পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বিশ্ব রাজনীতিতে সাফল্যের ‘উদাহরণ’ এবং বাংলাদেশের ‘রাজনীতির যাদুকর’ সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আর নেই। সিএমএইচ-এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল তিনি ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। সাবেক সেনাপ্রধান এবং বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এরশাদের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে দেশের রাজনীতিতে ‘এরশাদ অধ্যায়ের’ অবসান ঘটলো। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। দলমত নির্বিশেষে হাজার হাজার নেতাকর্মী ছুটে যান সিএমএইচ-এ। সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনিক সংস্কার এবং উন্নয়নের রূপকার এরশাদের প্রথম নামাজে জানাজা গতকাল বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাসের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার আগে তাঁর ভাই জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘মানুষ মাত্রই ভুলত্রæটি হয়ে থাকে। এরশাদ কোনও কাজে ভুল হয়ে থাকলে, তাঁর ওপর কোনও ক্ষোভ থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। আমি তার ভাই হিসেবে ক্ষমা চাচ্ছি।’ এ সময় অনেককেই চোখ মুচতে দেখা যায়। গতকাল জানাজার পর তাকে সিএমএইচ-এর হিমঘরে রাখা হয়েছে। আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজার পর তাঁর লাশ কাকরাইলস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নেয়া হবে। সেখানে সর্বসাধারণের দেখার জন্য তাঁকে রাখা হবে। বাদ আছর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে তাঁর তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে লাশ পুনরায় হিমঘরে নেয়া হবে। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার হেলিকপ্টার যোগে লাশ নেয়া হবে রংপুরে। রংপুর ঈদগাহ মাঠে তাঁর শেষ জানাজার পর হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় নিয়ে এসে বাদ জোহর সেনা কবরস্থানে দাফন করা হবে। তাঁর মৃত্যুতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিএনপি মহাসচিবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য ইতোমধ্যেই দলের বনানীস্থ কার্যালয়ে শোক বই খোলা হয়েছে।
পৃথিবীতে জন্ম নেয়া এইচ এম এরশাদ একমাত্র ব্যক্তি যিনি আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আবার বীরের বেশে রাজনীতিতে ফিরে আসেন। বিশ্বের দেশে দেশে সেনা শাসক এবং স্বৈরাশাসকরা আন্দোলনের ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এরশাদ ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আবার বীরের বেশে রাজনীতিতে ফিরে আসেন। কারাগারে থেকেই তিনি দু’বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫টি করে আসনে প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, ’৯১ ও ’৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে এমপি হন এবং প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর চেয়ে তার প্রাপ্য ভোটের ব্যবধান ছিল সবচেয়ে বেশি। শুধু ফিরে আসাই নয় তিনি কার্যত দীর্ঘ ৩০ বছর দেশের রাজনীতিকে ‘শাসন’ করেন। বিগত ৩০ বছর ধরে দেশের নির্বাচন এবং নির্বাচনের পর কোনো দল ক্ষমতায় যাবে তা নির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ক্ষমতায় থাকার সময়ও তিনি ’৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে শত বাধার মুখে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করেছেন। তিনি জুম্মাবারে (শুক্রবার) সাপ্তাহিক ছুটি এবং মসজিদ ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন।
এরশাদ দীর্ঘদিন থেকে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। সর্বশেষ তিনি খুবই দুর্বলতায় ভুগছিলেন। চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি আস্তে আস্তে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছিলেন। সিএমএইচ-এ চিকিৎসা চলছিল। এর আগে সিংগাপুরে তাঁর হার্টের ভালভে একটি অপারেশন করতে হয়েছিল। ছিল লিভারের সমস্যা এবং হজমেও সমস্যা হচ্ছিল। তার ছিল রক্তে হিমোগেøাবিন উৎপাদনে সমস্যা। ফুসফুস আক্রান্ত; হুইল চেয়ার সঙ্গী এরশাদ এক সময় বাকশক্তি এবং চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। রক্তে হিমোগেøাবিনের সমস্যা নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১০ দিন আগে সিঙ্গাপুরে যান। তবে মৃত্যুর আগে দীর্ঘ ১০ দিন থেকে তিনি সিএমএইচ-এর আইসিইউতে লাইফ সার্পোটে ছিলেন।
বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তার সেøাগান ছিল ‘৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’। এ জন্য তিনি পল্লীবন্ধু উপাধি পান। এক নাগাড়ে প্রায় ৯ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি দেশে অসংখ্য উন্নয়ন, সংস্কারমূলক কর্মকান্ড সাধন করেন। তার মধ্যে যুগান্তকারী কর্মকান্ড হচ্ছে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন, দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা, ভুমি সংস্কার, ওষুধ নীতি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন, পথকলি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠাতা, গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন, পল্লীতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া, গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ঘটানো, শান্তি মিশনে সৈন্য প্রেরণ এবং সারাদেশে ৫০৮টি বড় ধরণের ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ও ১০ হাজার কিলোমিটার নতুন পাকা রাস্তা নির্মাণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধনসহ অগণিত উন্নয়ন ও কল্যাণকর কর্মকান্ড করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অন্ততঃ ৫০টি কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও সংস্কারের বরপুত্র এরশাদ এদেশে এমন কোনো সেক্টর নেইÑ যেখানে তিনি হাত দেননি। দেশের গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও লেগেছে তাঁর উন্নয়নের হাতের ছোঁয়া। তিনি ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
এইচ এম এরশাদ ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলায় তাঁর নানা বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস অবিভক্ত ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমা শহরে। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মকবুল হোসেন। তিনি ছিলেন আইনজীবী। তাঁর পিতামহ মৌলভী শাহদৎ হোসেনও ছিলেন হিন্দু অধ্যুাষিত কুচবিহার অঞ্চলের প্রথম মুসলিম আইনজীবী। এরশাদের মায়ের নাম মজিদা খাতুন। এরশাদ ছিলেন ৯ ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান এবং চার ভাইয়ের মধ্যে প্রথম। তাঁর ডাকনাম ছিলো পেয়ারা। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে দিনহাটায়। উপনিবৈশিক শাসনামলে ভারতের দিনহাটা হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন।
ম্যাট্রিক পাসের পর দিনহাটা ছেড়ে এরশাদ ১৮৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষে রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি কারমাইকেল কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পুরান ঢাকায় তিনি কিছুদিন টিউশনী করেন। তিনি ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৬০-৬২ সালে তিনি চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে অ্যাডজুট্যান্ট পদে চাকরি করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় মিলিটারি স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৮ সালে শিয়ালকোটে ৫৪তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভের পর এরশাদ ১৯৬৯-৭০ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক এবং ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চাকরির কারণে তিনি পাকিস্তানে অবস্থান করতে বাধ্য হন। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের অভ্যূদ্বয়ের পর ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিয়োগ পান। সেনাবাহিনীতে এরশাদ ১৯৭৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কর্নেল পদে পদোন্নতি এবং ১৯৭৫ সালের জুন মাসে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে এনডিসি কোর্স করার জন্য নয়াদিল্লি প্রেরণ করেন। দিল্লিতে থাকাবস্থায় ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। প্রশিক্ষণ অসমাপ্ত রেখেই জিয়াউর রহমান তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রমোশন দেন। ১৯৭৮ সালের ১ ডিসেম্বর তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭৯ সালের ৭ নভেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর থেকেই সংবাদপত্রে বিবৃতি ও মিডিয়া কভারেজের মাধ্যমে এরশাদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। লাইম লাইটে চলে আসেন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে দুর্নীতির অভিযোগে উৎখাত করে এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি দেশের সংবিধানকে রহিত (স্থগিত) করেন, জাতীয় সংসদ বাতিল করেন এবং আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে তিনি নিজেকে দেশের সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে ভবিষ্যতে সামরিক আইনের অধীনে জারিকৃত বিধিবিধান ও আদেশই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং এর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সকল আইন অকার্যকর হবে।
