Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ক্যাসিনোর আগুনে পুড়ল মোহামেডান

জাহেদ খোকন | প্রকাশের সময় : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:১৭ এএম

বহুল আলোচিত ‘ক্যাসিনো’ যেন এক জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের নাম। যার আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই দেশের স্বনামধন্য ক্রীড়া সংগঠন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ঐতিহ্য। মতিঝিল পাড়ায় যে ১১টি ক্লাব রয়েছে তার অন্যতম মোহামেডান। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এই ক্লাবটির সাফল্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তেমনি হালের জুয়ার বোর্ড বা ক্যাসিনো বাণিজ্যে মোহামেডানের সম্পৃক্তার কথা বললেও শেষ হতে সময় লাগবে।

সম্প্রতি ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানে বেরিয়ে আসে মতিঝিল ক্লাবপাড়ার অন্ধকার দিক। গত ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিল পাড়ায় র‌্যাবের অভিযানের পর আলোচনায় আসে মোহামেডান। তবে মাঠের কোনো খেলা নয়, ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি ফের শিরোনাম হয় জুয়ার বোর্ড ও ক্যাসিনো কান্ডে। যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে টাকার অভাবে ঘরোয়া ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি লিগের জন্য ভালো মানের দল গড়তে পারে না, সেখানে বছরের পর বছর ধরে হাজার কোটি টাকার জুয়া খেলা চলেছে মোহামেডানে!

র‌্যাবের অভিযানের পর পুলিশ দ্বিতীয় দফা ২২ সেপ্টেম্বর বিকেলে মতিঝিলের যে চারটি ক্লাবে অভিযান চালায় তার অন্যতম মোহামেডান। এখান থেকে পুলিশ উদ্ধার করে ক্যাসিনো সামগ্রীসহ মদ ও নগদ কিছু টাকা। বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। ক’দিন আগে যেখানে মোহামেডানের ডাইরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া বলেছিলেন, তার ক্লাবে কে বা কারা ক্যাসিনো ও জুয়ার বোর্ড চালায় তা তিনি জানেন না। যারা এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের কাছ থেকে তিনি শুধু জায়গার ভাড়া নেন। কিন্তু ২৫ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে লোকমান র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হলে ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। এদিন র‌্যাব লোকমানের মনিপুরী পাড়ার বাসা থেকে গ্রেফতার করে তাকে। র‌্যাব জানায়, অবৈধ মদ রাখার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে লোকমানকে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে নাকি গতকাল লোকমান স্বীকার করেন মোহামেডানে ক্যাসিনো বাণিজ্য ও জুয়ার ব্যবসার সঙ্গে তিনিও জড়িত। র‌্যাবের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, লোকমান মোহামেডানের ক্যাসিনো থেকে প্রতিদিন ৭০ হাজার করে মাসে ২১ লাখ টাকা পেতেন। শুধু তাই নয়, র‌্যাবের ভাষ্য এই মোহামেডান কর্তা নাকি তার ক্লাব থেকে গত কয়েক বছরে জুয়ার ব্যবসার প্রায় ৪১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন! ক্লাব ডাইরেক্টর ইনচার্জ সম্পর্কে এই যখন তথ্য তখন মোহামেডানের কোটি সমর্থক বা সাবেক খেলোয়াড়রা কী বলবেন? অবশ্য তাদের সবার একই কথা, ক্যাসিনোর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল মোহামেডানের ঐতিহ্য!

