Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাদ পড়ার আশঙ্কায় ৪১ লাখ আসামবাসী

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০১ এএম

১৯৬৮ সালে তৎকালীন প‚র্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) ময়মনসিংহ থেকে মাত্র সাত বছর বয়সে বাবার হাত ধরে আসামে পালিয়ে এসেছিলেন দুলাল দাস। বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, চোখের সামনে প্রিয়জনের হত্যালীলার দুঃস্বপ্ন পিছনে ফেলেও ভিনদেশে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু আবার যেন সেই আতঙ্কে ফের গ্রাস করেছে দুলাল দাস ও তার পরিবারকে। শুধু দুলাল দাসই নয়, তার মতো ৪১ লাখ আসামবাসীর রক্তে বয়ে যাচ্ছে আতঙ্কের শীতল স্রোত। আতঙ্ক রাজ্যহীন, দেশহীন হয়ে যাওয়ার, আতঙ্ক পাকাপাকি ভাবে ‘বিদেশি’ বা ‘উদ্বাস্তু’ অথবা ‘অনুপ্রবেশকারী’ ছাপ পড়ার।

আজ শনিবারই প্রকাশিত হচ্ছে আসাম জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)-র চ‚ড়ান্ত তালিকা। সকাল ১০টায় আসাম এনআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে তালিকা। তবে যাদের ইন্টারনেট কানেকশন নেই, তারা এনআরসি সেবা কেন্দ্রে গিয়েও তালিকায় নিজের নাম উঠেছে কিনা, তা দেখতে পারবেন।
ইতিহাসটা প্রায় ১১৮ বছরের। আসামে প্রথম নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ সালে। তার পর থেকে সংশোধন হতে হতে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে চ‚ড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হতে চলেছে। তার আগে চ‚ড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই। তখন সেই খসড়া তালিকায় তিন কোটি ২৯ লক্ষের মধ্যে বাদ পড়েছিলেন ৪০ লাখ ৭ হাজার ৭০৭ জন।
তার পর গত দু’বছরে সুপ্রিম কোর্টে বহু মামলা হয়েছে। আন্দোলন-প্রতিবাদ-বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়েছে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে। রাজনৈতিক তরজার পারদ তুঙ্গে উঠেছে। তার মধ্যেই চলেছে তালিকা সংশোধনের কাজ। কিন্তু তারপরও তালিকা থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে অন্তত ৪১ লাখ মানুষের।
তালিকা প্রকাশের পর নতুন করে বিক্ষোভ-আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠতে পারে আসাম। সেই কারণেই গোটা রাজ্যেই কড়া নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। গত ২৩ আগস্ট রাজ্যের ডেপুটি কমিশনার, সব জেলার পুলিশ সুপার-সহ পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল। সেখানেই কড়া হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনও রকম চেষ্টা হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের। একই সঙ্গে রাজ্যবাসীকেও আর্জি জানিয়েছেন শান্তি বজায় রাখার।
আসাম পুলিশের তরফে টুইট করে জানানো হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে তালিকা থেকে বাদ পড়াদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে আসাম পুলিশের আর্জি, ‘গুজবে কান দেবেন না। কেউ কেউ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি, অশান্ত বা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করবে। নাগরিকদের নিরাপত্তাই আমাদের অগ্রাধিকার।’
কিন্তু চ‚ড়ান্ত তালিকা থেকে যারা বাদ পড়বেন, তাদের ভবিষ্যৎ কী? কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, নাম বাদ পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হবে না। ধাপে ধাপে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে পারেন যে কেউ। আইনি প্রক্রিয়া সম্প‚র্ণ হওয়ার পরই সেই প্রক্রিয়া চালু হবে। বাদ পড়া প্রতিটি নাগরিক ফরেনার্স ট্রাইবুনালে আবেদন করতে পারবেন। সেই আর্জির সময়সীমা দেওয়া হতে পারে ৬০ দিন থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় স‚ত্রে খবর, আসাম জুড়ে প্রাথমিক ভাবে ১০০০ ট্রাইবুনাল বসানো হবে। ইতিমধ্যেই ১০০ ট্রাইবুনাল চালু রয়েছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরও ২০০ বাড়ানো হবে এবং ধাপে ধাপে সেই সংখ্যা এক হাজারে নিয়ে যাওয়া হবে। কেউ ট্রাইবুনালে হেরে গেলে হাইকোর্টে যেতে পারবেন। সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ থাকবে।
কিন্তু দীর্ঘ এই আইনি প্রক্রিয়া চলাকালীন কী অবস্থায় থাকবেন তালিকা বহির্ভ‚তরা। এ বিষয়ে কেন্দ্রের আশ্বাস, কাউকেই ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হবে না। প্রত্যেককে সর্বোচ্চ আইনি অধিকার দিতে সরকার বদ্ধপরিকর, বার্তা কেন্দ্রের। কাউকে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হবে না বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আসাম স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তাও।
পর্যাপ্ত নথিপত্র থাকা সত্তে¡ও নাগরিকপঞ্জিতে নাম উঠেছে, বা প্রকৃত অনেক নাগরিকও বাদ পড়েছেন- এমন খবর বহু বারই উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। এমনকি, দীর্ঘদিন বিএসএফ বা সরকারি দফতরে চাকরি করার পরও অনেকের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং আসাম সরকারের তরফে আশ্বস্ত করা হয়েছে, প্রকৃত নাগরিক কেউ বাদ পড়বেন না। সরকারি তরফে তাদের সমস্ত রকম সহযোগিতা করা হবে।