এইচ এম এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন। এরপর ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি প্রেসিডেন্ট আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে নিজেই প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ক্ষমতা গ্রহণের পর এইচ এম এরশাদ ১৯৮৪ সালে দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় উপজেলা পদ্ধতির প্রচলন করেন। উপজেলা পরিষদসমূহের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের মে মাসে। এর আগে ১৯৮৪ সালে এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও আন্দোলনের মুখে নির্বাচন স্থাগিত করতে বাধ্য হন। তিনি ১৯৮৪ সালে ১৮ দফা ঘোষণা করে রাজনীতিক, আমলা, সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ‘বাস্তবায়ন পরিষদ’ গঠন করেন। ওই বছরই সিনিয়র রাজনীতিকদের নিয়ে গঠন করেন জনদল। অতপর ৫টি দলের সম্বয়ে গঠন করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। অতপর ১৯৮৬ সালের পহেলা জানুয়ারি ঐক্য ফ্রন্টের ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে দলের নাম পরিবর্তন করে জাতীয় পার্টি ঘোষণা করা হয়। ডান-বাম ও মধ্যপন্থীদের সমন্বয়ে জাতীয় পার্টি গঠনে অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৮ দফা কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতিতে নামেন এরশাদ। তাঁর দলের কর্মসূচিগুলো হলো- ১. জনগণের অর্থনৈতিক মুক্ত অর্জনের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুফল লাভ করা; ২. ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান হ্রাসের দ্বারা জাতীয় সম্পদের সুষম বণ্টন; ৩. পল্লীমুখী উন্নয়ন; ৪. উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্প পণ্যের সুষ্ঠু বণ্টন ও প্রতিযোগিতা; ৫. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন; ৬. কৃষকদের ন্যায্য অংশ প্রদান এবং তাদের জীবনধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ভূমি সংস্কার; ৭. পল্লী অঞ্চলে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে পুঁজি গঠন ও সরবরাহ; ৮. বেসরকারি খাতের শিল্পকে উৎসাহ দান, বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি; ৯. সমবায় ও কুটির শিল্প; ১০. প্রশাসন ও বিচার বিভাগের পুনর্গঠন, বিকেন্দ্রীকরণ ও কৃচ্ছতা সাধন; ১১. ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে উন্নতি সুনিশ্চিত করতে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন; ১২. সম্ভাব্য সর্বাধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি; ১৩. জাতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজে নারী সমাজের যোগ্য স্থান লাভে সাহায্য করা; ১৪. জনগণের জন্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা; ১৫. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ; ১৬. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ; ১৭. রাজনীতিতে কর্মের রাজনীতিতে রূপান্তর করা এবং ১৮. জাতীয় জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটানো এবং নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে সমুন্নত রাখা।
এরশাদের শাসনামলের পুরো সময়জুড়ে দেশের রাজনীতি টলটলায়মান ছিল। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের মধ্যে ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে আয়োজিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এইচ এম এরশাদ তাঁর জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৮৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে; তবে বিএনপিসহ বাম দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়ে এরশাদ ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন আহ্বান করেন। সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী আইন পাশ করে সে সময় জাতীয় সংসদ সংবিধান পুনর্বহাল করে। এর মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখলসহ সামরিক আইন ও বিধি-বিধান দ্বারা সম্পাদিত সকল কাজ ও পদক্ষেপকে সংবিধানে বৈধতা দেন। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির তীব্র আন্দোলনের মুখে এরশাদ ১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর তৃতীয় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিক দলগুলো। তার বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর অবিরাম আন্দোলন চলতে থাকে এবং আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন।
ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর এরশাদকে গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর সেখান থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। মূলত ১৯৯১ সালের পহেলা জানুয়ারি মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি পুনর্গঠিত হয়। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় এরশাদ ৫টি আসন থেকে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে নির্বাচিত হন। বিএনপি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় ২০টি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। একাধিক মামলায় তিনি দোষী প্রমাণিত হয়ে কারাদন্ডে দন্ডিত হন। ১৯৯৬-এর সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি কারাগারে থেকেই সংসদে ৫টি আসনে বিজয়ী হন। অতপর তার দল জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। বিনিময়ে দীর্ঘ ৬ বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন। তবে আদালতের রায়ে দন্ডিত হওয়ার কারণে সংসদে তাঁর আসন বাতিল হয়ে যায়। ২০০০ সালে জাতীয় পার্টি তিনটি উপদলে বিভক্ত হয়।
