Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মূল্য বিপর্যয় এবং কাঁচা চামড়া রফতানি প্রসঙ্গে

| প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারো ঈদুল আজহায় কোরকানির পশুর চামড়ার মূল্য বিপর্যয় ঘটেছে। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্যে এতটা বিপর্যয় অতীতে আর কখনো ঘটেনি। কোরবানির আগে থেকেই চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটেড কারসাজি ও মূল্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। ঈদের সময় সীমান্ত দিয়ে ভারতে চামড়া পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সব সময়ই থাকে। এ ক্ষেত্রে চামড়া পরিবহনসহ সীমান্তপথে অতিরিক্ত সর্তকতা আরোপ করতেও দেখা যায়। এবার সে সব বিষয় আলোচনায় আসেনি। তবে সোমবার ঈদের দিন থেকে চামড়ার মূল্য বিপর্যয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবচেয়ে ভাইরাল ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক দশক আগেও যেখানে মাঝারি আকারের একটি গরুর চামড়া ২ হাজার টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। সেখানে গত বছর কোরবানি ঈদে তা ৫-৬শ টাকায় নেমে আসলে তুমুল সমালোচনা ও বাদ-প্রতিবাদ দেখা যায়। সরকারের জন্যও বিষয়টি বেশ অশ্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এহেন বাস্তবতায় গত কোরবানি ঈদের পর তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়ের আহমদ বলেছিলেন, কাঁচা চামড়া রফতানির কোনো চিন্তা সরকারের নেই। এ বছর অস্বাভাবিক মূল্য বিপর্যয়ের পর সরকারের সে চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। গত বছরের মত এবারো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য ঠিক করে দিয়েছিল। কিন্তু সরকার যেন মূল্য ঠিক করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। প্রান্তিক জনগন ও খুচরা ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে কি না সে ব্যাপারে নজরদারি বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় এক-দু’শ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। এমনকি লোকসানে ক্ষুব্ধ হয়ে এবং ক্রেতার অভাবে ফেলে দেয়া হাজার হাজার চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং স্থানীয় প্রশাসন।

চামড়া শিল্পের মূল কাঁচামাল পশুর চামড়ার এমন অপচয়, অবমাননা অভাবনীয়। কোরবানির ঈদের সময় প্রায় এক কোটি পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়, যা সারা বছরে সংগৃহীত চামড়ার প্রায় অর্ধেক। কোরবানির পশুর চামড়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক। একদিকে তা রফতানিমুখী চামড়া শিল্পের মূল ভিত্তি অন্যদিকে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকার পুরোটাই দেশের সব মাদরাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং, এতিম খানা ও হতদরিদ্র মানুষের প্রয়োজনে ব্যয়িত হয়ে থাকে। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিলব্ধ হাজার কোটি টাকা ধর্মীয় শিক্ষা ও ছিন্নমূল মানুষের টিকে থাকা ও ভাগ্যন্নোয়নে ব্যাপক ভ‚মিকা পালন করে এসেছে। কোরবানির সময় চামড়ার বাজারে সিন্ডিকেটেড বিপর্যয় সৃষ্টির মধ্য দিয়ে যাদেরই ফায়দা হাসিল হোক না কেন, এর মধ্য দিয়ে সবচে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এতিম ও অতি দরিদ্র শ্রেণীর প্রান্তিক মানুষ। শেয়ার বাজারের সিন্ডিকেট যেমন হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারিকে দেউলিয়া করে দিয়েছে, একইভাবে চামড়া সিন্ডিকেট দেশের হাজার মাদরাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও অতি দরিদ্র এতিম-মিসকিনের পেটে লাথি মেরে তাদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। বেসরকারি উদ্যোগে দেশের হতদরিদ্র প্রান্তিক মানুষের মধ্যে লাখ লাখ গরু-মহিষ ও ছাগলের গোশত এবং এসব পশুর চামড়া বিক্রি থেকে প্রাপ্ত শত শত কোটি টাকার সুষ্ঠু বিলি বন্টনের এমন ব্যবস্থাপনা আর কোথাও নেই। দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা উন্নয়নসহ প্রান্তিক মানুষের সামাজিক নিরাপত্তায় গৃহিত সরকারের উদ্যোগগুলোর পরিপুরক। সরকারি উদ্যোগের চেয়ে এই সামাজিক-ধর্মীয় উদ্যোগ অনেক বেশি সফল ও কার্যকর। চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটেড মুনাফাবাজ চক্র এই সুন্দর মহত্তম উদ্যোগটিকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে।

এক সময় সোনালী আঁশ নামে খ্যাত পাট শিল্প বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত ছিল। শতভাগ নিজস্ব কাঁচামালের উপর গড়ে ওঠা পাটের বিশ্ববাজার ছিল বাংলাদেশের একচ্ছত্র দখলে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে একটি চক্রের অপরিনামদর্শি কর্মকান্ডে আমাদের পাটশিল্প তার বাজার এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা হারিয়েছে। লোকসানের মুখে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলো যখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময় প্রতিবেশি ভারতে একের পর এক নতুন পাটকল গড়ে উঠেছিল। সে সব পাটকলের কাঁচামালের যোগান দিত বাংলাদেশের পাট ব্যবসায়ীরা। দেশের চামড়া শিল্পের আধুনিকায়ন ও পরিবেশগত সুরক্ষায় সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নতুন চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তুলেছে। সাভারে গড়ে তোলা এই চামড়া শিল্প নগরী এখনো পুরোপুরি চালু হওয়ার আগেই আমাদের চামড়া খাতে একটি কৃত্রিম সংকট তৈরী করা হচ্ছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। চামড়া মূল্য বিপর্যয় নিয়ে আড়তদার ও টেনার্স এসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা পরস্পরকে দায়ী করছেন। সেই সাথে লবন ব্যবসায়ীদের একটি চক্রও লবণের অস্বাভাবিক মূল্য বাড়িয়ে চামড়া শিল্পে এক ধরনের পরিকল্পিত সংকট সৃষ্টিতে ভ’মিকা রাখছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশের প্রথম সারির সম্ভাবনাময় রফতানিমুখি শিল্প হিসেবে এবং কোটি কোটি হত দরিদ্র মানুষের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে চামড়া শিল্পের সিন্ডিকেটেড বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। অস্বাভাবিক মূল্য বিপর্যয়ের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে লাখ লাখ চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা অথবা বানের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। শত শত কোটি টাকার সম্পদের এমন অপচয় মেনে নেয়া যায় না। এহেন বাস্তবতায় কাঁচা চামড়া রফতানির পরিকল্পনাকে যথার্থ বলে গণ্য হলেও রফতানিমুখী চামড়া শিল্পের বিকাশ এবং আগামি কয়েক বছরের মধ্যে এ খাতে রফতানি আয় ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার সরকারি লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়ন করতে হলে কাঁচা চামড়া রফতানির সুযোগ খুবই সীমিত। তবে প্রান্তিক মানুষের স্বার্থে এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাচ্ছে না। কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যয্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাশাপাশি টেনারি মালিক, আড়তদার বা অন্য যে কেউ কারসাজির মাধ্যমে বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য দায়ী হোক, উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাঁচা চামড়া রফতানি
আরও পড়ুন