কিন্তু এত আশ্বাসের পরও আতঙ্ক কাটছে না লাখ লাখ আসামবাসীর মধ্যে। তালিকা থেকে বাদ পড়লে কী হবে, সেই অজানা ভবিষ্যতের আতঙ্কেই সিঁটিয়ে রয়েছেন একটা বড় অংশের মানুষ। তা ছাড়া দরিদ্র-নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে নাগরিকত্বের লড়াই চালিয়ে যাওয়া কতটা সম্ভব হবে, সেই আশঙ্কাও করছেন অনেকে।
আশঙ্কা অবশ্য কেন্দ্র এবং আসামের শাসক দল বিজেপির অন্দরেও রয়েছে অন্য কারণে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিই যে দলের হাতিয়ার, তাদের শাসনকালেই হিন্দুরা ‘দেশহীন’ হয়ে পড়বেন, এটা পদ্ম শিবিরে কাছে উদ্বেগের তো বটেই, মত পর্যবেক্ষকদের। ইতিমধ্যেই আসামের অনেক বিজেপি নেতা সেই আশঙ্কা-উদ্বেগের কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। রাজনীতির কারবারিদের এই উদ্বেগ নিয়ে অবশ্য আপাতত উদাসীন খসড়া নাগরিকপঞ্জি থেকে থেকে বাদ পড়া নাগরিকরা। আপাতত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে তাদের অপেক্ষা শনিবার সকালের জন্য।

 

 



 

Show all comments
  • মশিউর রহমান ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:১৯ এএম says : 0
    ৪০ লাখ মানুষকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিলেই ভারতের উদ্দেশ্য সফল!
    Total Reply(0) Reply
  • Shofi Ullah ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:১৯ এএম says : 0
    এই বোঝা দেশের উপর আসবে সবার প্রতিবাদ করা প্রয়োজন আজ মুসলিম জাতি মাঝিবিহীন নৌকার মত কে হালধরবে পথ হারা জাতির????
    Total Reply(0) Reply
  • Nur Al Hridoy ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:১৯ এএম says : 0
    পুরো সংবাদটা পড়ে খুব খারাপ লাগলো,৪০ লাখ মানুষ ও তাদের পরিবার যে কত দুশ্চিন্তাতে আছে তা একমাত্র মহান আল্লাহ জানেন। আল্লাহ তাদের সহায় হোন। তবে আমার মনে হয় ভারত সরকার নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে,যেমনটা পাকিস্তান করেছিল ১৯৭১এ!
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ সানোয়ার হোসাইন ময়েল ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:২০ এএম says : 0
    আমাদের প্রাণ প্রীয় বন্ধু রাষ্ট্র ৪০ লক্ষ্য মেহমান আমাদের দেশে পাঠাবে, আমার দেশের সরকার প্রধান এম পি মন্ত্রিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন আসবে এ মেহমান।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ মেহেদী হাসান ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:২০ এএম says : 0
    ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্বামী স্ত্রী এর মত। এখন স্বামী যদি বলে শ্বশুর বাড়ির লোকজন আমাদের বাড়িতে রাখবোনা তাহলে তারা পাঠিয়েই দিতে পারে। এখন পাঠানো মাত্র সময়ের ব্যাপার।
    Total Reply(0) Reply
  • Kamran Uddin Rayhan ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:২০ এএম says : 0
    আগামীকাল আসামের প্রায় ৪০ লক্ষ লোক জানতে পারবে তারা ভারতের নাগরিক না। বংশ পরম্পরায় সেদেশে থাকার পরেও কোন অজ্ঞাত কারণে, এক কলমের খোঁচায় তাদের জীবনেও রোহিঙ্গাদের মতো পরিণতির অপেক্ষা করছে। সমগ্র আসাম জুড়ে চাপা আতংক বিরাজ করছে। দশটি জেলায় ইতিমধ্যেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Jovan Farhad II ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:২১ এএম says : 0
    তবুও আমাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলবেন কাশ্মীর ইস্যুতে পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ণ সমর্থন দিবে ভারতকে!! স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ওরা আমাদের সাহায্য করেছিল ঠিকই কিন্তূ সেটা ছিল স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে তা হাড়ে হাড়ে প্রমাণ দিয়েছে তথাকথিত (ভন্ডু) বন্ধু ভারত।
    Total Reply(0) Reply
  • বিপুল চাঙমা জুম্মো ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:২২ এএম says : 0
    এইটা ভারতের কারসাজি। বাংলাদেশকে আতঙ্খে রাখার জন্যে একপ্রকার মানসিক চাপ প্রয়োগ।তারা জানে আমরা তিস্তা চুক্তির জন্যে আন্তর্জাতিক আদালতে গেলে আমরা সফল হবো এতে তারা হেরে যাবে। তাই যাতে আমরা তিস্তা চুক্তি নিয়ে বেশি লাফালাফি না করি তারজন্যে এই কৌশল। তাছাড়া কাশ্মীর সমস্যা তো আছেই....
    Total Reply(0) Reply
  • Raufur Rahim ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    ভারত কারে বাতিল করল আর না করল সেটা বড় বিষয় নয়, বিষয়টা হল বাংলাদেশ সিমান্তে রেটএর্লাট জারি করা হোক যাতে মানুষ দুরের কথা একটা পাখি যেন ঢুকতে না পারে ।
    Total Reply(0) Reply
  • Musabbir Husen Kazal ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    ভারত শুুধু বাংলাদেশ না পৃথীবির প্রত্যেকটি দেশের জন্য হুমকি কারন ভারত একটি বেঈমান দেশ, তাদের কোনু সভ্য কালচার নাই।
    Total Reply(0) Reply
  • Jewel Hossain ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    ভারত নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলছে,,,এভাবে চলতে থাকলে ভারত যে কয়েক টুকরো হয়ে যাবে সেটা বলার অবকাশ রাখে না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আসাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