মতিঝিল পাড়ার ক্লাবগুলোর মধ্যে একমাত্র মোহামেডানই নিয়মিত অংশ নেয় দেশের তিন বড় খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির শীর্ষ লিগেই। এ ছাড়াও ক্লাবটি অনিয়মিত অংশ নেয়, দাবা, হ্যান্ডবল, রাগবি খেলায়। এক সময় ক্লাবটি ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, ভলিবলও নিয়মিত খেলতো। কিন্তু এখন সেই কার্যক্রম ছোট হয়ে সীমাবদ্ধ থাকছে গোটা তিনেক খেলায়। কেন এমন দৈন্যদশা সাদাকালোদের? এর উত্তরে শীর্ষ কর্তাদের দাবি একটাই- টাকার অভাবে মোহামেডান দল গড়তে পারে না তাই সব খেলায় অংশ নেয় না। অথচ পেছন ফিরলে দেখা যায় মোহামেডানের ঐতিহ্যের ঝলক। দিনক্ষণ হিসেবে সালটা ১৯২৭ সাল। উপমহাদেশে তখন চলছিল ব্রিটিশদের শাসনামল। সে বছরের কোনো একদিনে ঢাকার হাজারীবাগে এক নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৩৬ সালে ক্লাবটি নাম পরিবর্তন করে হয়ে ওঠে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। তবে সাফল্য পেতে অপেক্ষা করতে হয় ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত।

সে সময় ঢাকাই ফুটবলে রাজত্ব চালাচ্ছিল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। ১৯৫৬ সালে ওয়ান্ডারার্সের এক কর্তা ও কিছু তারকা খেলোয়াড় মোহামেডানে যোগ দিলে পরের বছরেই সাদাকালোরা জিতে প্রথম লিগ শিরোপা। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯, ১৯৬১, ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালে ঢাকা লিগের চ্যাম্পিয়ন তারা। ষাটের দশক থেকে শুরু করে সত্তর ও আশির দশকে দেশের ফুটবলে চলতে থাকে মোহামেডানের রাজত্ব। এই সময়ে ঢাকা লিগের ১১টি শিরোপা জয় তারই প্রমাণ। ঢাকা মোহামেডানের জয়জয়কার শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৯৫৯, ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আগা খান গোল্ডকাপের শিরোপা জিতে নেয় মোহামেডান।

দেশ স্বাধীনের পর ঢাকা আবাহনীর উত্থানে ঘরোয়া ফুটবলে নতুন মাত্রা যোগ হয়। শুরু হয় মোহামেডান-আবাহনী মর্যাদার লড়াই বা ঢাকা ডার্বি। আবাহনীর কাছে ১৯৭৪ ও ’৭৭ সালে লিগ হারানোর পরও ১৯৭৫, ’৭৬, ’৭৮ ও ১৯৮০ সালে লিগ জিতে নিজেদের দাপট বজায় রাখে মোহামেডান। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা ডার্বি পায় আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। এই দশকে আবাহনীর ৫টি’র বিপরীতে মোহামেডান জিতে নেয় ৪ লিগ শিরোপা। পরের দশকে আবাহনীর সঙ্গে সমান ৩টি করে শিরোপা জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় মোহামেডানকে। সর্বশেষ ২০০২ সালে লিগ শিরোপা জিতে রেকর্ড ১৯ বারের লিগ বিজয়ী ঢাকা মোহামেডান। ঘরোয়া আসর ফেডারেশন কাপেও মোহামেডান ১০ বারের শিরোপা জয়ী।
তবে ১৯৮৮ সালে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে স্থান করে নেয়া মোহামেডানের অবস্থা হালে বেশ নাজুক। দেশের ফুটবলে পেশাদারিত্ব আসার পর ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ১১টি আসর মাঠে গড়ালেও এখনো শিরোপাহীন মোহামেডান।

বিপিএলের তিনবারের রানার্সআপ সাদাকালোরা গত মৌসুমে কোনো মতে অবনমন এড়িয়েছে। সব মিলিয়ে গত ১৭ বছর ফুটবলে লিগ শিরোপাহীন মোহামেডান। প্রিমিয়ার ক্রিকেটে তারা শেষবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ২০০৯ সালে। শুধু প্রিমিয়ার হকির সর্বশেষ আসরে চ্যাম্পিয়ন দলটি। ক্লাবের এমন বাজে ফলাফলের জন্য কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাই সমর্থকদের ভাষ্য খেলাধুলায় সাফল্যহীন থাকলেও ক্যাসিনো বাণিজ্যে সফল মোহামেডান।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মোহামেডান

৯ এপ্রিল, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