Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার ও স্বরূপ

প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. এ এইচ এম মোস্তাইন বিল্লাহ

॥ পাঁচ ॥
এ প্রসঙ্গে ওক্সিডেস্টালিস্ট ও ওরিয়েন্টালিস্ট বিরোধের কিছু ইতিহাস জানা আবশ্যক।
খড়ৎফ ইবহঃরহপশ ধ এড়াবৎহড়ৎ এবহবৎধষ ড়ভ ওহফরধ ভারতীয়দের শিক্ষিত করতে মোটেও আগ্রহী ছিল না। তিনি এ দেশে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশকে বিপজ্জনক মনে করতেন (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ বফঁপধঃরড়হ রহ ওহফরধ. পৃ: ৬৩ তারিখ মার্চ ১৩, ১৮৩৫)।
স্যার চার্লস ম্যাট্কাফ মে ১৬, ১৮৩৫ সালে গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্টিত হয়ে বলেছিলেন যে, আমি বরং অজ্ঞতাকে বিপজ্জনক মনে করছি। তিনি আরো বলেন অজ্ঞতা, কূপম-ূকতা ও বর্বরতা বরং বেশী বিপজ্জনক। লর্ড বেন্টিক ভারতীয়দের শিক্ষিত করার চেয়ে বিভক্তি করণে বেশী আগ্রহী ছিলেন এবং সমজাতীয় (ঐড়সড়মবহরড়ঁং) জাতি না করে শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টিতে আগ্রহী ছিলেন (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ বফঁপধঃরড়হ রহ ওহফরধ. পৃ : ৬৫)
তৎপ্রেক্ষিতে তিনি ইংরেজি ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করেন ঞযব ঈড়ঁৎঃ ড়ভ উরৎবপঃড়ৎং রহ ঃযবরৎ ষবঃঃবৎ, ফধঃবফ ঝবঢ়ঃ ২৯, ১৮৩০ ঃড় ইবহমধষ, ৎিড়ঃব:
উপরিক্ত পর্যালোচনা থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, বৃটিশরা এক তরফাভাবে তাদের প্রশাসনিক সুবিধার্থে ইংরেজি ভাষা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করে। এক্ষেত্রে মিলিয়ন ভারতীয় নাগরিকদের সুবিধার বিষয়টি মোটেও বিবেচনায় রাখা হয়নি। ইংরেজি শাসকের ভাষা শিখতে হবে, জানতে হবে এটাই বড় কথা। এই বিষয়ে দুই কমিটি ও গঠন করো হয়েছিল;
উভয় কমিটিই ইংরেজি ভাষা শিক্ষার জন্য এবং ইংরেজি ভাষার ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য বিশেষ কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। কমিটি আরো গুরুত্বারোপ করে যে একমাত্র ইংরেজির মাধ্যমেই জীবনের শুরু থেকে তাদের (ভারতীয়দের) জ্ঞানার্জন করতে হবে। ইংরেজি মাধ্যমে ইউরোপীয় জ্ঞান চর্চা করতে হবে, স্থানীয় ভাষা সাহিত্য ও অধ্যয়ন করা যাবে, তবে তা হবে ইংরেজি কলেজের অধীনস্থ জ্ঞানের শাখা হিসেবে। এর বাইরে যা কিছু শেখানো বা পড়ানো হবে, তাদের সুবিধাজনক ইউরোপীয় বিজ্ঞানের উপাদান এবং ইউরোপীয় ভাষায়। (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ বফঁপধঃরড়হ রহ ওহফরধ. পৃষ্ঠা ৬৭)
উপরোক্ত যুক্তির ভিত্তিতে দুইটি ইংরেজি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। একটি ইংলিশ কলেজ দিল্লিতে; অন্যটি বেনার্সে। কলকাতায় কলেজ প্রতিষ্ঠা প্রকল্পটি কৌশলে বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। এসব কলেজ পাঠ্যপুস্তক ও ইউরোপীয় ধারায় তৈরী করা হত। এযুক্তিতে তারা ইংরেজি কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাচ্যের স্থানীয় কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখা হয়েছে। এ সব কলেজের শিক্ষার্থীও ছিল ভিন্ন শ্রেণীর। ইউরোপীয় ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ফলে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থের সাথে সরাসরি সংঘাত কমিয়ে আসছে। ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান চর্চা দ্রুত সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আরো বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হল।
“ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান চর্চা করা হলে জ্ঞানার্জনে অগ্রগতি দশগুণ বেড়ে যাবে। ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানার্জন করলে সে অতি সহজে স্থানীয় ভাষায় তার দেশের লোকদের সহজে সে জ্ঞানে আলোকিত করতে পারবে। এ লক্ষার্জনের প্রথম ধাপ ছিল বোম্বেতে একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে, ভূগোল, ইতিহাস এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞান শাখাগুলি ইংরেজি মাধ্যমে অধ্যয়ন করা হত। পক্ষান্তরে, ঝরৎ ঔড়যহ গধষপড়ষস এড়াবৎহড়ৎ ড়ভ ইড়সনধু রহ ১৮২৮, শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি করার পক্ষে ছিলেন না। ১৮২৩ সালে তার নোটে উল্লেখ করেন। একান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ভারতীয়দের শিক্ষাদানের বিষয় তিনি অনাগ্রহী ছিলেন; (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ বফঁপধঃরড়হ রহ ওহফরধ; পৃ : ৭৩)
ইৎরঃরংয ওহফরধ-এর সুপ্রীম গভার্নমেন্ট গধপধঁষধু’ং গরহঁঃব’ং লিখেছেন: ঋড়ৎঃ ডরষষরধস, এবহবৎধষ ঈড়ঁংঁষঃধঃরড়হং. ৭ঃয সধৎপয ১৮৩৫; (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ বফঁপধঃরড়হ রহ ওহফরধ. পৃ : ৮৪)
ম্যাকাওলেস্ (গধপধঁষধু’ং গরহঁঃব’ং) মিনিটসে বৃটিশ-ইন্ডিয়া সরকারের নি¤েœাক্ত ইচ্ছে গুলি ব্যক্ত করা হয়েছে:
১. ভারতীয়দের মধ্যে ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উন্নয়নে, শুধু ইংরেজি শিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত সকল অর্থ ব্যয় করতে হবে;
২. বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তারা ভঙ্গ করতে চায় না, শিক্ষার্থী ও প্রফেসরগণ তাদের স্টাইফেন্ড ও গ্রহণ করতে পারবে, কিন্তু তারা প্রাকটিস করতে পারবে না। কেননা তারা মনে করে তাতে শিক্ষা বিভাগে কৃত্রিম উৎসাহের সৃষ্টি করতে পারে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে যারা যাবে তাদের স্টাইপেন্ড দেয়া হবে না;
৩. গভর্নর জেনারেল যখন জানতে পারল যে, প্রাচ্য ছাপা কাজে তাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে, তখন এরূপ খরচ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বারণ করা হল;
৪. গভর্নর জেনারেল আরো নির্দেশ দিলেন যে, এখন থেকে সংশ্লিষ্ট তহবিলের অর্থ শুধু ইংরেজি ও ইউরোপীয় বিজ্ঞান শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হবে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ঐড়ৎধপব ঐধুসধহ ডরষংড়হ ড়হ ঔঁষু ৫, ১৮৫৩ বলেন: (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ বফঁপধঃরড়হ রহ ওহফরধ. পৃ ৮৫-৮৭) “ম্যাকাউলে এর প্রতিভার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। তিনি