পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে! সাড়ে ৪ বছর ধরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং তিন বছর ধরে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের দায়িত্ব পালনের পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমেই বিএনপি সরকার পরিবর্তন চায়। মির্জা ফখরুলের বক্তব্য পড়ে মনে পড়লো কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার সেই অমর দুটি চরণ, ‘একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে’! গত রবিবার ৭ জুলাই মির্জা ফখরুল একটি বাংলা দৈনিকে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে ছাপানো ঐ ইন্টারভিউয়ে শিরোনাম হলো, ‘নির্বাচনের মধ্য দিয়েই পরিবর্তন চায় বিএনপি’। এই ইন্টারভিউটি পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে যে প্রশ্নটি মনে আসে সেটি হলো, তাহলে কি বিএনপি পরবর্তী নির্বাচনের জন্য আরো সাড়ে চার বছর বসে থাকবে? তাই যদি হয় তাহলে বেগম খালেদা জিয়া কি আরো সাড়ে চার বছর জেল খানার ঐ অন্ধ প্রকোষ্ঠে ধুকে ধুকে মরবেন? এসব কথা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু বিএনপির বিগত ছয় বছরের কান্ড কারখানা দেখে মনে হয়, সেটিই হতে যাচ্ছে।
২০১৫ সালের মার্চের পর থেকে এই পৌনে ৫ বছর বিএনপি দুইটি জোট বেঁধেছে বটে। কিন্তু এককভাবে হোক আর জোটবদ্ধভাবে হোক, কোনো হরতাল করেনি, কোনো ঘেরাও করেনি, কোনো মিছিল করেনি, এমনকি ইলেকশনের আগে মাত্র ৪টি মিটিং ছাড়া কোনো জনসভাও করেনি। ইলেকশনে এতবড় ভোট ডাকাতি হয়ে গেলো, যেটি পৃথিবীতে নজিরহীন, সেই মহা ভোট ডাকাতির পরেও বিএনপি আজ পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি দেয়নি। কাজেই তাদের মহাসচিব যখন বলেন যে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে তখন জানতে ইচ্ছে করে যে তাহলে কি তারা আরও সাড়ে ৪ বছর ইলেকশনের জন্য বসে বসে অপেক্ষা করবেন?
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই মির্জা ফখরুল বলেছেন যে, সরকার পরিবর্তনে নির্বাচন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নাই। এখানে সর্বাগ্রে যে প্রশ্ন আসে সেটি হলো কোন্ নির্বাচনে তিনি বর্তমান সরকারের পরিবর্তন আশা করেন? এর মধ্যে অর্থাৎ বিগত ৬ বছরে দুটি নির্বাচন হয়ে গেলো। একটি হলো ২০১৪ সালে, আর একটি হলো ২০১৮ সালে। ২০১৪ সালের নির্বাচন মির্জা ফখরুলরাই তো বয়কট করেছেন। বয়কটের কারণ ছিল এই যে ঐ নির্বাচনটি ছিল দলীয় সরকার অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে পার্লামেন্ট বহাল ছিল। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ছিলো। সেই নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয় নাই। সেই নির্বাচনের আগে বিএনপিকে সভা সমিতি ও মিছিল মিটিং করতে দেওয়া হয়নি। সেই নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হয়নি। এসব কারণে বিএনপি নির্বাচনটি বয়কট করেছিলো এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিনা ভোটে ১৫৩টি আসনে পূর্বাহ্নিক জয় ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের পরবর্তী সরকার গঠন সুনিশ্চিত করেছিলো।
