বহাল থাকুক। ১৯৭৫ সালে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কাশ্মীর অ্যাকর্ড স্বাক্ষর করলেন। আবদুল্লাহ নতুন নির্বাচন চাইলেন। ইন্দিরা ছিলেন ‘অনাগ্রহী’ তিনি কংগ্রেসের সংসদীয় কমিটির মিটিংয়ে আবদুল্লাহকে টেকনোক্র্যাট হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বানালেন। আবদুল্লাহ বলছেন, ‘আমি সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছিলাম, কিন্তু দ্রæতই আমাকে অনুতপ্ত হতে হয়েছিল। পরে ১৯৮২ সালে নির্বাচন হয় রাজ্যে। আবদুল্লাহ এবার বিজয়ী হন। তার ন্যাশনাল কনফারেন্স পুনরায় চালু হয়। বলা হয়ে থাকে কাশ্মীরের ইতিহাসে এই হচ্ছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ১৯৮৩ সারে আবদুল্লাহ মৃত্যু হলো। তার ছেলে ফারুক আবদুল্লাহ হন মুখ্যমন্ত্রী। মনে করা হচ্ছিল ভারতবিরোধিতা চুপসে গেছে। দিল্লির ইচ্ছায় চলছে সবই। আবদুল্লাহ পরিবারও দিল্লির অধীনে ভালভাবেই চালাচ্ছে কাশ্মীর। এরপরই হঠাৎ সব গোলমেলে হয়ে গেল। ঘরে ঘরে যুবকেরা তুলে নিল অস্ত্র।
শান্তি অধ্যয়নের প্রতিষ্ঠাতা ইয়োহান গালটুংসহ গবেষকরা কোনো সংঘাতের তিন ধরনের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। ১. মূল কারণ ( জড়ড়ঃ পধঁংব), ২. প্রভাবক কারণ (অপপবষবৎধঃরহম ঈধঁংব) ও ৩. বিস্ফোরক কারণ (ঞৎরমমবৎ ঈধঁংব)। যে কোনো সংঘাত নিরসনে এই কারণগুলো সুচিহ্নিত করা জরুরি। ব্রিটিশ ও মহারাজার ভূমিকা, পাক-ভারত দ্ব›দ্ব-যুদ্ধ এবং ১৯৮৭-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অসচ্ছতা-এগুলো কাশ্মীর সমস্যার মূল কারণ। ক্রমে সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া, কাশ্মীরি নেতাদের সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের আস্থার সংকট, পাকিস্তানাইজেশন, কাশ্মীরিদেরকে নিয়ন্ত্রণের ভারতীয় প্রচেষ্টা আর আইনের শাসন দিতে অসামর্থ্যতা-ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হওয়ার প্রভাবক কারণ। এসব কারণ ক্ষোভ বৃদ্ধি করেছে। সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য এগুলোর অবসান দরকার। কিন্তু, হাজার হাজার যুবকের হঠাৎ করে সশস্ত্রপন্থা গ্রহণের কারণ এগুলো নয়। এর বিস্ফোরক কারণটি হলো, ১৯৮৭ সালের নির্বাচন। ওই নির্বাচনটিতে ব্যাপকমাত্রায় কারচুপি হওয়ার পরই বিরোধী মহল ব্যালটের প্রতি আস্থা হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বুলেট আর বন্দুকের ছায়ায়। নির্বাচনটি সম্পর্কে কাশ্মীরি সাবেক জেলা জজ ও লেখক জিএন গওহর মন্তব্য করেছেন, ‘চরমতম জোচ্চুরি,’ যা ব্যাখ্যা করার জন্য ‘রিগিং শব্দটি খুবই সংকীর্ণ। ওই নির্বাচনে রাজিব গান্ধীর সঙ্গে ফারুক আবদুল্লাহর একটি ‘সমঝোতা’ হয়েছিল বলে জনগণ বিশ্বাস করে। তাতে ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিরোধী সকল পক্ষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রণ্ট (এমইউএফ) নামে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছিল। তারা ৭৫টি আসনের মধ্যে মাত্র পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। পরে, নির্বাচনে কারচুপি অভিযোগে তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে। এরপরই ইয়াসিন মালিক, মকবুল ভাইসহ চার-পাঁচজন যুব নেতা জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রণ্ট (জেকেএলএফ)-এর ব্যানারে সশস্ত্র পথে ছুটে যায়। জিএন গওহর লিখেছেন, ‘নির্বাচনটি কাশ্মীরিদের এমন একটা ধারণা দিয়েছিল যে শাসক নির্ধারণে তাদের কোনো অধিকার নেই। এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে যুবকরা সীমান্তের ওপারে ছুটে যাওয়া ছাড়া’ আর কোনো উপায় খুঁজে পায়নি। সশস্ত্র বিদ্রোহ তখন একটা ‘কালচার’ হয়ে দাঁড়ায়। ‘গানকালচার’। প্রতিবাদ ‘পাথর গ্রেনেড দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়’। ‘কাংড়িগুলো (উষ্ণ কয়লাভর্তি মাটির পাত্র) মিসাইলে রূপ নেয়’।
