পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার চেষ্টাকালে তিউনিসিয়া উপক‚লে একটি ডুবন্ত নৌকা থেকে ৭১ জনকে উদ্ধার করেছে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। তিউনিসিয়ান ন্যাশনাল গার্ডের মুখপাত্র হোসেম এদ্দিন জেবিলির বরাতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির পশ্চিমে জাওয়ারা শহর থেকে ৭১ জন যাত্রী নিয়ে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে সমুদ্রযাত্রা করে নৌকাটি। যাত্রীদের মধ্যে ৩৭ জনই বাংলাদেশি নাগরিক। অন্যদের মধ্যে মরোক্কোর ৮ জন, মিশরের ৮ জন, আলজেরিয়ার ৭ জন, সুদানের ৪ জন, চাদের ২ জন এবং একজন তিউনিসিয়ার নাগরিক। ইতালি উপক‚লে এ ধরনের সমুদ্রযাত্রার খবর কোনো নতুন ঘটনা নয়। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলো থেকে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ মানুষের দেশ ছাড়ার ঘটনা স্বাভাবিক বাস্তবতা হিসেবেই ধরে নেয়া হয়। ইউরোপীয় দেশগুলো ইতিমধ্যে লাখ লাখ অভিবাসীকে আশ্রয় দিয়েছে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত ও গৃহযুদ্ধকবলিত লিবিয়া, সুদান, মিশরের নাগরিকদের পাশাপাশি বাংলাদেশিরা কেন এভাবে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছে, এই প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরেই ঘুরে ফিরে আসছে। গত এক দশকে ইউরোপ,ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া ও ভ‚-মধ্যসাগরে বিভিন্ন দেশের কোস্টগার্ডের হাতে যতগুলো অভিবাসিবাহী এমন নৌকা ধরা পড়েছে অথবা দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি নাগরিকদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। অন্য মহাদেশের একটি যুদ্ধকবলিত শহরের উপকূল থেকে ইউরোপের ইতালির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়া একটি নৌকার বেশিরভাগই বাংলাদেশি নাগরিক। এমন খবর আরো বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। এমন খবরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের পরিচিতি ও ভাবমর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের কাছাকাছি। প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিশাল আকারের জাতীয় বাজেট এবং একেকটি হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপণ ও মধ্য আয়ের দেশে পরিনত হওয়ার হাতছানি মাখা রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার সময়ে হাজার হাজার তরুণ কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ত্যাগ করছে তার উপযুক্ত কার্যকারণ খুঁজে বের করতেই হবে। বহু বাংলাদেশি অনেক আগে বৈধ উপায়ে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় গিয়েছিল। এসব দেশে যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অন্যদেশের নাগরিকর নিজ নিজ দেশে ফিরে গেলেও শুধু বাংলাদেশিরাই যেন ব্যতিক্রম। হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলোতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবস্থান করছে অথবা আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রায় ইউরোপে পাড়ি জমালেও দেশে প্রত্যাবর্তন করছে না। কয়েক বছর আগে ইউরোপে মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসন সংকট চরম আকার ধারণ করলে অস্ট্রিয়া সীমান্তে আটক শরণার্থীদের মধ্যে বেশ কিছু বাংলাদেশি তরুণ ছিল যারা প্ল্যাকার্ডে ইংরেজিতে লিখেছে, আমাদেরকে গুলি কর তবু বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ো না। আন্তজার্তিক গণমাধ্যমে এই ছবি ছাপা হয়েছে। দেশে যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ নেই, এমনকি সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামও নেই। তাহলে যুবকরা দেশে থাকতে বা দেশে ফিরতে চায় না কেন? উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও মধ্য আয়ের বাংলাদেশের সাথে এই চিত্রের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একদিকে লাখ লাখ তরুণ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারি, ব্যাংকার ও রাজনীতিবিদরা দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। টাকা পাচার এবং ঝুঁকিপূর্ণ মাইগ্রেশন আগেও ছিল এখনো আছে। তবে গত এক দশকে অবস্থা যেন সংকটজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এটা দেশের রাজনৈতিক সংকট, গণতন্ত্রহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অনাচার ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রভাব বলে মনে করছেন সমাজতাত্তি¡করা। কিছু আদম বেপারি ও দেশি-বিদেশি দালালচক্রের প্রলোভনে একশ্রেণীর মানুষ উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ায় অতি স্বল্প বেতনের চাকুরির জন্য কেন শত শত যুবক সমুদ্রপথে ঝুঁকি নিয়ে সেখানে যাচ্ছে? এসব অবৈধ বাংলাদেশিদের কারণে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতেও বৈধ প্রক্রিয়ায় জনশক্তি রফতানি বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত এক দশকে জনশক্তি রফতানি, বিদেশে টাকা পাচার এবং অবৈধ অভিবাসন বন্ধে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। দেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থান, সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সুশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া এ সংকটের কোনো বিকল্প সমাধান নেই। দেশে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার ও নিরাপত্তা ছাড়া শুধুমাত্র পরিসংখ্যানগত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা মন ভোলানো মেগা প্রকল্পে মানুষের আস্থা নেই। আমাদের প্রবৃদ্ধি বা মেগা প্রকল্প বিদেশে তেমন গুরুত্ব পায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া এবং মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণের বিদেশে পাড়ি জমানোর বাস্তবতা অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। একবিংশ শতকের সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে। জননিরাপত্তা ও সুশাসন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।