Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ত্রাণের জন্য হাহাকার

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

দেশের বন্যা পরিস্থিতি আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। লাখ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত। অনেকের ঘরবাড়ি পানির নিচে। কোথাও কোথাও মানুষ ঘরের চালে, বেড়িবাঁধে বা উঁচু কোনো স্থানে গরু-ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। খাবার পানির সঙ্কট, কোনো কোনো জায়গায় মানুষ না খেয়ে আছে। নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ চরমপর্যায়ে পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে ৩০ জেলা কমবেশি বন্যাকবলিত। এর মধ্যে কয়েকটি জেলা গত ২-৩ দিনে আক্রান্ত হয়েছে। অন্তত ২৮ জেলার ৩০ লাখ মানুষ সর্বনি¤œ এক সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ ধরে বন্যার সঙ্গে লড়ছেন। এ দিকে ত্রাণ দেয়ার ভয়ে অনেক জেলার সরকারি দলের এমপিরা গা-ঢাকা দিয়েছেন।

অন্যদিকে শুকনো খাবার ও নগদ টাকা চেয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি পাঠিয়েছেন ডিসিরা।
পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মধ্যাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। অপরদিকে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে থাকায় উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যেতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। গতকাল শনিবার বৃষ্টিপাত ও নদনদীর অবস্থা নিয়ে দেয়া প্রতিবেদনে সতর্কীকরণ কেন্দ্র এ তথ্য জানিয়েছে।

উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বন্যার পানি বৃদ্ধি ১৯৮৮ সালের বন্যাকেও হার মানিয়ছে। যদিও ওই বন্যার তুলনায় এবার উজান থেকে পানি কম এসেছে। কিন্তু বন্যার বিস্তৃতি ও স্থায়িত্ব বেড়েছে। এ সময়ে সাধারণ বন্যার স্থায়িত্ব ৮ থেকে ১২ দিন থাকে। এবার তা এরই মধ্যে দুই সপ্তাহ অতিক্রম করেছে। আরও এক সপ্তাহ এই পানি থাকতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ বলছে, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০১৪ সালের বন্যা বাংলাদেশের বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত। ওই বছরগুলোতে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি এসেছিল ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ কিউসেক। কিন্তু এ বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবে ৭০ হাজার কিউসেক পানি এসেছে। অথচ বন্যায় আক্রান্ত এলাকা ও পানির উচ্চতা ১৯৮৮ সালের চেয়ে এবার বেশি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ কামাল ইনকিলাবকে বলেন, বন্যায় ৩০ লাখ মানুষ আত্রান্ত হলেও সকলেই ত্রাণ চায় না। কোথাও ত্রাণের জন্য হাহাকার নেই। বানভাসি অভাবী মানুষের জন্য ৩০ হাজার মে.টন চাল এবং ১২ কোটি টাকা ৩০ জেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০ জেলার ডিসিদের কাছে ১০ লাখ টাকা ও ২৫০ মে.টন চাল মজুদ রয়েছে। ডিসিরা বিতরণ কাজ শুরু করেছেন। এখনো অনেক জেলায় বন্যা রয়েছে।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে গত তিন দিন বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও মানুষ রয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগে। লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন বানভাসি অভাবী মানুষ। ত্রাণবাহী কোনো নৌকা দেখলেই হামলে পড়ছেন তারা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। দুর্গম চরাঞ্চলের অনেক এলাকায় সরকারি- বেসরকারিভাবে কোনো ত্রাণই পৌঁছেনি। লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষের মাঝে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অনেকের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সহায়-সম্বল নিয়ে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র, বাঁধ বা উঁচু স্থানে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। কেউ বা নৌকায় আশ্রয় নিয়ে দিনের পর দিন পানিতে ভাসছেন। বন্যার্ত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে আরও ভয়ঙ্কর দুসংবাদ নিয়ে এসেছে পানিবাহিত রোগ। ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে রয়েছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। মিলছে না সুপেয় পানি ও পর্যাপ্ত ওষুধ। অনেক এলাকায় মেডিক্যাল টিম কাজ করলেও সংখ্যায় অনেক কম হওয়ায় সবার ভাগ্যে জুটছে না স্বাস্থ্যসেবা।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভ‚ঁইয়া ইনকিলাবকে জানান, গঙ্গা-পদ্মা এবং ঢাকার চারপাশের নদ-নদী ছাড়া অন্যান্য সব প্রধান নদ-নদীর পানি কমছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীগুলোর পানি কমতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানির বৃষ্টি ব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদী সুরেশ্বর পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। পদ্মার পানি বৃদ্ধির কারণে মধ্যাঞ্চলের মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় টাঙ্গাইল এবং সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। একই সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা এবং উত্তর-প‚র্বাঞ্চলের নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, যমুনা নদীর পানি ফুলছড়িতে ১২৯ সেন্টিমিটার, বাহাদুরাবাদে ১৩৭ সেন্টিমিটার, সারিয়াকান্দিতে ১১৬ সেন্টিমিটার, কাজিপুরে ১১১ সেন্টিমিটার ও সিরাজগঞ্জে ৯৩ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি নুনখাওয়া ও চিলমারী পয়েন্টে এবং পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ ও ভাগ্যক‚ল পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ, কুশিয়ারার পানি শেরপুর-সিলেট, পুরনো সুরমার পানি দিরাই, তিতাসের পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মেঘনার পারি চাঁদপুর, ধরলার পানি কুড়িগ্রাম, ঘাঘটের পানি গাইবান্ধা, করতোয়ার পানি চকরহিমপুর, আত্রাইয়ের পানি বাঘবাড়ি, ধলেশ্বরীর পারি এলাশিন পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বগুড়া জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহাম্মদ ইনকিলাবকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটর করা হচ্ছে। এ জেলার জন্য ৬০০ মে.টন চাল এবং দশ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪০০ মে.টন চাল বিরতণ করা হয়েছে। আশা করছি ত্রাণের কোনো অভাব হবে না।

গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিন ইনকিলাবকে জানান, দুই পৌরসভা এবং ৩৯টি ইউনিয়নের ৩৬৩টি গ্রামে পানি ঢুকে পড়ায় প্রায় ৩ লাখ মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। নতুন করে ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এখন ১৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রে মোট আশ্রিতের সংখ্যা দাঁড়াল ৭৩ হাজার ৮০৪ জন। এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ৫০ মে.টন চাল এবং ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এগুলো বিতরণ করা হচ্ছে। নতুন বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন বলেন, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আজ রোববার জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। এ জেলায় সাড়ে সাত লাখ মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। সরকারিভাবে ত্রাণ সমস্যা নেই। তবে শুখনো খাবার এবং গবাদি পশুর খাদ্য সঙ্কট রয়েছে। আরও ত্রাণসামগ্রীর জন্য চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া মাত্রই তা বিতরণ করা হবে।

সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ জানান, উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে আছে লক্ষাধিক মানুষ। গবাদি পশু নিয়ে কেউ কেউ রাস্তা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

উলিপুর উপজেলার বজরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আমিন বলেন, আমার ইউনিয়নে ১০ হাজার মানুষ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। আর বরাদ্দ সমান্য। তা দিয়ে কিছুই হচ্ছে না। বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে দুর্ভোগ। এখনও ঘরে ফিরতে পরছেন না দুর্গতরা। এ ছাড়া অপ্রতুল ত্রাণের কারণে বিভিন্ন স্থানে হাহাকার দেখা দিয়েছে।

শেরপুর সদর উপজেলার চরপক্ষিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকবর আলী বলেন, ইউনিয়নে সব গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষ। সরকার যে পরিমাণ বরাদ্দ দিয়েছে তা অপ্রতুল।

লালমনিরহাটে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছে জেলা পুলিশ। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রত্যেককে ৫ কেজি চাল, ২ লিটার বিশুদ্ধ পানি, আধা কেজি মুড়ি ও ৫ প্যাকেট করে বিস্কুট দেয়া হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