ভারতে নবাগত, এদেশের মানুষ সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণা নেই। তিনি শুধু তাঁর চতুর্পাশের অবস্থান দেখে বিষয়টি বিচার করে নিরবচ্ছিন্ন ইংরেজি ভাষায় এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন যুক্তি প্রদান মারাত্মক ভ্রম। তারা শুধু বড় বড় কয়েকটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর সম্পর্কে পরিচিত, যারা ইংরেজি চর্চা করে। তারা সাধারণ জনগোষ্ঠীর চাহিদা জানে না। একজন সাধারণ যুবকের অভিমত নেয়া হলে দেখা যাবে যে, সে ইংরেজিতে কথা বলে এমন লোকের সাথে সম্পর্ক রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না; সে তার নিজস্ব ভাষায় সকল জ্ঞান আহরণ করতে চায়, বিশেষত আইন, ব্যবসা/বাণিজ্য এবং সাধারণ মানুষের আচার ও বৈশিষ্ট্য (অবশ্য ইংরেজিতে তার অপছন্দ নয়)। তাই ইংরেজি ব্যাপক অর্থে এ দেশের সর্ব সাধারণের জন্য কোন উপকারী ভাষা নয়। বিশেষত রাষ্ট্রীয় এবং বড় শহরের সীমানার বাইরে। কেননা এসব রাষ্ট্রীয় পরিবেশে বড় শহরের সভ্যতা তো ইতোমধ্যে ইউরোপীয় সমাজে রূপান্তরিত।
ইউরোপীয় জ্ঞানের চর্চা হতে পারে তা একমাত্র ইংরেজি ভাষার সীমাবদ্ধ হওয়াটা মোটে ও শোভন হবে না। এর ফলে ইংরেজ স্কলার একটি শ্রেণী সৃষ্টি হবে এবং সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে। যাদের এদেশের এবং সমাজের প্রতি কোন অনুরাগ বা সহমর্মিতা থাকবে না। আমাদের হাতে আরো অতিরিক্ত উপাদান থাকা উদ্বৃত্ত যা আমাদের শেষ পর্যন্ত অধিক সুবিধা দিবে” (ঐরংঃড়ৎু ড়ভ বফঁপধঃরড়হ রহ ওহফরধ. পৃ : ৮৫-৮৭)। কিন্তু বৃটিশ ভারত শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ শ্রেণী সৃষ্টি করা, যারা ইংলিশ স্কলার হবে, তাদের এদেশের মানুষের প্রতি কোন মমতাবোধ থাকবে না। মি: ম্যাকাউলে এর পক্ষেই যুক্তি উপস্থাপন করেছেন এবং অনুমোদন ও পেয়েছেন। মি: ডরষংড়হ বলেন; তাঁর (ম্যাকাউলে) লেখা যুক্তিটি পড়ার আমার সুযোগ হয়েছে; যা অত্যন্ত সুচতুরভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে; “তাঁর সম্পূর্ণ লেখাটি ছিল বিবেকহীন ও আন্তরিকতাহীন এবং সে বিষয়টি এদেশের জ্ঞান ও সংস্কৃতিতে একেবারেই অনবিজ্ঞ লোকের, তার লেখায় এ বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছিল।”
শেষ পর্যন্ত এর পরিণতি ও হয়েছিল ভয়াবহ। ভারতের মানুষ বৃটিশ শাসনের প্রতিকূল পরিবেশে থাকার ফলে তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ ও ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। উপরোক্ত সীদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত বরাদ্দকৃত অর্থ শুধু মাত্র ইংরেজি শিক্ষার জন্য খরচ করা হবে। এর ফলে স্থানীয় শিক্ষা সম্প্রসারণে সকল প্রতিষ্ঠানের সকল বরাদ্দ বাতিল হয়ে যায়; দরিদ্র বিবেচনায় যে সকল শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়া হত সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে অত্যন্ত অসন্তষ্টি সৃষ্টি হয়। পরিশেষে, তারা অত্যন্ত প্রতিবাদী ও হয়ে উঠেছিল, বিশেষত মুসলমান জনগোষ্ঠী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