২
এই চরমপন্থার রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াও ছিল বন্দুক। বন্দুকের বিরুদ্ধে বন্দুক। সহিংসতার বিরুদ্ধে সহিংসতা। মহারাজার ভারতে যোগদানের শর্তে প্রথম ভারতীয় সৈন্যবাহিনী শ্রীনগরে পৌঁছেছিল ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর। পরে ১৯৫০ সালে অভ্যন্তরীণ আইনÑশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কেন্দ্রীয় আধাসামরিক সিআরপিএফ ব্যাটালিয়ন কাশ্মীরে যায়। ১৯৮৯ সালে বিদ্রোহ বেড়ে উঠলে ব্যাটালিয়নের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৯২ সাল নাগাদ ১২৯টি কোম্পানি সেখানে নিযুক্ত হয়। সম্প্রতি সেখানে ৪৭টি ব্যাটালিয়ন অবস্থান করছিল। গত ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সময়ে চলমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আরও ১০২টি কোম্পানি পাঠানো হয়। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে ইন্টারন্যাশনাল পিপলস ট্রাইব্যুনাল কাশ্মীর (আইপিটিকে) এবং এসোসিয়েশন অব প্যারেন্টস অব ডিসএপিয়ারড পারসনস (এপিডিপি) যৌথ উদ্যোগে মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করে। সে অনুসারে, এখনও ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিএসএফ, ইন্দো-তিব্বটিয়ান বর্ডার ফোরস (আইটিবিএফ), সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ), এবং জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ ফোর্স মিলে মোট নিয়োজিত সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৬৩৮ থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার ৯৮১ জনের মতো। সে হিসেবে পুরো রাজ্যে গড়ে প্রতি ১৬/১৭ জনে একজন করে নিরাপত্তারক্ষী নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু, তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। বন্দুকের ব্যবহার কমলেও চরমপন্থা বেড়েছে। একজন ভারতীয় সেনা কমকর্তা একবার বলেছিলেন, ‘সৈন্যরা চরমপন্থীকে হত্যা করতে পারে কিন্তু চরমপন্থা হত্যা করতে পারে না’।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সশস্ত্র পন্থায় গিয়ে কাশ্মীরিদের কেমন মূল্য দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। নিহতের পরিসংখ্যান এখানে লেখা জরুরি নয়। তাছাড়া, পরিসংখ্যান নিয়ে রাজনীতি হয় সবচেয়ে বেশি। সংখ্যার চেয়ে গভীরতা অনুভব করাই শ্রেয়। তেমনই কিছু তথ্য তুলে ধরা যাক এবার।
১৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে। বারামুলা জেলার সোপুর এলাকার ঘটনা। মাগরিবের নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বেরিয়েছেন বশির আহমেদ। তিনি ৯০ দশকের শুরুতে ছিলেন হিজবুল মুজাহিদীনের যোদ্ধা। গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছিলেন তিন বছর। তারপর, জঙ্গি রাস্তা ছেড়ে গৃহস্থালিতে মন দিয়েছেন দেড় দশক আগে। বিয়ে করেছেন। ছেলে বুরহান তিন বছর পেরিয়ে স্কুলে যায়। স্ত্রীর কোলে ১৫ মাসের মেয়ে ‘হুরাইন’। ছেলেকে কোলে নিয়ে বশির যাচ্ছিলেন দোকানে। গ্রামের মধ্যেই, সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে অজ্ঞাতপরিচয় মোটরসাইকেল আরোহী গুলি করল বশিরকে। স্পটডেড! কোলে থাকা শিশু বুরহান কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় গুলি। শিশুটির তলপেটে ফেটে গিয়েছে। হাসপাতালে নেয়া হলো। রাতভর অপারেশন হলো। ডাক্তার বললেন, স্যরি!
