পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রকৃতির অনন্য লীলাভূমি, অপার সৌন্দর্যের বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের এক সম্ভাবনাময় দেশ। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক আর ঐতিহ্যেও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। এদেশে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। আছে সৌন্দর্যের আধার পতেঙ্গা, পারকি, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা। পাহাড় ও দ্বীপের মধ্যে আছে রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, মহেশখালী, নিঝুম দ্বীপ, সোনাদিয়াসহ অসংখ্য চরাঞ্চল ও দ্বীপ। আরও আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এই বনেই বাস করে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের প্রাণি বেঙল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, ঈগল, শকুন, মদনটাক, বানরসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। সৌন্দর্যের আধার রাতারগুলও আমাদের এক অমূল্য সম্পদ। আছে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, গড়াই, মধুমতিসহ শত শত নদ-নদী। আছে বাটালী হিল, তামাবিল, হাওর-বাঁওরসহ অনেক চোখ জুড়ানো স্থান যা যেকোনো দেশের পর্যটকদের বিমোহিত করে, মুগ্ধ করে। একবার কেউ চোখ জুড়ানো সবুজে মোড়ানো বাংলাদেশের প্রেমে পড়লে সহজে এ দেশের কথা ভুলতে পারেন না। ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ -এর মতো পর্যটকদের আগমন সেটাই প্রমাণ করে।
নদী যেমন মানবজীবনের জন্য সর্বক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনিভাবে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটন শিল্প সমগ্র বিশ্বের নদী এবং পানির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বর্তমানে পর্যটনের নতুন নতুন ডাইমেনশন তৈরি হচ্ছে যেমন ইকোট্যুরিজম। এ ধরনের পর্যটন উন্নয়নের জন্য পানিই হচ্ছে মূল কেন্দ্রবিন্দু। কিছু কিছু দেশ পানিনির্ভর পর্যটন কর্মকাÐ যেমন নদীতে প্রমোদভ্রমণ বা নৌবিহার, সমুদ্রে প্রমোদভ্রমণ বা সি ক্রুজিং, স্কুবাডাইভিং, স্নোরকেলিং, সার্ফিং, বোট রোয়িং, সমুদ্রে মাছ ধরা এবং তা অবলোকন, আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড এক্টিভিটিজ, প্যারাগøাইডিং, প্যারাসেইলিং, বার্ড ওয়াচিং ইত্যাদি শুরু করেছে। পর্যটনের প্রধান আকর্ষণগুলো নদীনির্ভর যেমন হাওর, বাঁওর, সমুদ্র, নদী, সমুদ্র তীর, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদি।
প্রশান্ত অথবা আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে সি ক্রুজিং, মেডিটেরিয়ান সাগর অথবা অন্যান্য সাগর এবং বিভিন্ন প্রধান প্রধান নদী যেমন আমাজান, নীল নদ, রাইন নদী, চাওপ্রিয়া নদীতে নৌবিহার সত্যই মনোমুগ্ধকর। অনেক উন্নত দেশ রয়েছে, যেগুলোর রাজধানী গড়ে উঠেছে সমুদ্র তীর, নদী বা জলাভূমির নিকট। কাশ্মীরের ডাল লেক, কেরালার নদী এবং খাল, ইন্দোনেশিয়ার বালি, জাপানের ওকিনাওয়া, মালদ্বীপ, ফিজি, হাওয়াই, গাম্বিয়া, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, মরিশাস, ওয়াশিংটনের মোজেস খাল ইত্যাদি হল বিশ্বের নামকরা পর্যটন গন্তব্য। বাংলাদেশ শত শত সর্পিলাকার নদী এবং খালের জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত। এটি আরও বিখ্যাত নৌবিহারের জন্য। বাংলাদেশে রয়েছে বিখ্যাত নদী যেমন- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কুশিয়ারা ইত্যাদি। যেহেতু নদীর দু’ধারে হাজার হাজার গ্রাম এবং স্থানীয় বাজার গড়ে উঠেছে; তাই এখানে নৌবিহার খুবই জনপ্রিয়। পর্যটকরা নদীপাড়ের দিগন্তবিস্তৃত শস্যাদি অবলোকন করতে পারে। তারা মাঠে কর্মরত স্থানীয় লোকদের অবলোকন করতে পারে। তাছাড়া ইলিশ মাছ ধরার দৃশ্য পর্যটকদের কাছে একটি প্রধান আকর্ষণ।
