Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কৃষকের ওপর করারোপের চিন্তা পরিহার করতে হবে

প্রকাশের সময় : ১৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবার দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কারিগর কৃষকদের উপর কর বসানোর পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আগামী দুই বছর পর কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায় করার চিন্তাভাবনা করছেন তিনি। গত শনিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট সম্মেলন কক্ষে ‘জাতীয় বাজেট ২০১৬-১৭ পরবর্তী পর্যালোচনা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছেন। কৃষকদের কাছ থেকে কর আদায়ের যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেছেন, এখন আমাদের চাষী কিষাণদের ট্যাক্স দেয়ার সময় হয়েছে। কারণ, এখন বেশ বড় কৃষক অনেক হয়েছে। তার যুক্তি : এলাকা বেশি হয়নি, তবে এলাকার প্রোডাক্টিভিটি এতো বেড়েছে যে তাদের ওপর করারোপ করা যায়। তবে তাদের আয়ের ওপর করারোপ করতে হবে, পুরো উৎপাদনের ওপর নয়। অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর কৃষকদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা এখনই জানা না গেলেও, তারা যে ক্ষুব্ধ এবং কৃষি উৎপাদনে নিরুৎসাহী হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই। এবারের বাজেট নিয়ে এমনিতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে। তাদের প্রতি পদে পদে ভ্যাটসহ নানা ধরনের কর দিতে হবে। যারা ব্যাংকে আমানতকারী ও লেনদেন করেন, তাদের তো প্রতি পদে পদে করের বোঝা বয়ে চলতে হচ্ছে। সঞ্চয়ী হিসাব, মেয়াদি হিসাব, চলতি হিসাব, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ঋণের হিসাব, আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের লেনদেনে গ্রাহকের ওপর চাপানো হয়েছে করের বোঝা। এর উপর ব্যাংকের সব ধরনের সেবার বিপরীতে রয়েছে সার্ভিস চার্জ। এতে দিতে হয় ১৫ শতাংশ ভ্যাট। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে প্রতিনিয়ত করের মাত্রাতিরিক্ত বোঝা বয়ে বেড়াতে গিয়ে তাদের যেমন নাভিশ্বাস উঠছে, তেমনি কৃষকের ওপর এই বোঝা চাপলে তাদের কী অবস্থা হবে, তা অনুমান করা কষ্টকর নয়।
সাধারণত জাতীয় বাজেট বরাবরই কৃষিবান্ধব হয়ে থাকে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের উৎসাহী করে তুলতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত কর্মসূচী থাকে। এটা করতে হয় একারণে যে, কৃষক যদি পর্যাপ্ত ফসল না ফলায়, তবে দেশে খাদ্য সরবরাহে বিঘœ সৃষ্টি হবে। খাদ্যসংকট বিশেষ করে ধান-চালের সংকট দেখা দেবে। ফলে বাজেটে কৃষিখাতে প্রাধান্য থাকে বেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাজেটে কৃষিখাতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা রাখার কারণে বছরের পর বছর ধরে কৃষক ফসল ফলিয়ে আজ ধান-চালে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। দেশের চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি, কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান-চাল উৎপাদন করলেও বিক্রির সময় তারা উৎপাদন খরচও তুলতে পারে না। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল কেনার জন্য মণপ্রতি যে মূল্য নির্ধারণ করে তা কৃষকের উৎপাদন খরচেরও সমান হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার দাম নির্ধারণ করলেও তার অর্ধেক দামে কৃষকদের বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। ফলে প্রকৃত দাম না পেয়ে কৃষকদের অনেক সময় রাস্তায় ধান-চাল ফেলে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। এবারের বোরো মৌসুমেও এই দৃশ্য দেখা গেছে। পত্র-পত্রিকায় এমন সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে একমণ ধানের দাম এক কেজি গরুর গোশতের দামের চেয়েও কম। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ফসল উৎপাদন করে লাভ দূরে থাক যদি উৎপাদন খরচই উঠে না আসে, তবে কৃষকের হতাশ হওয়া ছাড়া কি আর কোনো উপায় থাকে? প্রতি বছরই তো এই একই দৃশ্য বারংবার ফিরে আসছে। অনেক কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে নীরবেই পেশা বদল করে ফেলছে। কেউ কেউ ধান উৎপাদন কমিয়ে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকেছে। এবারই বোরো মৌসুমে কয়েক লাখ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করা হয়নি। এ পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তাহলে দেখা যাবে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে সরকারের তরফ থেকে যে অহংকার করা হয়, তা ধূলোয় লুটিয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। এর উপর যদি কৃষকদের উপর করের বোঝা চাপানো হয়, তাহলে তো তাদের ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে অর্থমন্ত্রী কেবল কোথায় কোন খাত থেকে কর ও ভ্যাট আদায় করা যায়, তা তন্ন তন্ন করে খোঁজা শুরু করেছেন। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে টানাপড়েনের মধ্যে ফেলা হচ্ছে। এটা কৃষকদের কাছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা তুল্য।
কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, এ কথা সবাই জানেন। ষোল কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য যোগানদাতা কৃষক শ্রেণী। বলা বাহুল্য, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি কৃষক। সরকার যতই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বলে ক্রেডিট নিক না কেন, তাতে তার চেয়ে কৃষকের উদ্যমী ভূমিকাই মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। সরকারের কৃতিত্ব নেয়ার তেমন কিছু নেই। কারণ, আমরা দেখেছি, সময় মতো পানি না পাওয়া ও সার সংকটে কৃষককে প্রতি বছরই ভুগতে হচ্ছে। এত সমস্যা মাথায় নিয়েও শুধুমাত্র নিজের তাকিদে হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে ফসল উৎপাদন করে চলেছে। এতে সরকারের কৃতিত্ব নেয়ার কী আছে! সরকার যা করছে, এটা তার রুটিন কাজ। এর বাইরে বিশেষ কিছু করেছে বলে তো কৃষকরা মনে করে না। যেখানে উৎপাদিত ফসল সরকারের হাতে তুলে দিতে চাইলেও সরকার যথাযথ দাম নিশ্চিত করে কিনতে পারে না, সেখানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বড় গলায় বলা কৃষকের কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা দেয়ার শামিল। কৃষক যখন হতাশ হয়ে পড়ছে, পেশা বদলের মতো চরম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন তাদের উপর করারোপ করার পরিকল্পনা নিশ্চিতভাবেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো ব্যাপার। আমরা মনে করি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যেখানে লক্ষ্য, সেখানে কৃষকদের ওপর করারোপ অনভিপ্রেত। এ ধরনের চিন্তা শুভ চিন্তা নয়। আমরা আশা করবো, সরকার এ ধরনের চিন্তা পরিহার করবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কৃষকের ওপর করারোপের চিন্তা পরিহার করতে হবে
আরও পড়ুন