স্বাধীনতার এক অদ্ভুত চেতনায় অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন বশির আহমদ আড়াই দশক আগে। ফের জীবনের টানে অস্ত্র ফেলে স্বপ্ন দেখলেন তিনি। ছেলের বাবা হলেন। মাটিতে মিশে গেল সব আশা। বাবার দাফন হয়েছে শুক্রবার। পরের দিন সন্তানের জানাজা হলো। স্কুলের শিশুরা তাদের বন্ধুর জানাজায় এসে হাজির হয়েছে দলবেঁধে। বশিরের ভাই খবরের কাগজকে জানায়, এর আগে মেজো ভাইকে হারিয়েছে তারা। তার নাম ছিল ফেরদৌস। অনেক দিন ছিল নিখোঁজ। খবর পেয়েছিল, রাজৌরির এক ক্রসফায়ারে তার মৃত্যু হয়েছে। একই পরিবারের দু’ভাই আর ছোট্ট ছেলে বুরহান হারিয়ে গেছে বুলেটের ঘায়ে। বাকি দু’ভাই এখন কী করবে? মৃত্যুর প্রস্তুুতি নেবে? নাকি স্বপ্ন দেখবে বেঁচে থাকার? এই দ্বিধা কাটছে না। কাশ্মীরে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, এখানে কে কাকে হত্যা করে তা কেই জানে না। বিশ্লেষকরা বলেন, এহলো একটি সীমিতমাত্রার যুদ্ধক্ষেত্র (খড়ি রহঃবহংরঃু ধিৎ ুড়হব)। এখানে যুদ্ধ ও চলছে জীবনও চলছে। মানুষের মৃত্যু সেখানে রুটিনাইজড।
এই লেখক কাশ্মীর পৌঁছে ৬ জুন, ২০১৪ তারিখে। এর তিন দিন পরই কাশ্মীরে হিজবুল মুজাহিদীনের এক কমান্ডার ক্রসফায়ারে মারা যান। ওই কমান্ডার নিহত হওয়ার কয়েক মাস আগে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। এমএ প্রথম বর্ষ শেষ করে সে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যায়। ২৫ শে ফেব্রæয়ারি, ২০১৫ নিহত হওয়া আরেক তরুণ সোপিয়ান জেলার আশিক হোসেন দার। তুর্কিওয়াঙ্গাম গ্রামের ওই যুবক সেদিন প্রত্যুষে নিহত হন হেফ গ্রামে সংঘটিত এক ক্রসফায়ারে। ২০১৪ সালের মে মাসে সে ভিলেজ লেভেল ওয়ার্কারের চাকরিতে যোগ দিয়েছিল। তিন মাস পরই সে যোগ দেয় হিজবুল মুজাহিদীনে। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ও বিএড পাস করা ওই যুবক শিক্ষা বিভাগ, রেভিনিউ, সিপিএডি ও হর্টিকালচার বিভাগে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে প্রত্যেকটিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু, এসবের চেয়ে সশস্ত্র পথ তার কাছে আকর্ষণীয় হলো। সেখানেই ক্ষয়ে গেল তার জীবন। এই ঘটনার দুদিন আগে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উচ্চশিক্ষিত তরুণদের জঙ্গি দলে যোগদানের প্রবণতা খুবই ভয়াবহ ও উদ্বেগের বিষয়।
৩
এগুলো বিচ্ছিন্ন, আবার অবিচ্ছিন্ন ঘটনা। এগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, গালকালচার কমে গেলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। ভারতীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে গোটা জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরে এখন সশস্ত্র বিদ্রোহীর সংখ্যা দুইশ’-চারশ’র মতো। এ থেকে উপলব্ধি করা যায়, সশস্ত্র গ্রæপে সশরীরে যোগ দেওয়া মিলিট্যান্টের সংখ্যা হয়তো কমে গেছে। কিন্তু, ভারতের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ মানুষের সংখ্যা কমেনি। নিহত জঙ্গির প্রতি সমবেদনাও সমর্থন জানানোর মানুষের সংখ্যাও কম নয়।
