Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রমজানের তাৎপর্য : মনীষীদের মতামত

প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী

॥ এক ॥
পবিত্র রমজান বিশ্ব মানবের জন্য আল্লাহতায়ালার অনন্তকরুণার এক অন্যতম নিদর্শন। মহান ধর্ম ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ এই রমজান মাসের রোজা তথা উপবাসব্রত পালন করা। মানবকে মানবতার উচ্চ সোপানে আরোহণ করাবার এক মহতী প্রচেষ্টা নিয়ে বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহতায়ালা রমজানকে ধরাবক্ষে পাঠিয়েছেন। মানব চরিত্রে যে সমস্ত মহৎ গুণের সমন্বয় ঘটলে প্রকৃত মানব নামের অধিকারী হওয়া যায় এবং যে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে সমর্থ হলে আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করা যায়, তারই প্রকৃষ্ট সাধনা হলো এই রমজানের সিয়াম সাধনা।
আরবি নবম মাস রমজান, এই রমজান মাসেই রোজা তথা উপবাসব্রত পালনের নির্ধারিত সময়। তাই বিশ্বের মুসলমানরা এই মাসেই একই নিয়ম-পদ্ধতিতে এবং একই নীতি অনুসারে টানা একমাসই এই ব্রত পালনে সচেষ্ট হন। সূর্যোদয়ের ঘণ্টা দুয়েক পূর্ব থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সর্বপ্রকার পানাহার, ইন্দ্রীয়তৃপ্তিমূলক কাজ এবং যাবতীয় গুনাহ হতে বিরত থাকার নামই রোজা তথা উপবাস থাকা। ‘রমজান’ শব্দটি ‘রমজ’ ধাতু হতে উৎপত্তি। সুতরাং এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো আগুনে পুড়িয়ে ছাই ভস্ম করা। সেই হেতু এই রমজানের উপবাসব্রত পালনে মানবের অন্তরের কলুষ কালিমাকে জ্বালিয়ে নির্মল এবং পবিত্র করে তোলে। যেমন একটি সদ্যোজাত শিশুসন্তান মাতৃগর্ভ হতে নিষ্পাপ-নিষ্কলুষ হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়।
এই রমজান ব্রত ইসলাম জগতের রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, ফকির-ভিখারি সর্বশ্রেণীর বয়ঃপ্রাপ্ত নর-নারী সবার উপরই বাধ্যতামূলক। এই টানা একমাস উপবাসব্রত পালনে মানবকুলকে ত্যাগ, সংযম, তিতিক্ষা, সাম্য, মৈত্রী, পরস্পর ভ্রাতৃত্ববন্ধন ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। বিশেষত ইসলাম জগতের বিত্তবান ধন সম্প্রদায় এই ব্রত পালনের মাধ্যমে সমাজের নিঃস্ব, গরিব-দুখির ক্ষুধা-তৃষ্ণার জঠর জ্বালা-যন্ত্রণা কিরূপ তা আপন অভিজ্ঞতা দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হন। যেহেতু তাঁরা চিরদিন সুখের অঙ্কে লালিত-পালিত, অভাব-অনটন এবং অনশনের দহনে কখনও পোড়েনি- তারাই ক্ষুধার্তের অন্তরের দুঃখ এবং অনশনক্লিষ্ট মানুষের দুঃখ-বেদনা কিরূপ তা বুঝতে পারেনি? তাই এই রমজানের উপবাস পালনের মাধ্যমেই তা অবগত হন।
