Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রতিবছর বাংলাদেশে হৃদরোগে মারা যায় ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ

মৃত্যুঝুঁকি কমাতে ট্রান্স ফ্যাট নির্মূলের বিকল্প নেই

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০১৯, ৫:১৮ পিএম

বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষ হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর বছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাটি এসিড বা টিএফএ নামক একধরনের চর্বি জাতীয় পদার্থ গ্রহণই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ।

এ বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের অবহিত করতে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্ (সিটিএফকে) এর গেøাবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের সহায়তায় প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা) যৌথভাবে বুধবার (৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ভবনের সভাকক্ষে ‘ট্রান্স ফ্যাট ও হৃদরোগ ঝুঁকি এবং গণমাধ্যমের করণীয়’ শীর্ষক একটি কর্মশালায় খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড (টিএফএ), হৃদরোগ ঝুঁকি এবং গণমাধ্যমের করণীয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা তুলে ধরেন ব্রাক ইউনিভার্সিটি জেম্স পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট আবু আহমেদ শামীম ও ন্যাশনাল হার্টফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ট্রান্স ফ্যাট প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর ডা. শেখ মো. মাহবুবুস সোবহান। কর্মশালায় গণমাধ্যমের করণীয় অংশে আলোচক হিসেবে অংশ নেন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি তৌাফিক মারুফ, অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্সের (আত্মা) কো-কনভেনর ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সিনিয়র রিপোর্টার মিজান চৌধুরী, গেøাবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের বাংলাদেশ কান্ট্রি কোঅর্ডিনেটর মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস এবং প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।

কর্মশালায় ট্রান্স ফ্যাট এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য, উৎস এবং এর উৎপত্তি নিয়ে আবু আহমেদ শামীম বলেন ট্রান্স ফ্যাট এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা মূলতঃ আংশিক জারিত তেল পিএইচওতে বিদ্যমান থাকে, যা ডালডা কিংবা বনস্পতি ঘি নামে আমাদের দেশে পরিচিত। এতে ২৫-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট থাকে। খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার সংরক্ষণের সুবিধার্থে এবং বিভিন্ন ভাজা পোড়া ও বেকারি খাদ্য পণ্যের স্বাদ, ঘ্রাণ এবং স্থায়ীত্ব বাড়ানোর জন্য আংশিক হাইড্রোজেনেটেড তেল ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া ভাজা পোড়া খাদ্যে একই ভোজ্য তেল উচ্চ তাপমাত্রায় বারবার ব্যবহারের কারণেও খাদ্যে স্বল্পমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, ঢাকার স্থানীয় বাজার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগৃহীত ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুট নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় নমুনা বিস্কুটগুলোতে ৫ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে (মোট ফ্যাটের ২ শতাংশের কম) অনেক বেশি।

কর্মশালায় টিএফএ’র স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে ডা. শেখ মো. মাহবুবুস সোবহান বলেন, বিশ্বব্যাপী হৃদরোগজনিত মৃত্যু আশঙ্কাজনকহারে বাডছে। ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (এলডিএল) কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে। অপরদিকে হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (এইচডিএল) কোলেস্টেরল (যাকে ‘ভালো’ কোলেস্টেরল বলা হয়) কমিয়ে দেয়। এইচডিএল কোলেস্টেরল রক্তনালী থেকে খারাপ কোলেস্টেরল সরিয়ে দেয়। কিন্তু ট্রান্স ফ্যাটের কারণে এইচডিএল কমে যায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবারের কারণে স্ট্রোক এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে সার্বিকভাবে মৃত্যুঝুঁকি ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির দৈনিক ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত মোট খাদ্যশক্তির ১ শতাংশের কম, অর্থাৎ দৈনিক ২০০০ ক্যালোরির ডায়েটে তা হতে হবে ২ দশমিক ২ গ্রামের চেয়েও কম।


কর্মশালায় উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ডেনমার্ক ২০০৩ সালে আইন করে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ করে। অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ইরান, ভারতসহ মোট ২৮টি দেশে খাদ্য দ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীামা নির্ধারণ কার্যকর করায় এসব দেশে ইতোমধ্যে শিল্পোৎপাদিত খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া আরো ২৪টি দেশ ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ বাধ্যতামূলক করেছে, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে কার্যকর হবে। অন্যদিকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আমেরিকা এবং কানাডা ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস পিএইচও’র উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০১১ সাল থেকে তেল ও বনস্পতি ঘি বা ডালডা জাতীয় পণ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয় এবং ২০১৫ সালে এটি ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ভারতের ফুড সেফটি অ্যান্ড স্টান্ডার্ডস অথরিটি ২০২২ সালের মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে কমিয়ে আনার পাশাপাশি খাবারে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট পরিহার করার ঘোষণা দেয়।


উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকরা ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাব এবং এটি নির্মূলে আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ের উপর আলোকপাত করে মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে টিএফএ এর ব্যবহার নির্মূল অর্থাৎ ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার এক বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এটি একইসাথে ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগজনিত অকাল মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা এই লক্ষ্য অর্জনে রিপলেস অ্যাকশন প্যাকেজ অনুসরণ করার কথা বলছে। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধসহ জনস্বাস্থ্যের কার্যকর উন্নয়নের জন্য ট্রান্স ফ্যাট নির্মূলের কোনো বিকল্প নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হৃদরোগ

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১৪ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন