চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ড. এ এইচ এম মোস্তাইন বিল্লাহ
॥ দুই ॥
প্রায় ২২৬ বিশ^বিদ্যালয় এবং হাজারেরও বেশী কলেজ যেগুলো এসব বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে একিলিয়েটেড ছিল। তাছাড়া ৪২৮টি ইঞ্জনিয়ারিং কলেজ ও কারিগরি প্রতিষ্ঠান এবং ১০০টি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা, এছাড়া কৃষি ইনস্টিটিউট রয়েছে অগণিত।
পাশ্চাত্য শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা মাদ্রাসা শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ও সংকোচিত করেছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটরা চাকরির বাজারকে একচ্ছত্রভাবে দখল করে রেখেছিল। মুসলিম শাসনের পতনের পর থেকেই মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি ব্যাপকভাবে সংকোচিত হয়ে গিয়েছিল। কৌশলে বৃটিশরা বৃষ্টি ঝরা মাদ্রাসা শিক্ষার কারিকুলাকে, ইসলামী এতিম, আরবী, ফার্সি, উর্দু এসব বিষয়ে মধ্যে সীমিত করে রেখেছিল। মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষকতাও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে তাদের ভাগ্যান্নেষণ করতে হয়েছিল, অন্য কিছুসংখ্যক মসজিদের ইমাম হিসেবে নিজেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল।
ইসলামে নারী শিক্ষাসহ শিক্ষা সার্বজনীন ও আবশ্যিক
খেলাফতে আব্বাসিয়া যুগে ৭৫০ সাল থেকে মুসলিম মহিলাদের প্রজ্ঞা ও সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে সুনাম খ্যাত সামাজিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। বিশেষজ্ঞ অনেক মহিলারা শিশুকাল থেকে গান, নাচ ও কবিতা চর্চায় প্রশিক্ষণ লাভ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো “তাওয়াদুদ” নামক মহিলা যে একজন ক্রীতদাসী ছিলেন। তাকে খলিফা হারুন উর রশীদ চড়া মূল্যে ক্রয় করেছিলেন কারণ সে জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, আইন, সঙ্গীত, ইতিহাস, আরবী গ্রামার, সাহিত্য ও দাবা সকল বিষয়ের পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সাথে পাস করেছিলেন। অন্য একজন খ্যাতিমান স্কলার মহিলা ছিলেন যার নাম “সুধা” যিনি দ্বাদশ শতাব্দীতে বাগদাদে চৎরফব ড়ভ ড়িসবহ বলে পরিচিতি ছিলেন। আব্বাসী যুগে মহিলাদের খ্যাতি যোগ্যতার স্বীকৃতির পর সবকিছু পরিসমাপ্তি ঘটে ১২৫৮ সালে বাগদাদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, ইসলামের সকল ঐতিহ্য ও আদর্শের নমুনা নিশ্চিহ্ন করার জন্য একবিংশ শতাব্দীর মত একাদশ শতাব্দীতে ও ইরাকের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞসহ ইসলামী লাইব্রেরী ধ্বংস করে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে ইয়াদুদী ও মুসলমানদের দুশমনেরা।
মুসলিম অনেক মহীয়সী নারী ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ফাতিমা আল ফিহরি, তিনি আল কাবাউয়িন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন ৮৫৯ সালে। এ ধারা উমাইয়া শাসনামলের দ্বাদশ ও ত্রৈয়দশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তৎকালীন সময় দামেস্কে ১৬০টি মুসলিম ও মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে ২৬টি মুসলিম মহীয়সী নারীরা প্রতিষ্ঠিত করেছেন ওয়াকফ এর মাধ্যমে। তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের ও বেশী চধঃৎড়হ ছিলেন মহিলা।
দ্বাদশ শতাব্দীর সুন্নী স্কলার ইবনে আসাকির এর মতানুসারে ইসলামে বিশ্বের মধ্যযুগে নারী শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ছিল। সেকালে মহিলারা লিখতেন, পড়তেন তারা শিক্ষাগত ডিগ্রি অর্জন করতে পারতেন। তাদের অনেকে যোগ্যতাসম্পন্ন স্কলার ও শিক্ষক ছিলেন, স্কলার পরিবারের মহিলারাই এক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। এসব পরিবারে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য না করে ছেলেমেয়ে, নির্বিশেষে তাদের সর্বোচ্চ ডিগ্রি সুযোগ করে দিতেন। উল্লেখ্য, ইবনে আসাকির নিজে তৎকালীন ৮০ জন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ মহিলা শিক্ষকের কাছে পড়েছেন। আমাদের মহানবী (সা:) স্ত্রীরাই ইসলামী বিশ্বে নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতো। যেমন হযরত খাদিজা (রা:) অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। হাদিসে রয়েছে নবী (স:) মদিনার মহিলাদের ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের আগ্রহী ছিলেন বলে প্রশংসা করেছিলেন। “কি চমৎকার না আনসার রমনীগণ, জ্ঞানার্জনে লজ্জা তাদের জন্য কোন বাধা নয়।”
