২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মোটা হবেন ৪০০ কোটি মানুষ
২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা মোটা হবেন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। সংখ্যার বিচারে যা
মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান,শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মধ্যে খাদ্য একটি প্রধান ও অন্যতম মৌলিক চাহিদা। জীবনধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রত্যেক মানুষেরই প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর এই বিশুদ্ধ খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে বিশুদ্ধ খাবারের প্রাপ্তি কঠিন করে ফেলেছে কিছু বিবেকহীন ব্যবসায়ী ও আড়তদার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের নানা পণ্যে দেশ ছেয়ে গেছে। শিশুর গুঁড়া দুধ থেকে বৃদ্ধের ইনসুলিন, রূপচর্চার কসমেটিক থেকে শক্তিবর্ধক ভিটামিন, এমনকি বেঁচে থাকার জন্য যা অপরিহার্য, সেই পানি এবং জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পর্যন্ত এখন ভেজালে ভরপুর । মাছ, দুধ, শাকসবজি ও ফলমূলে ফরমালিন; হলুদে সিসা, মরিচে ইটের গুঁড়া, সরষের তেলে কেমিক্যাল, মশার কয়েলে বিপজ্জনক উপাদান, গরুর গোশতে হরমোন, মুরগির খাবারে বিষাক্ত উপকরণ। টোকাই থেকে ধনীর সন্তান, ভেজালের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ নয় কেউ-‘ যেন ভেজালেই জন্ম, ভেজালেই বেড়ে ওঠা, ভেজালের রাজ্যেই বসবাস।’ভেজাল নামক শিরোনাম পড়তেই যেন আজ শরীর শিউরে উঠে। এই ভেজালের অন্ধকার গুপ্ত কাঁটায় আজ প্রাকৃতিক মায়াবী বাংলা জর্জরিত। ভেজাল করছে কারা? উত্তরে বলতে হয় এরা আমাদের সমাজের এক ধরনের মানুষ। যারা মানুষ নামের কলংক । দেশের প্রতিটি শহর থেকে শুরু করে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এর হিং¯্র থাবা থেকে মুক্ত নয়। কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় নাস্তানাবুধ আজ সারা দেশ।
শুধু খাদ্যদ্রব্য নয় নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিসেই মেশানো হচ্ছে কেমিক্যাল যা মানব সভ্যতার বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব খাদ্যে ভেজাল দেয়া হয়- আমাদের দেশে এমন কোন জিনিস নেই যাতে ভেজাল নেই বা নকল করা হয় না। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে কসমেটিক্স সামগ্রিও আজ ভেজালে জর্জরিক । এ রকম পাওয়া দুষ্কর যে, সম্পূর্ণ ভেজালমুক্ত। ফলের মধ্যে কলা, আম, লিচু, কমলা, আপেল, নাশপাতি, আঙ্গুর, কাঁঠাল, পেঁপেসহ সকল ফলেই ভেজাল মেশানো হয়। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে মাছ, চাল, ডাল, মাংস, তরিতরকারি, গুড়, মসলা, পানি, দুধ (তরল এবং গুঁড়া দুধ উভয়ই), বিস্কুট, চকলেট, বাচ্চাদের খাবার, জুস, ফাস্ট ফুড, হোটেলের খাবার, মিষ্টি, ঘিসহ প্রায় সকল খাবারেই আজ ভেজাল মেশানো হয়।
ভেজালের বহ্নিশিখা- কিছুদিন পূর্বে ভেজালের ভয়াবহতার বাস্তব প্রমাণ বাংলার মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়েছিল দিনাজপুরে লিচু খেয়ে শিশুর মুত্যুর ঘটনার মাধ্যমে। অন্যত্র কলার খোসা খেয়ে ছাগল মারা যাওয়ার মাধ্যমে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এসব ফলে ভয়াবহ পরিমাণ রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। মরিচের গুঁড়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে টেক্সটাইলের বিষাক্ত কেমিক্যাল। বিষাক্ত ক্ষতিকর হাইড্রোজ ব্যবহার করা হচ্ছে গুড় তৈরিতে। ফরমালিন কার্বাইড, ইউরিয়া সার, হাইড্রোজেনসহ নানা ক্ষতিকর ও রাসায়নিক পদার্থ খাদ্য এবং বিভিন্ন দ্রব্যে ব্যবহার করা হচ্ছে যার শিকার প্রাণী জগৎ। গাছে ঝুলন্ত ফলে ভাল রং ও ফল বড় হওয়ার আশায় ব্যবহার করা