হাওর অঞ্চলে বছরে প্রায় দুই থেকে পাঁচ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। কৃষি উৎপাদনে, মাছ উৎপাদনে এবং অন্যান্য অ্যাকোয়াকালচার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রায়ও বৃষ্টিপাতের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। অন্যদিকে, হাওর অঞ্চলে ক্রসবর্ডার নদী আছে ১৫টি। ফলে পানি এত দ্রæত আসে যে এর পূর্বাভাস দেওয়া অত্যন্ত কঠিন এবং কোনো মডেল দিয়েই এর আগাম তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই আগাম বন্যার পূর্বাভাস কীভাবে দেওয়া যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সে বিষয়ে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, হাওর যে পানি রিটেইন করে সে পানি যদি বাঁধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে দেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে। পলির বিষয়টিও আমাদের অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে কেন না পলির মধ্যেই থাকে মাটির পুষ্টি। সুতরাং পলি এবং পানির একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। হাওর অঞ্চলের স্বকীয়তা বজায় রেখে হাওরের যে সম্পদ আছে তাকে যদি ট্যুরিজমে কনভার্ট করতে পারি, তাহলে হাওর অর্থনীতিতে একটি গতির সঞ্চার হবে। কৃষি এবং মাছ চাষের বাইরেও যে হাওরে মানুষের জন্য আয়বর্ধক কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।
বাংলাদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। রয়েছে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মতো সৌন্দর্যের রানী প্রবাল দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপও হতে পারে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রভূমি। বিশ্বের বৃহত্তম বাদাবন সুন্দরবন বাংলাদেশের অহংকারের অংশ। আমাদের সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুনাম বিশ্বজুড়ে। চিত্রল হরিণের তুলনা সে নিজেই। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। দেশের তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পর্যটনের স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটের নয়নাভিয়াম পরিবেশে মুগ্ধ হতে বাধ্য যে কোনো পর্যটক। তার পরও বাংলাদেশ পিছিয়ে পর্যটনবান্ধব পরিবেশের অভাবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম। পর্যটনের বিকাশে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হলেও নয় বছরে পর্যটনকেন্দ্রিক কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। গত বছর বিশ্বের মোট জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে ভ্রমণ ও পর্যটন খাত থেকে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে এ খাতের অবদান ছিল ২ হাজার ৯৩৯ বিলিয়ন ডলার যা অর্থনীতির ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। পর্যটনে কর্মসংস্থান ছিল ১৭৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন, যা মোট কর্মসংস্থানের ৯ দশমিক ৩ ভাগ। গত পাঁচ বছরে প্রতি পাঁচটি নতুন চাকরির একটি সৃষ্টি হয়েছে পর্যটন খাতে। এ অঞ্চলে ২০১৮ সালে বিদেশি পর্যটকরা খরচ করেছেন ৫২৯ বিলিয়ন ডলার যা পুরো রপ্তানি আয়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। পর্যটকদের ৮১ ভাগ ভ্রমণ করেন অবসর কাটাতে, বাকিরা ব্যবসায়িক কাজে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে বৈশ্বিক জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে পর্যটন থেকে, যেখানে বাংলাদেশে এ খাতের অবদান ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ।
দেশের পরিচিতি ও অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি আনে পর্যটন শিল্প। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইকোট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ এর কোনও বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বে যেকোনও পর্যটকদের নির্ধারিত নিয়ম নীতি বা বিধিমালার ভেতরেই ভ্রমণ সম্পন্ন করতে হয়। আমাদের দেশে সেসব নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে সবার সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকাসহ দর্শনীয় স্থানগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছনতাই পারে পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প গড়তে।
লেখক: উন্নয়ন ও পরিবেশ গবেষক এবং সহযোগী সদস্য, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।