পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমান কি অন্যান্যদের জন্য আশংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? নইলে সারাবিশ্ব জুড়ে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে কেন? বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম দুদিকেই দুটি অমুসলিম দেশ। পূর্বে মিয়ানমার, পশ্চিমে ভারত। পূর্বের মিয়ানমারে যে রোহিঙ্গারা বহুদিন ধরে বাস করে আসছে, তাদের সে দেশের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে যে, তারা নাকি বাংলাদেশী, বাংলাদেশ থেকে গিয়ে তারা মিয়ানমারে বসতি স্থাপন করেছে, অতএব তাদের সে দেশে থাকার অধিকার নেই।
অথচ এর চাইতে বড় অসত্য আর কিছু নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মিয়ানমারের যে আরাকান অঞ্চলে রোহিঙ্গারা বাস করে যে অঞ্চল সমুদ্র-সংলগ্ন হওয়াতে প্রাচীনকাল থেকেই সে অঞ্চলের সঙ্গে সমুদ্র-পথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আরবদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার ফলে প্রাচীনকাল থেকেই বহু আরব ব্যবসায়ী ঐ এলাকায় বসবাস শুরু করতে থাকে। এভাবে তারা পরবর্তীকালে আরবদের সঙ্গে আগত ইসলাম প্রচারকদের প্রভাবে ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শে মুক্ত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। তাদেরই বংশধর আজকের রোহিঙ্গারা। বছরের পর বছর মিয়ানমারে বাস করে মিয়ানমারের মাটির সন্তান (সান অব দ্য সয়েল) হয়ে গেছে। সুতরাং তাদেরকে কোন ক্রমেই বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে গেছে বলে অভিযোগ আনা চলে না।
এবার ভারতের কথা। ভারত এককালে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে খ্যাতি অর্জন করেছিল। এমনকি বৃটিশ শাসনাধীন ভারতে হিন্দু-মুসলমান দুটি সম্প্রদায় বাস করেছে। বৃটিশ-বিরোধী যে প্রাচীন রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করে সেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেও মওলানা আবুল কালাম আজাদ, হুমায়ূন কবিরসহ বহু মুসলিম নেতা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
তবে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের মধ্যে হিন্দুরা প্রধান ভূমিকা পালনের ফলে মুসলমানদের প্রতি সব সময় কংগ্রেস সুবিচার করতে সক্ষম হতো না। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন নবাব সলিমুল্লাহ। ঢাকায় অনুষ্ঠিত যে সম্মেলনে তিনি এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন, সে সম্মেলনে তৎকালীন উদীয়মান মুসলিম নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেন এই যুক্তিতে যে এর ফলে বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভক্তি আসবে এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম দুর্বল হয়ে পড়বে। তাঁর এই মনোভাবের জন্য মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ‘হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত’ হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন।
কিন্তু এই মুহম্মদ আলী জিন্নাহই কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দের বাস্তব আচরণে বিরক্ত হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করে নিখিল ভারত মুসলিম লীগে যোগদান করে হিন্দু মুসলিম সংখ্যাগুরুত্বের ভিত্তিতে অবিভক্ত ভারতকে বিভক্ত করে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পাকিস্তান নামের স্বতন্ত্রস্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
সে সময় কঠোর বাস্তবতা বোধে এ আন্দোলনে শরীক হল অবিভক্ত ভারতবর্ষের মুসলিম প্রধান উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সকল মুসলিম নেতৃবৃন্দ। এমনকি জিন্নাহ সমর্থিত এ আন্দোলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের যে ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে, সে মূল পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন তদানীন্তন বাঙ্গালী মুসলিম নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। ১৯৪০ সালের এ প্রস্তাবের বাস্তবতা বিবেচনায় এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবীতে পাকিস্তান আন্দোলন তদানীন্তন বাংলা প্রদেশে অত্যন্ত জোরদার হয়ে ওঠে।
বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ অখণ্ড ভারত হিসাবে স্বাধীনতা লাভ করবে, না মুসলিম লীগের দাবী মোতাবেক অবিভক্ত ভারত মুসলিম ও অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হিসাবে বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করবে, সে ইস্যুতে তদানীন্তন ভারতবর্ষে একমাত্র বাংলা প্রদেশেই ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়।
এভাবে প্রধানত বাঙালী মুসলমানদের সমর্থনকে ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন পাকিস্তান যাত্রা শুরু করলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় রাজধানী এবং সেনাবাহিনী নৌ বাহিনী, এয়ার ফোর্স-সমগ্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর পাকিস্তানের অংশে অবস্থিত হওয়ায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের যাত্রা শুরুই হয় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্বে। এমনকি সমগ্র পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশ তদানীন্তন পূর্ব বঙ্গের এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা হলেও বাংলাকে বাদ দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অবাঙালী নেতৃবৃন্দের অতিরিক্ত এবং রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোন অনুষ্ঠানিক সাক্ষাত গ্রহণ না করেই প্রভাবের ফলে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা শুরু হয়। এটা বোঝা গেল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পোস্ট কার্ড এনভেলপ, মানি অর্ডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজীর পাশাপাশি শুধু উর্দু ব্যবহারের মাধ্যমে।
এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধেই গড়ে ওঠে ভাষা আন্দোলন স্বয়ত্ত শাসন আন্দোলন প্রভৃতি, যার মধ্যে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে যে স্বাধিকার-চেতনা গড়ে ওঠে, তাকে পশুবলে ধ্বংস করে দেবার ষড়যন্ত্রে ১৯৭১ সালে মেতে ওঠে তদানীন্তন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবাঙ্গালী নেতৃত্ব। এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ জীবন-মরণ পণ করে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাত্র নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
১৯৭১ সালের সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেলে বন্দী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি মুক্তি পেয়ে প্রথমে লন্ডন যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে, মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দেয়ার নামে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য রেখে দেয়া হয়েছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এব্যাপারে তাঁর ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে নয়া দিল্লীতে স্বল্প বিরতিকালে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম আপনার বাহিনী কবে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনবেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসারণ সহজ হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর তখন সারা বিশ্বে যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাতে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে অন্য কোন জবাব দেয়া সম্ভবপর ছিল না।
সেদিন বঙ্গবন্ধুর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে ভারত বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনী সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেও ভারত যে এখনও বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে ওঠা পছন্দ করে না, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অল্প দিন পরেই। সে সময় লাহোরে একটি বিশ্ব মুসলিম রাষ্ট্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সে সম্মেলনে বাংলাদেশকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু ভারত সে সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের বিরোধিতা করে। ফলে বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ কামনা করেন। মওলানা বলেন, তুমি যদি স্বাধীন দেশের নেতা হয়ে থাকো তবে তোমার মনে যা চায় তাই করো। আর তুমি যদি ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্রের নেতা হয়ে থাকো তাহলে ভারত যা বলে, তাই করো। ফলে বঙ্গবন্ধু লাহোর সম্মেলন যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেদিন বঙ্গবন্ধু লাহোর ইসলামিক সামিটে যোগদান করতে যান সেদিন নয়া দিল্লীতে তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। অথচ সে সময় মুখে মুখে ভারত বাংলাদেশের মিত্র দেশ বলে দাবী করতো। ভারত যে কখনও কোন মুসলমানের প্রকৃত বন্ধু হতে রাজী না, তা সুপ্রমাণিত হয় ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের প্রতি সরকারের আচরণেও। দৈনিক ইনকিলাব-এর গত মঙ্গলবার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনেও যার শিরোনাম ছিল ‘ভারতে মুসলিম নির্যাতন এবং...।’
বিশ্বব্যাপী ইসলামের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির মূলে রয়েছে ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শ। মুসলমানদের উপর নির্যাতন করে, তা যে বন্ধ করা সম্ভব নয়, তা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দ যত দ্রুত উপলব্ধি করেন, ততই বিশ্বশান্তির জন্য মঙ্গল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।