হয় নানা প্রকার রাসায়নিক কেমিক্যালের স্প্রে। খাদ্য শস্য, শাকসবজি উৎপাদনে রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলমূল, শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। চাল, ডাল, তেল, শিশু খাদ্যসহ সবকিছুতেই ভেজাল। এ যেন ভেজালের রাজত্ব। মাছে এবং দুধে ফরমালিন, সবজিতে কীটনাশক ও ফরমালিন, মচমচে করার জন্য জিলাপী ও চানাচুরে মবিল, লবণে সাদা বালু, চায়ে করাত কলের গুঁড়া, মসলায় ভূসি, কাঠ, বালি, ইটের গুঁড়ো ও বিষাক্ত গুঁড়ো রং। টেক্সটাইল ও লেদার শিল্পে ব্যবহৃত রং মেশানো হচ্ছে সস্তা মানের বিস্কুট, আইসক্রিম, জুস, সেমাইসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুতে। খাদ্যে ভেজালের ফলে আজ গোটা জাতি আক্রান্ত হচ্ছে।
ভেজাল খুনের চেয়েও বেশি অপরাধ। অধিক লাভের নেশায় যারা ভেজাল দেয় তারা সমাজের শত্রু, জাতির শত্রু। আইনের ভাষা- ভেজাল প্রতিরোধে আমাদের দেশে অনেক আইন আছে। তবে দৃষ্টান্ত শাস্তির প্রয়োগ নেই। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন দিয়েই ভেজাল নির্মূল করা সম্ভব। এ আইনের ২৫ (গ) এর ১ (ঙ) ধারায় খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল মেশালে বা ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করলে অপরাধী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবতজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও ক্ষতিকর প্রসাধনী সামগ্রি বিক্রি বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন (যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর) করলে অপরাধীকে ৫ বছর মেয়াদের কারাদণ্ড বা যেকোন মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়া ২০০৫ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে ভেজাল পণ্য উৎপাদনে যাবতজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার আইন-ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোন ভোক্তা কোনো পণ্য ভেজালের অভিযোগ আনলে এই পণ্য পরীক্ষার ব্যয় ভোক্তাকে বহন করতে হবে। আইনে ৬২ (৩) ধারায় বলা আছে, ম্যাজিস্ট্রেট কোনো পণ্যের নমুনা গবেষণাগারে প্রেরণের পূর্বে উক্ত পণ্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীরক্ষার ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত অর্থ বা ফি জমাদানের জন্য অভিযোগকারীকে নির্দেশ প্রদান করবেন। কেমিক্যাল ও ফরমালিনযুক্ত ফল ও খাদ্যদ্রব্য চেনার উপায় - * আম কাটার পর চামড়ার নিচে ফলের অংশ কাঁচা পাওয়া যাবে। যদিও চামড়াটি রং এ বর্ণ ধারণ করেছিল। * ঝুড়িতে বা দোকানে সব ফল একই সময়ে একই রকম পাকা দেখা যায় এবং দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ফলের চামড়ায় আঁচিল বা তিলের মতো রং দেখা যায়। * প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় যে ফল পাকে তাতে মাছি বসবে। আর কেমিক্যাল দ্বারা পাকানো ফলে কখনও মাছি বসবে না। * প্রাকৃতিকভাবে পাকা ফলের চামড়া উঠানোর পর এক ফোঁটা আয়োডিন দিলে তা গাঢ় নীল বা কালো বর্ণ ধারণ করে। * কেমিক্যাল মিশ্রিত মাছের রং ফ্যাকাশে হবে। * কেমিক্যালযুক্ত খাদ্যদ্রব্র, ফলে মাছি বসে না। ফরমালিন ও কার্বাইড থেকে বাঁচার উপায়- * ফল- ফল খাওয়ার আগে ১ ঘন্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় ফল পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। * সবজি- রান্না করার আগে ১০ মিনিট লবণ গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। * মাছ - ১ ঘন্টা পানিতে রাখলে ফরমালিনের ৬০ ভাগ ক্রিয়া কমে যায়। ভিনেগার ও পানির মিশ্রণে ১৫ মিনিট রাখলে ১০০ ভাগ ক্রিয়া কমে।
মো: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট
মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।