সাম্প্রতিক সময়ের আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, একবার জানা গিয়েছিল, ইদানীং মিলিট্যান্সিতে যোগদানের জন্য প্রথম শর্ত হলো, সরকারি বাহিনীর কোনো সদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করতে হবে। এবং, প্রায়ই খবরের কাগজে পুলিশের অস্ত্র ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যায়। আরও লক্ষণীয়, ইদানীংকালের নিহত হওয়া মিলিট্যান্টদের অধিকাংশই এক বছর বা দুই বছর আগে যোগ দিয়েছে। কেউবা মাত্র ছয় মাস আগে যোগ দিয়েছে। অর্থাৎ তারা পুরনো বা অভিজ্ঞ মিট্যিান্ট নন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ওই সব নতুন বিদ্রোহী লাইন অব কন্ট্রোল পেরিয়ে ওপারে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসার খবর তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া, আগের মতো প্রকাশ্য সহায়তা পাকিস্তানের ওপাশ থেকে এখন দেওয়া হয় না। ভারতীয় প্রহরাও বেশ কড়া বলে জানা যায়। ফলে, অনুমান করা যেতে পারে যে, ওই সব মিলিট্যান্ট ভারত শাসিত জেঅ্যান্ডকের মধ্যে কোথাও ট্রেনিং নেয়। দক্ষিণ কাশ্মীরের ত্রাল এলাকার পাহাড়ি জঙ্গলে বুরহান মুজাফফার ওয়ানি (৮ জুলাই, ২০১৬ তারিখে নিহত) প্রায় ছয় মাস ধরে অবস্থান করেছেন। উল্লেখ্য, ত্রাল এলাকাটির সঙ্গে পাকিস্তান সীমান্তের কোনো সংযোগ নেই। সেখানকার জঙ্গলে বসে সশস্ত্র ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করেছেন বুরহান। আর সেসব ছবি দেখে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় ‘বুরহান ভাই আগে বাড়ো, হাম সব লোক তোমহারা সাথ হ্যায়’-এমন শ্লোগান হয়েছে। এসব বিষয়ের কারণে কাশ্মীরের মিলিট্যান্সির বিষয়টিকে বেশ জটিল মনে হয়। তবে, সন্দেহাতীত বিষয় হলো, কাশ্মীরিদের ভারত-বিরোধীতা শতভাগ সমর্থন করে পাকিস্তান। যাই হোক, সংঘাতের কারণে মৃত্যুর আলোচনা চলছিল। বিষয়টির বর্তমান অবস্থা বুঝতে খবরের কাগজে আসা নিহতের সংখ্যার একটি টালি করেছিলাম এক মাসের জন্য। সে অনুসারে সেপ্টেম্বর (২০১৫) কাগজে প্রকাশিত অপমৃত্যুর মোটসংখ্যা ২৯। এরমধ্যে ১৬ জন সশস্ত্র বিদ্রোহী। পাঁচজন নিরস্ত্র নাগরিক, দুজন শিশু, পাঁচজন সৈন্য বা পুলিশের সদস্য। একজনের মৃত্যু হয়েছিল সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে গুলিবিনিময়ে। ওই মাসটি হলো তুলনামূলক একটি স্বাভাবিক মাস সেখানকার।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা রাজ্য সরকারের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১২-২০১৫ সালের মধ্যে দুই লাখ ১৫ হাজার ১১০টি পরিবার সীমান্তে গোলাগুলির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর জম্মু এলাকার সীমান্তবর্তী ৪৪৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত। সীমান্তের ভারতীয় অংশে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখ। মোট গ্রাম ৫৯০টি। যার মধ্যে ৪৪৮টি হুমকির মুখে থাকে