Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নীতিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন কাম্য

প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গত বুধবার গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিন্ন করায় আমরা বিশ্বাসী নই। সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় নিয়ে পাকিস্তান ও তুরস্ক বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। বাংলাদেশ তাদের এই প্রতিক্রিয়াকে তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর শামিল বলে মনে করে। এ নিয়ে সরকারি দলের নেতাদের কয়েকজন পাকিস্তান ও তুরস্কের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষায় বক্তব্য রাখেন। তাদের কেউ কেউ ওই দু’দেশের সঙ্গে বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানান। সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের একাংশও এই দাবিতে সোচ্চার হন। সরকার অবশ্য তাদের কারো কথা ও দাবিতেই প্ররোচিত বা প্রভাবিত হয়নি। কূটনৈতিক দিক দিয়ে যতটুকু করার কেবল ততটুকুই করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্য বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হলো, কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার নীতিতে বিশ্বাসী না হওয়ার কারণেই ওই ধরনের চরম ব্যবস্থা নেয়ার পথে সরকার এগোয়নি। কোনো কারণে কোনো দেশের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের কূটনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে। কিন্তু তা সম্পর্ক ছিন্ন করার পর্যায়ে কমই যায়। সম্পর্ক গড়ে ওঠে দীর্ঘদিনে এবং এ সম্পর্কের মধ্যে থাকে নানাবিধ স্বার্থ। কাজেই সম্পর্ক ধরে রাখাটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান ও তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যিক ও ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে গ্রথিত। দু’টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক অধিকাংশ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা। সুতরাং কেউ চাইলেই সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। সরকার সঠিক পথেই রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হলো, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। এর লক্ষ্য হলো, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ দেশ বা বিশেষ দেশবলয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে না পড়া। জাতীয় স্বার্থে সব দেশ, সব দেশবলয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা ও রক্ষা করা। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশ ভারতমুখী এবং রুশ-ভারতবলয়ভুক্ত হয়ে পড়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে, মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে, এমনকি নিকট প্রতিবেশী চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পরবর্তীকালে অবশ্য এই নীতি-দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে একটা স্বাধীন, উদার ও উন্মুক্ত জমিনে এনে স্থাপন করেন। তিনি ভারতমুখিতা পরিহার করেন। রুশ-ভারত বলয় থেকে বেরিয়ে আসেন এবং এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সাথে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। বস্তুত, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির কারণে অল্প দিনেই বাংলাদেশের সঙ্গে নীতি-দর্শন ও বলয় নির্বিশেষে সব দেশের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হচ্ছে, পরবর্তীতে ক্ষমতাসীনদের অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার অভাবহেতু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবনমন ঘটেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ফের ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতির খোড়ালে ঢুকে পড়েছে। ভারত ও রাশিয়াসহ মাত্র কয়েকটি দেশের সঙ্গেই এখন তার সম্পর্কের দহরম মহরম । সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সরকারী মহলের অনেকে মনে করেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেই চলে, আর কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও তেমন ক্ষতি নেই। এটা একটা ভয়ংকর কূপম-ূকতা, চরম হীনম্মন্যতা ও দাস্যমনোবৃত্তির পরিচায়ক।
কানু ছাড়া নীতি নাই, ভারত ছাড়া বন্ধু নাইÑ আমরা এখন যেন এটাই মান্য করছি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, আমরা একথা বলতে চাইনে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, আমরা ভারতেরই অনুগমন করছি। বর্তমান সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটা একতরফা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, যা কিছু বাংলাদেশের কাছে চাওয়ার ও পাওয়ার, তা কোনো বিনিময় বা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া ছাড়াই হাসিল করে নেয়া। ইতোমধ্যে সে ট্রানজিটের নামে করিডোর ও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ লাভ করেছে। ন্যূনতম মাশুলে সে তার একাংশ থেকে অপরাংশে মালামাল নিয়ে যেতে পারবে। আরও নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে ও নিচ্ছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের জন্য ভারতকে কিছুই দিতে হয়নি,করতে হয়নি। পানি দিতে হয়নি, তিস্তাচুক্তি করতে হয়নি, জে আরসি’র বৈঠক করতে হয়নি, বাণিজ্য অসমতা কমাতে হয়নি, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ করতে হয়নি, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ করতে হয়নি। এই একমুখী-একতরফা সম্পর্কের কারণে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে সবদিক দিয়ে ভারতনির্ভর দেশে পরিণত হচ্ছে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার সম্পর্কের বন্ধন দিনকে দিন আলগা হয়ে যাচ্ছে। এরকম একদেশ নির্ভর কিংবা ‘এক বন্ধু’ নীতি কোনো দেশের জন্যই হিতকর-কল্যাণকর হতে পারে না। বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান পটভূমিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি অনেক বেশী জটিল হয়ে উঠেছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব যে সব দেশে আছে, সে সব দেশ এর মধ্য থেকেই ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, লাভবান হচ্ছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের উচিত দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য থেকে বিরত থাকা। কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা সহজ, গড়ে তোলা খুবই কঠিন। প্রধানমন্ত্রীকে আমরা বিশেষভাবে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানাই এজন্য যে, তিনি সঠিক অবস্থান থেকে সঠিক বক্তব্য দিয়েছেন। এর মধ্যে তার মেধা, দূরদৃষ্টি ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার বক্তব্যের প্রতিফলন আমরা এখন দেখতে চাই। আমরা আশা করতে চাই, ফের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা হবে এবং সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক জোরদার করে তোলা হবে।

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নীতিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন কাম্য
আরও পড়ুন