পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
হিন্দি সিরিয়ালের চরিত্র ‘পাখি’র মতো জামা কিনে না দেয়ায় সিরাজগঞ্জে আত্মহত্যা করে এক তরুণী। কিভাবে আত্মহত্যা করা যায়- ফেসবুক লাইভে এমন দৃশ্য দেখাতে দেখাতে আত্মহত্যা করে এক কিশোরী। পরিবার মেনে না নেয়ায় এক গাছে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে কিশোর প্রেমিক-প্রেমিকা। কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের এমন বিচিত্র, অদ্ভুত অথচ তুচ্ছ কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্দহন, মেনে নিতে না পারা, লোকলজ্জার ভয়, অভিমান ইত্যাদি কারণেই বাড়ছে কিশোর-কিশোরীদের আত্মহনন।
উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়া কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে গবেষণা চলছে বিস্তর। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলাফলে উঠে এসেছে আত্মযন্ত্রণা, আত্মপীড়ন, মানবিক বোধের অভাব এবং সাইবার নিপীড়নের মতো কিছু কারণ। এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষায় বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের সময়ও আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষণীয়। পথঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইভটিজিং সহ্য করতে না পেরে অনেক কিশোরী আত্মহত্যা করছে। এটি তাদের মনস্তাত্তি¡ক বিপর্যয়ের চূড়ান্ত পরিণাম। নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে সহনশীলতার অভাব নিয়ে।
আত্মহত্যা কী ও কেন : ইংরেজিতে ‘সুইসাইড’ অর্থ হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন নিজে বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। ল্যাটিন শব্দ ‘সুই সেইডেয়ার’ থেকে ‘সুইসাইড’ বা আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে ‘মানসিক অবসাদজনিত’ গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এ ধরনের অপরাধ রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মে আত্মহত্যাকে ‘পাপ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বে প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রতি বছর যত মানুষ মারা যায় তার মধ্যে আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণটি ত্রয়োদশতম। আর মৃতদের মধ্যে যারা কিশোর-কিশোরী তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ আত্মহত্যা।
একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশ কিশোর-কিশোরী তাদের ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে কমপক্ষে একবার গুরুতর নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়। ৭ শতাংশ দুই থেকে তিন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। এক-পঞ্চমাংশ কিশোর-কিশোরী নিজের জন্য ক্ষতিকর চিন্তা ও আচরণ করে। যারা অতিরিক্ত নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে আত্মপীড়নের ঝুঁকি দ্বিগুণ বেড়েছে। আত্মহত্যার চেষ্টার ঝুঁকি বেড়েছে তিনগুণ। নিপীড়নের শিকারে আক্রান্তের প্রায় অর্ধেক কিশোর আত্মঘাতী ভাবনা এবং আত্মনিপীড়নের সম্মুখীন হয়। আর এর এক-চতুর্থাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু পারিবারিক এবং ব্যক্তিগতভাবে এই ঝুঁকিগুলোর মোকাবেলা করার পরও এমন অভিজ্ঞতার শিকার ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আত্মঘাতী ভাবনা বা আত্মপীড়নের প্রবণতা বেশি।
পারিবারিক ও সামাজিক অবহেলা, পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। অপরিণত বয়সে প্রেম, আত্মযন্ত্রণা এবং আত্মপীড়নের কারণেও তারা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। পারস্পরিক যোগাযোগ-বৈকল্য, অভিমান, আবেগ, নিঃসঙ্গতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা শেয়ার করতে না পেরে নিজেকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অনেক কিশোর-কিশোরী। লন্ডনের কিংস কলেজের এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। তবে নানা কারণে বাংলাদেশেও কিশোর-কিশোরীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। গবেষকদের মতে, এসব আত্মহত্যার পেছনে রয়েছে অবজ্ঞা, অবহেলা, লোকলজ্জার ভয়, অপরাধ বোধ, মানবিক বোধের অভাব এবং সাইবার নিপীড়ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, আত্মহত্যা এবং আত্মপীড়নের কারণে আনুমানিক ৬৭ হাজার আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিশোরকালীন মৃত্যু ঘটছে আত্মহত্যা এবং আত্মপীড়নের কারণে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আত্মহত্যার হার বেশি।
দেশে কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতা : ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্স’ সম্প্রতি একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায়, দেশে বছরে গড়ে ১০ হাজার নর-নারী আত্মহত্যা করে। প্রতি ১ লাখে ৭.৩ জন আত্মহত্যা করে। গ্রামে আত্মহত্যার হার শহরের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি। আত্মহত্যাকারীদের বড় অংশই অশিক্ষিত ও দরিদ্র। আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এদের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়, দেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন আত্মহত্যা করে। ফাঁসি দিয়ে এবং বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে ১০ হাজার ১২৯ জন। এ ছাড়া অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে, গাড়ির নিচে কিংবা চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েও আত্মহত্যা করে। উপেক্ষা, অবহেলা, কটূক্তি, অপরাধপ্রবণতা, পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়নের কারণে আত্মহত্যা দিকে তাড়িত করে কিশোর-কিশোরীদের।
কেস স্টাডি (এক) : যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে নূরুল ইসলাম (১৫) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। নূর ইসলাম গাইবান্ধা জেলার সদর উপজেলার মতি মিয়ার ছেলে। সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর মশিউর রহমান জানান, একটি চুরির মামলায় গ্রেফতার হয়ে কিশোর সংশোধনাগারে এসেছিল নূরুল ইসলাম। ১ জুলাই সন্ধ্যায় তার কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, পরিধানের লুঙ্গি পেঁচিয়ে সে গলায় ফাঁস দিয়েছে। বিকেল ৪টার দিকে সংশোধনাগারে আটক অন্য কিশোর-কিশোরীরা যখন মাঠে খেলাধুলা করছিল, নূরুল ইসলাম তখন আত্মহত্যার লক্ষ্যে গলায় লুঙ্গি পেঁচাচ্ছিল।
কেস স্টাডি (দুই) : একজন সিনিয়র সহপাঠীকে জড়িয়ে ফেসবুকে আপত্তিকর কথাবার্তা লেখা হয়েছিল রাজধানীর তুরাগ থানাধীন কামারপাড়া হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী জেরিন আক্তার সম্পর্কে। স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টির প্রতীকার করেনি; বরং উল্টো জেরিনকেই ঘটনার জন্য দায়ী করেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক খুরশিদ জাহান ও অন্য শিক্ষকরা। জেরিনকে অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেন প্রধান শিক্ষক। এ ঘটনায় ১৪ এপ্রিল গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে জেরিন। এ ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা ভয়ভীতি দেখিয়ে জেরিনের পরিবারকে নিবৃত রাখে মামলা থেকে। জেরিন একজন স্কাউট ছিল। ২০১৯ সালের জাম্বুরিতে সে ছিল ক্যাপ্টেন।
কেস স্টাডি (তিন) : সহপাঠী প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় টাঙ্গাইল কালিহাতির পোষণা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন (১৬)। গোপালদীঘি হাইস্কুল থেকে এবার তার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অভিমানে দেলোয়ার আত্মহত্যা করে।
বিশেষজ্ঞ অভিমত : কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের আত্মহত্যার এসব কারণ বিশ্লেষণ করে ‘ড্রাগ অ্যান্ড ফ্যামিলি কাউন্সেলিং স্পেশালিস্ট’ ড. কামরুন মোস্তফা বলেন, পরিবারের সদস্য এবং স্বজনদের সঙ্গে মনস্তাত্তি¡ক দূরত্ব একটি বিষয়। এখনকার কিশোর-কিশোরীরা কিছুটা রোবোটিক সাইকোলজির হয়ে থাকে। বিশেষ করে নগরে বসবাসকারী পরিবারের কিশোর-কিশোরীরা সাইবার জগৎ নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকে। সাইবার জগতের প্রতি বেশিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার কারণে কাছের মানুষটিও তাদের কাছে গৌণ বিষয় হয়ে যায়। সাইবার জগৎ কেড়ে নিচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ ও কৈশোর। ফলে পারিবারিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি কিংবা পরিবারের সদস্যদের প্রতি মমতা তৈরি হয় না। আত্মহত্যাও তার কাছে একটি গেমের মতো। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে তারা আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
তিনি বলেন, আমরা অভিভাবকরা ভাবি, আমার ছেলেটি কিংবা মেয়েটি সর্বগুণে গুণান্বিত হয়ে ‘মানুষের মতো মানুষ’ হোক। এ কারণে বাচ্চাগুলোকে নিয়মিত পড়াশোনার বাইরে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সবকিছুতে প্রথম হওয়ার জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করি। এত কিছু করতে গিয়ে বাবা-মায়েরা ভাবেন না, ছেয়ে-মেয়েদের ওপর কতটা মানসিক চাপ পড়ছে। ফলে ‘কিছুই পারছি না’ এমন মনোভাব অনেক কিশোর-কিশোরীকে ঠেলে দেয় আত্মহননের দিকে। এটি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
এনাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. দেওয়ান আব্দুর রহীম বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০.৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। এ হিসেবে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লাখের মতো। তাদের সুষ্ঠু বিকাশের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য পরিচর্যা জরুরি। এর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ এ বিষয়ে আমরা অত্যন্ত উদাসীন। ছেলে-মেয়েদের আমরা অনেক কিছুই শেখাই না। বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের প্রস্তুত করে তুলি না। বয়ঃসন্ধির সময় হরমোন এবং শারীরিক পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীদের মাঝে মনস্তাত্তি¡ক সঙ্কট দেখা দেয়। এ সঙ্কট এতটাই ভয়াল আকার ধারণ করে যে, কোনো ব্যর্থতার ঘটনা তারা সহ্য করতে পারে না। পলায়ন মনোবৃত্তি কাজ করে। একপর্যায়ে আত্মহননের মতো সর্বনাশা রূপ নেয়। বর্তমানে বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে-মেয়েদের মাঝে সহনশীলতার খুব অভাব। অপরিণত আবেগ বেড়েছে। সহনশীলতা সৃষ্টি হয় আবেগ থেকে। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে যদি বিপত্তি আসে, তাহলে সহনশীলতার অভাব হয়। এই মনস্তাত্তি¡ক বিপর্যয়ই আত্মহত্যার কারণ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।