সবসময়। আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও লাইন অব কন্ট্রোলের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ভারতীয় অংশে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যা ৫ লাখ ৩২ হাজার ১৪৪ জন। কাঠুয়া, সামবা, জস্মু, পুঞ্চ, রাজৌরি এই পাঁচটি জেলা সীমান্ত বরাবর রয়েছে। হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল এক ডকুমেন্টারিতে সাফল্যের গল্প হিসেবে তুলে ধরেছিল গুলজার আহমেদ নামে এক বৃদ্ধকে। তিনি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে দুটি পা হারিয়েছিলেন। এখন কৃত্রিম পায়ের সাহায্যে হেঁটে বেড়ান। সংস্থাটির তথ্যমতে, ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ২০৬৪ জন।
৪
কাশ্মীর ভ্যালিতে ১৯৮৬ সালে একটি মাত্র এতিমখানা ছিল। এখন চলছে ৭ শতাধিক। কোনোটা ব্যক্তি উদ্যোগে, কোনোটা ট্রাস্ট, আবার কোনোটা রাজ্য চালিত। সেভ দ্যা চিলড্রেনের জরিপ অনুসারে ভ্যালিতে দুই লাখ ১৫ হাজার এতিম শিশু আছে, যাদের ৩৭ শতাংশ সংঘাতের কারণে মা-বাবা বা উভয়কে হারিয়েছে। ১৫ শতাংশের বেশি এতিম এতিমখানায় থাকে। বাকিরা কোনো সহায়তা ছাড়াই আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে থাকে। এদের বলা হয় অরফানস অব কনফ্লিক্ট। আরেকটি জরিপ অনুসারে, এতিমাখানার ৪০ শতাংশের বেশি শিশু নানা মানসিক সমস্যায় ভোগে, যা সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেই।
লক্ষণীয়, সেখানে সংঘাত শুরু হয়েছে তিন দশকের বেশি হলো। অর্থাৎ, এখনকার যুবকদের জন্ম এর মধ্যেই। এর মধ্যেই বেড়ে ওঠা তাদের। তারা শান্তির সময় দেখেনি। তাদের কাছে মৃত্যু স্বাভাবিক। যে কোনো সময় এখানে-ওখানে তাদের ভাই-বন্ধুর মৃত্যু হয়। সুতরাং, এই যুব সমাজকে গঠনমূলক সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া কিভাবে সম্ভব? এ নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। ভারতীয় সেনাদের ‘সম্ভাবনা প্রকল্প’ আছে। কাশ্মীর থেকে যুবকদের নেওয়া হয় শিক্ষা সফরসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সেই সুযোগগুলোকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা হয় সন্দেহের চোখে। জনগণের কাছে ওইসব সদ্ভাবনা প্রকল্প এখনও ‘বন্দুকের নলে গোলাপ-এর মতো।
শোপিয়ান জেলার এক যুবক যেমনটা বলছিল, সে রসায়ন শাস্ত্রে মাস্টার্স। তার বাবা নিহত হয়েছেন ১৯৯৫ সালে। বড় ভাই নিহত হয়েছেন, ১৯৯৬ সালে। পরিবারের সে সবার ছোট। তারা চার ভাই বেঁচে আছে। তাদের সংসার চলে আপেল বাগানে। বলছিল, ‘পরিস্থিতি আমাদের সবসময় টানে অস্ত্র তুলে নিতে।’