একথা সত্য যে ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য বিএনপি আন্দোলন করে। কিন্তু সরকার নাৎসিবাদী কায়দায় বিএনপি এবং তার ২০ দলীয় মিত্র দলসমূহ অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য দলকে জুলুমের স্টিম রোলার দিয়ে তাদের কন্ঠ স্তব্ধ করে দেয়। ২০১৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিএনপি সেই যে মার খেয়ে বসে পড়ে তার পর আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়াকে যখন সাজানো এবং বানোয়াট মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় তখন বিএনপির হাজার হাজার কর্মী সারা দেশকে কাঁপিয়ে তোলার মতো আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। ২০০৮ সালে বেগম জিয়াকে যখন একটি গাড়ি বহরে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন কয়েক হাজার কর্মী তাৎক্ষণিক ভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে সেটি সাধারণ মানুষ এবং টেলিভিশন দর্শকদের কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু কোনো একটি দুর্বোধ্য কারণে বিএনপি নিজেই বেগম জিয়াকে কারাগারে নিক্ষেপ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
দুই
এই নির্দেশের ফলে কার কি লাভ হয়েছে? সেটি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বুঝতে অক্ষম। কিন্তু নিট ফল হয়েছে এই যে, আজ দেড় বছর হলো বেগম জিয়া লাল দালানে বন্দী, তারেক জিয়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড মাথায় নিয়ে সুদূর লন্ডনে নির্বাসিত, হাজার হাজার কর্মী আজও কারাগারে এবং হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে আজও ঝুলছে হুলিয়া।
এমন একটি পটভূমিতে সরকার ২০১৮ সালে ঘোষণা করে নির্বাচন। এর আগে বছর দুয়েক ধরে বিএনপির তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতারা কনসার্টের মতো বলে যাচ্ছিলেন যে বেগম জিয়া ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। বর্তমান কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। তৎকালীন পার্লামেন্ট বহাল রেখে কোনো নির্বাচন নয়। এসব দাবি যখন বিএনপি তুলছিলো তখন ২০ দলীয় জোট থাকা সত্বেও বিএনপির উদ্যোগে হঠাৎ করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি নতুন নির্বাচনী জোট গঠিত হয়। সকলেই জানেন সেই জোটে ছিলেন বিএনপি, আসম রবের জেএসডি, কামাল হোসেনের গণফোরাম, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য এবং কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।
ঐক্য ফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর দেখা যায় ঐক্যফ্রন্টের সাথে বিএনপির অতিরিক্ত মাখামাখি এবং ২০ দলীয় জোটের প্রতি দৃষ্টিকটু উদাসীনতা ও উপেক্ষা। ৪/৫ বছর আগে ২০ দলীয় জোট গঠিত হয়েছে। এই ৪/৫ বছর ধরেই ২০ দলীয় জোট বলছে যে এই পার্লামেন্টের অধীনে নির্বাচনে যাবো না এবং নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবো না।
কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর সব কিছু হঠাৎ যেন ভোজবাজির মতো পাল্টে গেলো। কাউকে কিছু না জানিয়ে (সম্ভবত মির্জা ফখরুল জানতেন) ঐক্যফ্রন্টের চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন হঠাৎ করে সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন আর শেখ হাসিনা সাথে সাথেই সংলাপের সেই প্রস্তাব লুফে নেন। ২০ দলীয় জোটের মিত্ররা তো হতভম্ভ।
যাই হোক, তবুও ঐক্য বজায় রাখার স্বার্থে তারা সংলাপে যান। ফলাফল কী হয়েছে সেটি আজ সকলেরই জানা। শূন্য হাতে ঐক্যফ্রন্ট ফিরে আসে এবং পার্লামেন্ট বহাল রেখে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যায়।
পরবর্তী ঘটনা সকলেরই জানা। তাই সেগুলোর আর পুনরাবৃত্তি করবো না। সারা বিশ্বে যা ঘটেনি বাংলাদেশে তাই ঘটলো। বিরোধী দলকে নির্বাচনী প্রচার করতে দেওয়া হয়নি, পোস্টার ও ব্যানার লাগাতে দেওয়া হয়নি, গণসংযোগ সফরে হামলা করে কর্মীদেরকে রক্তাক্ত করা হয়েছে এবং ৩০ ডিসেম্বর ভোটের পরিবর্তে ২৯ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ ও আনসারের সহযোগিতায় সরকার পক্ষের ব্যালটে সিল মারা হয়েছে। আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো এই যে ৩০ ডিসেম্বর সকালেও মির্জা ফখরুল সাফাই গেয়ে বলেছেন যে ভোট সুষ্ঠ ভাবে হচ্ছে।