রাজনীতির পালাবদলে ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। মামলার ভয়ে এরশাদ ২০০৫ সালে মহাসমারোহে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেন। ২০০৭ সালের এক-এগারোর কিছু আগে রাজনীতির সমীকরণ আবার পাল্টে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এরশাদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেন পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশে যোগদানের মধ্যদিয়ে। ২০০৯ সাল তিনি এবং তাঁর দল ক্ষমতার ভাগিদার হন।
১৯৯০ সালে আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানোর পর নানা মামলায় হাত-পা বাঁধা ছিল এরশাদের। তারপরও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জেলে বসে তিনি ৫টি আসনসহ জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের পর এরশাদের সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। তবে কারামুক্ত হয়ে এরশাদ জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী ও সুসংহত করতে কার্যকর, দূরদর্শী ভূমিকা রাখতে পারেননি। এরশাদের কিছু অসংলগ্ন সিদ্ধান্তে দলটি ভাঙনের মুখে পড়ে। দলের খুঁটি হিসেবে পরিচিত মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, কাজী জাফর আহমদসহ অনেক নেতা তাঁকে ছেড়ে চলে যান। তিনি জেল খেটে অর্থদসন্ড দিয়ে বের হন এবং ওই সময় তিনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটও ছাড়েন।
দন্ডের কারণে এরশাদ ২০০১ সালের নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি। কঠিন বিপর্যয়ের মুখেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৪টি আসন লাভ করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিজয়ী হওয়ায় পরদিনই এরশাদ দেশের বাইরে চলে যান। পরিবেশ অনুকূলে এলে দেশে ফিরে দল গোছানোর কাজে হাত দেন। সেই নির্বাচনের আগেও জাতীয় পার্টি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে। ২০০৬ সালের বাতিল হওয়া ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নানা নাটকীয়তা ও শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার মধ্যে আন্দোলনের মাঠে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এরশাদকে কাছে টেনেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে তিনি যখন পল্টনের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটের মঞ্চে উঠলেন, তখন ১৪ দল মহাজোটে পরিণত হয়।
ওয়ান-ইলাভেন পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটে প্রধান শরিক জাতীয় পার্টি আবারও দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। মহাজোট সরকারের অংশীদারও হয়, তিনি হন প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঘিরে দ্বিধাদ্ব›দ্ব, নানামুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ জাতীয় পার্টিকে আরেক দফা বিপর্যয়ে ফেলে। ভিন্নমত পোষণ করে কাজী জাফর আহমদ পৃথক জাতীয় পার্টি গঠন করেন। আওয়ামী লীগের অনুগত দল হিসেবে জাপার একই ধারা অব্যাহত ছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও। তবে এবার আর সরকারের মন্ত্রিসভায় যাওয়ার সুযোগ পায়নি জাতীয় পার্টি। চলে যায় বিরোধী দলের আসনে। দলের চেয়ারম্যান হিসেবে নিজে বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব নেন এরশাদ। কিন্তু তিনি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সংসদে একদিনও বসতে পারেনি।
৯ বছরের শাসনকালীন সাফল্য থানা পর্যায়ে দেশব্যাপী উপজেলা স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্যই মুখ্যত এরশাদ আমল (১৯৮২-৯০) স্মরণীয় হয়ে আছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশি কেন্দ্র হিসেবে থানাগুলোকে সৃষ্টি করে। ইউনিয়ন পরিষদগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয় ও তত্ত¡াবধানের জন্য ১৯৫৯ সালে প্রথমবারের মতো থানা পর্যায়ে একটি স্থানীয় সরকার ইউনিট গঠন করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এরশাদ স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কার্যকরভাবে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রশাসন ও পরিকল্পনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। তাই উপজেলাগুলোকে উন্নয়ন প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে উন্নীত করার মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণের এই ধারণাকে বাস্তব রূপ দেয়া হয়। মূলত ১৯৮২ সালে স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ পুনর্গঠন) অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরপর ১৯৮৪ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত ১০টি ধাপে ৪৬০টি থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। এসব ছিল এরশাদের প্রশাসন সংস্কারের সাহসী উদ্যোগ। তিনি সড়ক যোগাযোগের যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন তার হাত ধরেই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।