সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ সংশোধনের দাবিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় দ্বিতীয় দিনের মতো বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন পরিবহন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের আকস্মিক এ ধর্মঘটে যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে খুলনা, মেহেরপুর, নড়াইল, নওগাঁ ও বরিশালে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল ১৮ নভেম্বর থেকে এ ধর্মঘট শুরু হয়।
এ বিষয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন_
খুলনা ব্যুরো জানায়, আজ সকালে খুলনার অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। এ সুযোগে মাহেন্দ্র, মিনি পিকআপ, মাইক্রোবাসসহ ছোট যানবাহনগুলোতে কয়েকগুণ ভাড়া দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে।
আন্দোলনরত চালকরা বলছেন, নতুন আইনে দুর্ঘটনার জন্য চালকদেরই দায় নিতে হচ্ছে। পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। চালকরা কাউকে ইচ্ছা করে হত্যা করে না। তারপরও তাদের শাস্তি হবে। এ আইন মেনে নেয়া যায় না। যার প্রতিবাদে এ কর্মবিরতি।
এদিকে, আজ মঙ্গলবার সকালে খুলনা মহানগরের সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল ও রয়্যালের মোড়ে ধর্মঘটের প্রথম দিনের মতো বাসগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। যাত্রীরা এসে বাস চলাচল সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিন্তু বাস চলাচল কখন শুরু হবে, কেউ তা বলতে পারছেন না।
মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তি জানান, তার স্বজনরা ওমরা হজের জন্য ঢাকায় যাবেন। যে কারণে তিনি রয়্যালের মোড় বাস কাউন্টারে এসে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু বাস ছাড়ছে না। কীভাবে যাবেন তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।
খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম বেবী বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের প্রতিবাদে শ্রমিকরা দ্বিতীয় দিনের মতো বাস চালাচ্ছেন না। তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি শুরু করেছেন। আইন সংশোধন না করা পর্যন্ত শ্রমিকরা ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন। গতকাল সোমবার দিনগত রাতে কিছু গাড়ি খুলনা থেকে ছেড়েছে আবার খুলনায় ঢুকেছে এমন প্রশ্নের উত্তরে বেবী বলেন, গতকাল ৯০ ভাগ বাস চলাচল বন্ধ ছিল। কিন্তু আজকে শতভাগ বাস চলাচল বন্ধ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনার এক পরিবহন মালিক বলেন, শ্রমিকদের এ ধর্মঘটের সঙ্গে আমরা শতভাগ একাত্মতা প্রকাশ করেছি। কেননা কোনো চালক ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটায় না। নতুন সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনা ঘটলে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা দিতে হবে। এত জরিমানা দেওয়ার মতো টাকা কোনো চালকের নেই। পাঁচ থেকে সাত দিন কাজ না থাকলে যে চালকদের ঘরে চুলা জ্বলে না, তাদের কাছে এত টাকা জরিমানা হাস্যকর।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, চালকের দায়ে ট্রেন দুর্ঘটনা হলেও সেখানে সরকার এক লাখ টাকা মৃত ব্যক্তির পরিবারকে দেয়। আর পরিবহন দুর্ঘটনা হলে একজন চালককে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা ধরা হয়েছে। যা কোনোভাবে ঠিক নয়।
বরিশাল ব্যুরো জনায়, পরিবহন ধর্মঘটের কারণে বরিশাল থেকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা। এতে তাদের বাড়তি ভাড়া দিয়ে অটোরিকশা অথবা মোটরসাইকেলে করে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
এদিকে শ্রমিকরা বলছেন, তাদের পক্ষে নতুন আইনের জরিমানা দেওয়া সম্ভব না। তাই তারা বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন।
বাসচালক বশির বলেন, নতুন সড়ক আইনে যে হারে জেল-জরিমানা বাড়ানোর হয়েছে। তাতে যানবাহন চালনা বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। দুর্ঘটনায় পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হলে সে টাকা দেওয়ার সাধ্য নেই। আর সাধ্য থাকলে অন্য পেশায় যেতাম, বাস চালাতাম না। কোনো চালকই দুর্ঘটনা হোক, এটা চান না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বরিশাল জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের
সাধারণ সম্পাদক ফরিদ হোসেন সরদার বলেন, আগামী ২২ নভেম্বর কেন্দ্রীয়ভাবে মিটিং আছে। কিন্তু তার আগেই শ্রমিকরা অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন।
মেহেরপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, ধর্মঘটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন জেলার সব মানুষ। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও চাকরিজীবীরা বেশি। তবে সড়কে আলগামন, নসিমন, করিমন ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ ছোট যানবাহন চলছে।
মেহেরপুর জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের
সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান বলেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইনে বড় ধরনের জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আর তাই আইন সংশোধনের দাবিতে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া, মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়কসহ জেলার সবরুটে বাস চলাচল বন্ধ রখেছেন শ্রমিকরা।
নড়াইল জেলা সংবাদদাতা জানান, নড়াইল-যশোর, নড়াইল-লোহাগড়াসহ অভ্যন্তরীণ পাঁচটি রুটে কোনো ঘোষণা ছাড়াই শ্রমিকরা বাস চলাচল বন্ধ দিয়েছেন। পূর্বঘোষণা ছাড়া বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় যাত্রীরা পড়েছেন চরম বিপাকে।
এদিকে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা করে গন্তব্যে পৌঁছাতে যাত্রীদের অতিরিক্ত টাকাসহ সময় ব্যয় হচ্ছে।
গত ১৭ নভেম্বর নড়াইল প্রেসক্লাবের সামনে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর জেল-জরিমানা সংশোধনসহ ১১ দফা দাবিতে নড়াইলে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ মানববন্ধন ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
মানববন্ধনে বক্তারা প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০৪/খ ধারায় মামলা রুজু করা, মোটরযান ও চালকেদের ওপর অধিক অর্থদণ্ড ও জেল-জরিমানা সংশোধনের দাবি ছাড়াও ১১ দফা দাবি জানান। সেদিন রাত থেকে কোনো ঘোষণা ছাড়াই নড়াইল-যশোর, নড়াইল-লোহাগড়া, নড়াইল-মাগুরা, নড়াইল-নওয়াপাড়া ও নড়াইল-কালিয়া সড়কে বাস চলাচল বন্ধ করে দেন শ্রমিকরা।
নড়াইল জেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের
সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহম্মেদ খান বলেন, বাস বন্ধ রাখার ব্যাপারে সংগঠন থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। কিন্তু আমাদের সঙ্গে আলাপ না করে বাস চালক-শ্রমিকরা নতুন সড়ক পরিবহন আইনের ভয়ে স্বেচ্ছায় অভ্যন্তরীণ পাঁচটি রুটে বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, সোমবার থেকে এখন পর্যন্ত নওগাঁর অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করেনি। ফলে নওগাঁর সঙ্গে বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাটের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।
পরিবহন ধর্মঘটের কারণে যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। এ সুযোগে ছোট যানবাহনগুলোতে কয়েকগুণ ভাড়া দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হচ্ছে। পাশাপাশি বেশি ভাড়া দিয়েও সময়মতো পৌঁছাতে পারছে না গন্তব্যে।
নওগাঁর বালুডাঙ্গা বাস টার্মিনালে কথা হয় এক যাত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজশাহী যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় আছি। আগে জানতাম না যে, বাস ধর্মঘট চলছে। এখানে এসে দেখি বাস চলাচল বন্ধ। টার্মিনালে প্রায় তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কোনো যানবাহন পাচ্ছি না। এ দুর্ভোগ শুধু আমার একার না, সারা জেলার মানুষের।
এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ওমর ফারুক জানান, বাস মালিক পক্ষ বা শ্রমিক নেতাদের নির্দেশনায় নয়, শ্রমিকরা নিজেরাই বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন। নতুন সড়ক পরিবহন আইন মেনে শ্রমিকরা বাস চালাতে পারবে না বলেই এ ধর্মঘট।