২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের অন্যান্য শরিক দল এই মহা ভোট ডাকাতিতে ক্ষেপে যায়। তারা ২ বা ৩ জানুয়ারি থেকে মহা ভোট ডাকাতির প্রতিবাদে তিন দিন লাগাতার হরতাল এবং অবরোধের কর্মসূচী দিতে বলে। কিন্তু এই কর্মসূচীটিও ড. কামাল এবং মির্জা ফখরুল রহস্যময় কারণে এড়িয়ে যান।
তারপর ৬ মাস গত হয়েছে। কোনো প্রতিবাদ হয়নি। কোনো মিছিল মিটিং, সভা, হরতাল, অবরোধ ঘেরাও হয়নি। খালেদা জিয়াও এই ৬ মাস ধরে কারাগরেই আছেন। সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর চরম রুষ্ট। বিএনপির প্রতি তারা রুষ্ট নয়, কিন্তু চরম হতাশ। বিএনপির কট্টর সমর্থকদের অনেককেই এখন প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায় যে বিএনপির দ্বারা কিছু হবে না। তারা এখন আন্দোলন করতে ভয় পায়, জেল জুলুম মামলা ও হুলিয়াকে তারা ভয় পায়। মানুষ তাকিয়ে আছে, তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে কিনা সে দিকে। এলডিপির নেতা অলি আহমেদ যখন গরম গরম কথা বলেন তখন তাদের মনে কিছুটা আশাবাদ জাগে। কিন্তু সেই আশাবাদ আবার নিভে যায় যখন তারা দেখেন যে অলি আহমেদ তো আন্দোলনের মানুষ নন।
নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না বিপ্লবী ভাষায় কথা বলেন। তার কথায় মানুষ আশাবাদী হয়। দেশ বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাঙালীদের নিকট থেকেও তিনি অনুপ্রেরণা পান। কিন্তু সেখানেও আশার প্রদীপ উজ্জ্বল ভাবে জ¦লে না। কারণ মানুষ দেখে, তার দলটি বড় নয়।
তিন
মির্জা ফখরুল শুরতেই বলেছেন যে বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডেও বিশ্বাস করে না। তাই সরকার পরিবর্তনে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নাই বিএনপির সামনে। খুব ভালো কথা। যেসব দল রাজনীতি করছে তাদের কোনো দলই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে বিশ্বাস করে না। সন্ত্রাস আর রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা দুটি পথ। বিএনপি বিপ্লবী দল নয় সেটাও ঠিক। কিন্তু বিপ্লবী দল খারাপ কোনো কিছু নয়। কমিউনিস্টরা বিপ্লবে বিশ্বাস করে। সেই কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশে সংবিধান সম্মত একটি দল। এখন প্রশ্ন হলো নির্বাচন ছাড়া বিএনপির সামনে সরকার পরিবর্তনের আর কোনো পথ নাকি আর খোলা নাই। তাহলে বিএনপি কোন ধরণের নির্বাচন চায়? আর কে তাকে সেই ধরণের নির্বাচন দেবে? ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ দুটি নির্বাচন দিয়েছে। যেহেতু বিএনপি হরতাল ঘেরাও অবরোধ এই ধরণের আন্দোলনে বিশ্বাস করে না তাই ধরে নেওয়া হচ্ছে যে আওয়ামী লীগ ২০২৪ সালের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত টিকে থাকবে। তারপরে যে তারা বিএনপির কথা মতো ‘ভদ্রলোকের নির্বাচন’ দেবে তেমন গ্যারান্টি মির্জা ফখরুল কোথায় পাবেন? ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ এক ধরণের কারচুপি করেছে। ২০১৮ সালে আরেক ধরণের কারচুপি করেছে। প্রতিটি কারচুপির ধরণ একটি থেকে আরেকটি আলাদা। তাই হয়। পরবর্তী নির্বাচনে যে কারচুপি হবে সেখানে প্রয়োগ করা হবে নতুন টেকনিক। প্রতিটি কারচুপির সামনেই বিএনপি ঘোল খেয়েছে। ২০২৪ সালে আবার নতুন এক ধরণের কারচুপি হবে। সেখানেও তো বিএনপি ঘোল খাবে। তাহলে বিএনপি সরকার পরিবর্তন করবে কিভাবে? কোন ধরণের নির্বাচনের মাধ্যমে? কে দেবে বিএনপির সেই বাঞ্ছিত নির্বাচন?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।