৮ ও ৯ আগস্ট, ২০১৫ কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় শিক্ষার্থীদের। আলোচনার বিষয় ছিল লিডারশিপ ও উদ্যোক্তা তৈরি। আলোচক প্রশ্ন করেছিলেন, লিডার শব্দটি শুনলেই আপনাদের সামনে কোনো ছবি ভেসে ওঠে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দর্শক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিল, গিলানী সাহাব। ওই অনুষ্ঠানে সরকারি প্রতিষ্ঠান জেঅ্যান্ডকে এন্টারপ্রেনরশিপ ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তা এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সবাইকে সরকারি চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। স্বাবলম্বী হওয়ার গুরুত্ব বর্ণনা করেছিলেন তিনি। এজন্য দ্বাদশ শ্রেণি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষিথ বেকার যুবকের সহজ শর্তে এত এত টাকা ঋণ দিচ্ছে সরকার-এ খবর দিলেন তিনি। যারা আগ্রহী তারা তাদের নিজস্ব উদ্যোগের পরিকল্পনা নিয়ে আসলেই ঋণ দেওয়া হবে।
এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা! আমি টাকা ঋণ নেবো। কাল আমি গুলি খেয়ে মরে গেলে আমার ঋণ কে পরিশোধ করবে? আমার নিরাপত্তা কী আপনার প্রতিষ্ঠান দেবে?’ এই প্রশ্নের কোনো জবাব সরকারের কাছে নেই। রাজ্য সরকার সেখানে বড় অসহায়। এই অসহায়ত্বের মধ্যেই বেড়ে উঠছে সেখানকার যুবসমাজ।
এত মন্দের মধ্যেও বেশ কিছু অবহেলিত ভাল খবরের সন্ধান মেলে আশাজাগানিয়া। যেমন, জায়েদের নামে এক যুবকের কাÐ। সে নিজের ঘরে বসে বিভিন্ন এনিমেটেড ভিডিও তৈরি করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়। তার ভাষায় এর উদ্দেশ্য হলো, ‘২৫ বছরের সংঘাত আমাদের দু:খী ও গোমড়ামুখো বানিয়েছে। আমি মানুষকে একটু হাসাতে চাই’। মানুষকে হাসানোর এই শখ থেকেই সে তৈরি করে ছোট ছোট কার্টুন ভিডিও। এটি সে করে কেবলই শখে। কোনো বাণিজ্যিক ব্যবস্থা ছাড়াই। ২০১৪ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নেতারা তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল ভিডিও বানিয়ে দিতে। তাতে রাজি হয়নি জায়েদ। এভাবে সাইথ কাশ্মীরে উবাইদ হায়দার নামে সপ্তম শ্রেণিতে পড়–য়া এক কিশোরের সন্ধান দিয়েছিল খবরের কাগজ। ওই কিশোর কাশ্মীরের প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত গোটা ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছে একটি বইয়ে যেটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। মোদ্দাকথা, কাশ্মীরে এখনও আপেল গাছে সাদা ফুল ফোটে বসন্তে। শীতের আগে, হেমন্তে, লাল আপেলের ভারে নুয়ে পড়ে সবুজ গাছ। বাক্স ভরে বিক্রি হয়। মানুষের হাতে আসে টাকা। গাছের পাতারা ঝরে পড়ে শীতে। তুষারপাত হয়। ন্যাড়া গাছেরা ফের সবুজ হয়ে জেগে ওঠার নিশ্চয়তা পায় প্রকৃতির কাছ থেকে। কিন্তুু, মানুষের জীবন চলে অনিশ্চয়তায়। এ অবস্থায়ও আশার কথা শুনিয়েছিলেন কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্তে¡র এক গবেষক। তিনি জানান, ‘উত্তর কাশ্মীরে (সোপুর) আমাদের গ্রামে প্রায় প্রত্যেক ঘরে কেউ না কেউ নিহত হয়েছে। আমার স্কুলজীবনের বন্ধুদের মধ্যে কেউ বেঁচে নেই। কারও মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছি। কেউ হয়েছে নিখোঁজ। একমাত্র আমি বেঁচে আছি। আমি ডক্টরেট করেছি। এখনও আমি আশা করি কাশ্মীর একদিন ফিরবে স্বাভাবিক অবস্থায়। হয়তো, শিগগিরই অথবা শতাব্দী সময় পর।’