পঞ্চদশ শতাব্দীতে আল শাকাত্তরী বার ভলিয়মের নরড়মৎধঢ়যরপধষ ফরপঃরড়হধৎু ধষ উধি ধষ ধষস ঃড় ভবসধষব ংপযড়ষধৎং প্রকাশ করেছেন তাতে প্রায় ১০৭৫ জন স্কলার মহীয়াসী নারীর তালিকা রয়েছে। ঙীভড়ৎফ পবহঃবৎ ভড়ৎ ওংষধসরপ ংঃঁফরবং-এর গবেষক মহাম্মদ আকরাম নদভী ৪০টি ভলিয়ম লিখিছেন মহিলা মোহাদ্দেছের বিষয়ে তাতে তিনি আট হাজার মহিলা স্কলারের বিষয় বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে হাদিছে রয়েছে “সেই ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে উত্তম যে কোরান শিখে এবং শিক্ষা দেয়”। এই ঈমানি দায়িত্ব নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য বাধ্যতামূলক ও আবশ্যক । জ্ঞানার্জন ও তা অন্নেষণের জন্য সুদূর চীন দেশের মত দূর দেশে গিয়ে তা অর্জনের জন্য ইসলামে তাকিদ দেয়া হয়েছে। এ তাগিদটি ও নারী-পুরুষ নির্বিেিশষে সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য, এক্ষেত্রে তথাকথিত নারীবাদী ও প্রগতিশীলদের কাছে প্রশ্ন, ইসলাম ছাড়া বর্তমান বিশ্বে আর কোন এমন পুরানো সভ্যতা রয়েছে যা মানব সভ্যতার এতো আদিলগ্নে নারী পুরুষ সমঅধিকার নিশ্চিত করার আবশ্যিকভাবে তাগিদ দিয়েছে । সকল সভ্যতার ঊষালগ্নে ফেরাউন, নমরুদ, আবুজাহেল এবং আবুলাহাবদের মত খোদাই দুশমন রয়েছে যাদের অনুসারীদের সংখ্যা শেষ যমানায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নারী শিক্ষা, নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়নের ও প্রগতির নামে নারীকে বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন কাজে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। ইসলাম আল্লার বিধান কখনো তা অনুমোদন করে না।
ইসলামের উষ্ণালগ্ন থেকেই শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে এবং বিভিন্নভাবে শিক্ষা লাভ ও বিস্তারের জন্য উৎসাহিত করে আসছে। ইসলামে শিক্ষার একটি বুদ্ধিমত্তার বিরাট ঐতিহ্য ও দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জ্ঞান বিজ্ঞান ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে সৃষ্টির শুরু থেকেই। ইসলামের পরিবত্র গ্রন্থ কোরান ও হাদিসে এ বিষয়ে আটশর ও বেশী রেফারেন্স খুঁজে পাওয়া যাবে। পবিত্র কোরআনে বহু জায়গায় শিক্ষা সম্বন্ধে বারবার করে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। আর এ নির্দেশ ও গুরুত্বপূর্ণ যা নারী-পুরুষ সকলের জন্য সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য স্ব-স্ব অধিক্ষেত্রে অবস্থান করে। তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন; তোমরা যা কর আল্লাহ সে সব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত আছেন। মুজাদিলা (৫৮ : ১১) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে: “হে প্রভূ আমার জ্ঞান বৃদ্ধিকর” সূরা ত্বোয়াহা আয়াত ১১৪ (২০ : ১১৪)
সূরা বাকারা বলা হয়েছে “আল্লাহ যা শিখিয়েছে তা লিখে নাও” বাকারায় (২ : ২৮২)। হাদিছে রয়েছে জ্ঞানার্জনে সুদূর চীন দেশে হলে সেখানে যাও । আরো রয়েছে যে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে কোরান পড়ে এবং পড়ায়।
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে অন্যান্য সকল শিক্ষা ব্যবস্থার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার প্রধান কারণ হল এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক সম্পূর্ণ কোরান সুন্নাহ ভিত্তিক, কেননা ইসলাম শুধু ধর্ম নয়। ইহা একটি সম্পূর্ণ জীবন বিধান ঈড়সঢ়ষবঃ পড়ফব ড়ভ ষরভব ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সকল পার্থিব ও পরলৌকিক বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীলনকশা দিয়েছে। কোরান তথা ইসলাম সপ্তম শতাব্দীর নিরক্ষর আরব সমাজে ব্যাপক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের যুগে আরব সমাজে বাগ্মিতা সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু কোরান আল্লাহর বাণী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তা অধ্যয়ন ও গঠন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই কোরান বুঝা ও সে অনুসারে জীবন বিধান অনুসরণের লক্ষ্যে লেখা ও পড়া মুসলমানদের একান্ত অপরিহার্য কর্তব্য। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোন বিধানের অর্থাৎ জ্ঞানার্জনে নারী-পুরুষের কোন বৈষম্য সৃষ্টি করার সুযোগ নেই।
মুঘলামলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা মাদ্রাসা শিক্ষা সম্প্রসারণ
মুঘল শাসনামলে (১৫৫৬-১৮৫৪) মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ঐতিহাসিক তথ্য পার্যালোচনায় দেখা যায় যে, মুঘল শাসনামলে ১৫৫৬-১৮৫৮ সাল পর্যন্ত সময়ে মাদ্রাসার সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। যা দুই শতাব্দী রেকর্ড ছাড়িয়ে ছিল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।