মানব জীবনে যত প্রকার দুঃখ, বেদনা ও জ্বালা-যন্ত্রণা আছে, তারমধ্যে সর্বাপেক্ষা দুঃখ হলো অনশনের দুঃখ এবং সবচাইতে বড় জ্বালা হলো জঠর জ্বালা। এই ক্ষুধার জ্বালায় ধার্মিকও খোদার প্রতি বিদ্রোহী হয়ে উঠে। মা নিজ সন্তানকে বিক্রি করে, এমনকী কতই না বিষ পান করে, পানিতে ডুবে ও গলায় দড়ি দিয়ে প্রাণ বিসর্জন করে। তাই বিশ্বস্রষ্টা জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে দুখির দুঃখ ও অনশনক্লিষ্ট মানবের অনশনের সুতীব্র জ্বালা বোঝাবার জন্য তাঁর সৃষ্ট মানব জাতির ওপর রোজা তথা উপবাসব্রত পালন ফরজ অর্থাৎ অপরিহার্য করে দিয়েছেন। দুর্দশাগ্রস্ত জনসাধারণের দুঃখ নিজের জীবন দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করার প্রকৃষ্ট পন্থা হলো- রমজানের রোজা, শুধু তাই নয় উদারতা, বদান্যতা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, সততা প্রভৃতি মহৎ গুণ নিজের জীবনে রূপায়িত করার এবং অভ্যাসে পরিণত করার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো এই রমজানের সাধনা। এমনকী দৈহিক ও মানসিক উৎকর্ষ সাধনেরও অন্যতম প্রধান সহায়ক এই রমজান।
এই রোজা তথা উপবাসব্রত পালন শুধু আত্মারই উৎকর্ষ সাধন করে না সেইসঙ্গে মানব দেহের ওপর তার প্রচুর প্রভাব প্রতিফলিত হয়। যেহেতু একমাসের নিরবচ্ছিন্ন উপবাসে দেহের বিপুল পরিবর্তন সাধিত হয়। শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, রাসায়নিক উপাদান, বায়ু-পিত্ত-কফ ও রক্তের ঘণ্টায় ঘণ্টায় অজ্ঞাতে পরিবর্তন সাধিত করে। প্রতিনিয়ত রোজাদারের হৃৎপি-ের ক্রিয়া, রক্ত চলাচল, মূত্রগ্রন্থি ও যকৃতের ক্রিয়া, রক্তের নানা উপাদানের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। কেননা মানব পাকস্থলি একটি ‘যন্ত্র’ বিশেষ।
সারা বছর একটানা খাদ্যবস্তু হজম করানো কাজের ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে একমাস উপবাসের ফলে পাকস্থলি দিনের বেলায় বিরতি লাভ করে কর্মশক্তিতে সতেজতা লাভ করে এবং নানা প্রকার পেটের পীড়া থেকে রোজাদার নিষ্কৃৃতি লাভ করে। বহুমূত্র রোগের একমাত্র মহৌষধ এই রোজার কৃচ্ছ সাধনা। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডাক্তারগণ বহুমূত্র রোগীদের সপ্তাহে একদিন উপবাস পালনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান মতে, দীর্ঘজীবন লাভ করার জন্য আহারের প্রয়োজনীয়তা খুব কম। ‘বেশি বাঁচবে তো কম খা’ প্রবচনটি সত্য।
বিশ্বস্রষ্টা মহাগ্রন্থ কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘হে বিশ্বস্ত মোমেন সম্প্রদায় এই রোজাব্রত তোমাদের শুল্কচারী ও খোদা ভীরু করার জন্য অবধারিত করা হয়েছে- যা পূর্বেও অবধারিত ছিল।’এই রমজান মাসে উম্মতে মোহাম্মদিগণকে যা দান করা হয়েছে তা অন্য কোনও নবীর উম্মতকে দেয়া হয়নি। রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহপাকের কাছে মৃগনাভী অপেক্ষা প্রিয়। সাগরের মৎস্যসমূহও আল্লাহর কাছে ইফতার পর্যন্ত রোজাদারের জন্য দোয়া করতে থাকে। রোজাদারদের জন্য প্রতিদিন বেহেশতকে সুসজ্জিত করে আল্লাহ ঘোষণা করেন- দুনিয়াতে নেকবান্দা সকল দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে শীঘ্র ফিরে এসে জান্নাতে প্রবেশ করবে? বেহেশতের ভিতর আটটি দরজার মধ্যে ‘রাইয়ান’ নামক একটি দরজা আছে, যার মধ্যেদিয়ে একমাত্র রোজাদারগণ প্রবেশ করতে পারবে, অন্য কেউই প্রবেশ করতে পারবে না। এই রমজান মাসে দুর্বৃত্ত মানবের চিরশত্রু শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়, ফলে রোজাদার প্রকাশ্য পাপ কাজ করতে পারে না যা অন্য মাসে অনায়াসে করতে পারে। আল্লাহ নিজেই রোজাদার। তিনি সর্বপ্রকার পানাহার থেকে মুক্ত। অতএব রমজান আল্লাহতায়ালার প্রিয়বস্তু, তাই রোজাদারগণও আল্লাহর কাছে প্রিয়পাত্র। রোজাদারের রাতের নিদ্রা ইবাদত ও তার পক্ষে নীরবতা পালন করা তসবিহস্বরূপ গণ্য হয়। রমজানের রোজা ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ না তা ছিন্নভিন্ন করা হয়। সৈনিক যেমন রণক্ষেত্রে ঢাল দিয়ে প্রতিপক্ষের আঘাত প্রতিরোধ করে তেমনি রোজাদার ব্যক্তি তার রোজাদ্বারা মহাশত্রু শয়তানের কবল থেকে আত্মরক্ষা করে। রোজা পাপের প্রতিবন্ধক স্বরূপ।
এই পবিত্র রমজান মাসে পাঁচটি ঐশী মহাগ্রন্থ পাঁচজন বিশিষ্ট নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। সেইগুলো হলো- ১) রমজানের প্রথম রাত্রিতে হজরত ইব্রাহিমের ওপর ‘ছহিফা’। ২) চতুর্থ রাত্রিতে হজরত মুসার ওপর ‘তৌরিত’। ৩) বারই রাত্রিতে হজরত দাউদের ওপর ‘জবুর’। ৪) আঠারই রাত্রিতে হজরত ঈসার ওপর ‘ইঞ্জিল’। ৫) বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শবে কদরের রাত্রে ইসলামের সংবিধান মহাগ্রন্থ ‘কোরআন’ লওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়। এরপর পূর্ণ তেইশ বছর ধরে প্রয়োজন সাপেক্ষে মহানবীর প্রতি প্রত্যাদেশরূপে প্রেরিত হয়। এই শবে কদরকে মহান আল্লাহ জোৎস্নাপাবিত রজনীতে দান না করে অমানিশার ঘোর আঁধারে দান করেছেন, যাতে বান্দাগণ আল্লাহর প্রেমলাভের জন্য বিনিদ্র রজনী যাপন করে তাঁর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। ওই রাত একহাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর ৪ মাস ইবাদতের সমতুল্য পুণ্য সঞ্চয় হয়। এই রমজানের প্রথম দশ দিন রোজাদারের ওপর রহমত, দ্বিতীয় দশ দিন পাপীতাপীদের পাপ মাফ করে দেন এবং তৃতীয় দশ দিন পাপীদের নরকের আগুন থেকে নাজাত করে দেন।
আরামপ্রিয়তা সব অনিষ্টের মূল। তবে রমজান মাসে আরাম হারাম হয়ে যায়। যেহেতু রোজাদারের ধারাবাহিক রুটিনের মতো রমজান মাসের সময় অতিবাহিত হয়। এতে বৈষয়িক আরাম লওয়ার কোনও সুযোগই থাকে না।
একদা হজরত মুসা করজোড়ে মোনাজাত করে আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেন, হে পাকজাত আপনি উম্মতে মোহাম্মদিকে কোন উৎকৃষ্ট দান করেছেন। এর উত্তরে আল্লাহ বলেন, ‘আমি উম্মতে মোহাম্মদিকে উৎকৃষ্ট রমজান মাস দান করেছি, যেহেতু এই মাসের মর্যাদা এইরূপ তোমাদের সর্বসাধারণের মধ্যে ‘আমার’ মর্যাদা ও সম্মান যেমন অতুলনীয়। অন্যান্য মাস অপেক্ষা রমজান মাসের মর্যাদা তেমনি অতুলনীয়। এমনকী আল্লাহ আরও বলেন, এই রমজান মাসে যারা রোজা রাখবে আমি তাদের আমলনামায় দুনিয়ার সমস্ত ফেরেস্তা ও জীবজন্তুর অর্জিত পুণ্য লিখে দেব। তখন হজরত মুসা আক্ষেপ করে বললেন, ওহে প্রভু কেন আমাকে সেই পরম উম্মতে মোহাম্মদির অন্তর্ভুক্ত করলেন না।?’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রমজানের তাৎপর্য : মনীষীদের মতামত
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