Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সর্বগ্রাসী দূষণ, পানিসঙ্কট ও সুন্দরবনের ভাগ্যবিপর্যয়

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৩ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

গত শীত মওসুমে বাংলাদেশে শৈত্য প্রবাহ ছিল না বললেই চলে। শীতের স্বাভাবিক তাপমাত্রা এবং স্থায়িত্ব ছিল অতি অল্প সময়ের জন্য। এরপর ফাল্গুনের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার কিছুদিন বাদ দিলে মধ্য এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া তাপদাহ এখনো অব্যাহত রয়েছে। রমজান মাসে কাঠফাঁটা রোদে মুসলমানদের সিয়াম সাধনা অনেক কষ্টদায়ক হয়েছিল। তাপ্রবাহ জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে আবহাওয়া অফিস থেকে সে সময় জানানো হয়েছিল। ইতিমধ্যে জুনমাস বিদায় নিয়েছে। আষাঢ় মাসের প্রথমার্ধ বিদায় নেয়ার পরও তাপদাহ কমছে না। মাঝে মধ্যে বর্ষিত সামান্য বৃষ্টিপাত ধরনীর জ্বালাময়ী উষ্ণতা কমাতে পারছে না। এ অবস্থায় মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন কষ্টকর হয়ে পড়েছে। চলতি বছরটিকে গত কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের জন্য উষ্ণতম বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আবহাওয়াবিদরা। এ কারণে শুধু বালাদেশেই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপের একটি বড় অংশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নজিরবিহীন তাপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে তাপমাত্রা বেড়ে রাস্তার পিচের সাথে সাথে গাড়ীর টায়ার গলে যাওয়ার খবরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ইতিপূর্বে ২০১৫ সালকে গত ১২৫ বছরের মধ্যে উষ্ণতম বছর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। চলতি বছরের তাপপ্রবাহ ও উষ্ণতা ২০১৫ সালকে ছাড়িয়ে গেছে বলেই মনে হয়। বিশ্বের অন্য কোথাও যাই হোক, বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের বাস্তবতায় এটা বলা যায়। একদিকে অসহ্য গরম-তাপদাহ অন্যদিকে সর্বত্র শুরু হয়েছে সুপেয় পানির সংকট। রাজধানী ঢাকায় সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। ক্রমেই তা জটিল আকার ধারণ করছে। এখন দেশের প্রায় প্রতিটা শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পানির সংকট ক্রমে ঘণীভূত হচ্ছে। একটা সময় নদনদীর পানিই ছিল স্থানীয় মানুষের সুপেয় পানির মূল উৎস। সত্তুরের দশক পর্যন্ত এ দেশের বেশিরভাগ নদনদীর পানি সাধারণ ব্যবহারোপযোগী ছিল। এমনকি বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা, বালু-তুরাগ নদীতেও জেলেরা মাছ ধরত। নদীপাড়ের মানুষ নদীতে নেমে গোসল করত। কলসি ভরে পানি নিয়ে রান্না-বান্নার চাহিদা পুরণ করত। ইতিহাসের সোনালী যুগে শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ পানির বিশেষ গুনাগুণ মসলিন সুতা ও বিশ্বখ্যাত মসলিন কাপড় বয়নে অপরিহার্য ছিল। সে সব দিন এখন শুধুই স্মৃতি। এখন বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা পার হওয়ার সময় মুখে রুমাল চেপে রাখতে হয়। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষা ছাড়াও তুরাগ ও বালু নদী ঢাকা নগরীকে বেষ্টিত করে এ শহরকে বিশেষ নিরাপত্তা, সৌন্দর্য ও পরিবেশগত সুষমা দান করেছিল। সে সব নদনদী এখন দূষণ ও দখলে বিলীন হয়ে ঢাকা শহরকে বসবাসের অযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এমনিতে সারাবিশ্বই এখন উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সংকট হিসেবেই চিহ্নিত হচ্ছে। যে সব দেশ গত একশ বছর ধরে প্রতিদিন লাখ লাখ টন ফসিল জ্বালানী পুড়িয়ে বায়ুমন্ডলে বছরে লাখ লাখ কাবর্ন ডাই অক্সাইড, মিথেন গ্যাসসহ বনভূমি ও প্রাণ-প্রকৃতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস ছড়িয়েছে, ভূমন্ডলের উষ্ণায়ণ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য মূলত ঐ সব দেশই দায়ী। কিন্তু চরম দরিদ্র কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশের পরিবেশ, প্রাণপ্রকৃতি ও জীব-বৈচিত্র্য কেন এমন ঝুঁকির মধ্যে পড়ল তার হিসার খুঁজে বের করে প্রতিকার করতে না পারলে আমাদের পুরো দেশই আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাসযোগ্যতা হারাবে।

অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির চাকার দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিল্পায়ণ, নগরায়ণ, ব্রিজ-ওভার ব্রীজসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ডিজিটালাইজেশনের চক্রে আমাদের দেশ এখন মধ্য আয়ের দেশে পরিনত হতে চলেছে। জাতীয় বাজেটের আকার প্রতিবছরই রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একই সাথে এই দেশের রাজধানী শহরটি বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকার প্রথম সারিতে স্থান পাচ্ছে। রাজধানী শহরে গাড়ী নিয়ে চলাচল করা যায় না। ঢাকায় যানজট আগেও ছিল এখনো আছে। পনের বছর আগে ঢাকায় গণপরিবহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার। এই গতি বাড়িয়ে শহরকে যানজট মুক্ত করতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শহরে একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মান করা হয়েছে। সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্যের মধ্যেও ঢাকায় নতুন রাস্তা ও সংযোগসড়ক নির্মান করার প্রয়াস অব্যাহত থাকলেও এখন ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গতিবেগ ঘন্টায় গড়ে ৭ কিলোমিটারের কম। ঢাকার জনবসতি ও নগরায়নের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকায় গণপরিবহনের গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৪ কিলোমিটারে নেমে আসতে পারে বলে নগরবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এই গতি মানুষের পায়ে হ্াঁটার গতির চেয়েও কম। একদিকে আমাদের সরকার এবং নগর পরিকল্পনাবিদর মেট্রো রেল, ম্যাগলেভ এবং হাইস্পীড মাস ট্রান্সপোর্টের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যস্ত অন্যদিকে নগরীর দুই কোটি মানুষের রাস্তায় চলাচলের গতি ক্রমে শ্লথ হয়ে পড়ছে। যাত্রাবাড়ি-গুলিস্তান, খিলগাও, মহাখালি ও মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মান হলে শহরের যানজটের চিত্র পাল্টে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল নগরবাসি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি যে হয়নি তা নয়। তবে সামগ্রিকভাবে নগরির ট্রাফিক ব্যবস্থা আগের চেয়েও শ্লথ হয়ে পড়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থা নগরীর বাসযোগ্যতা, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডের গতিশীলতার অন্যতম মানদন্ড হলেও নগরীর বাসযোগ্যতার মাপকাঠি নিরূপণ করতে আরো অনেক কিছুই হিসাব করতে হয়। বিশেষত পানি ও বাতাসের পরিশুদ্ধি ও সহজলভ্যতা ছাড়া কোনো স্থানকেই মানুষ বা প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য বলে গণ্য করা যায়না। অক্সিজেন ছাড়া আমরা এক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারিনা। একইভাবে পানি ছাড়াও একদিন বেঁচে থাকা দুষ্কর। আমরা সৌভাগ্যবান এ কারণে যে, এই ঢাকা শহরে আমরা এখনো সুস্থ্যভাবে বেঁচে আছি। কিন্তু কতক্ষণ, কতটা সুস্থ্য আছি আমরা? আমাদের চারপাশে লাখ লাখ অসুস্থ্য মানুষ, শহরের সরকারী বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। শহরের সব প্রান্তের অলিগলিতে যত্রতত্র গড়ে উঠছে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনোস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টার। শহরে মুদি দোকানের চেয়ে ফার্মাসি বা ওষুধের দোকান বেশি। সরকারী বেসরকারী শতাধিক মেডিকেল কলেজ থেকে প্রতিবছর হাজার শিক্ষার্থী এমবিবিএস পাস করেই চেম্বার পেতে বসে যাচ্ছে। কোটি মানুষের পর্যায়ক্রমিক অসুস্থতার উপর ভর করে হাসপাতাল ব্যবসায়ী ও ডাক্তাররা অল্পদিনেই কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। আর স্বদেশের চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন একশ্রেনীর স্বচ্ছল মানুষ সাধারণ ও দূরারোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে মেডিকেল ট্যুরে যাচ্ছেন। এদের মাধ্যমে প্রতিবছর দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মূদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশে কোটি মানুষ নানাবিধ অসুস্থতায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, খাদ্যে ভেজাল এবং ত্রæটিপূর্ণ জীবন যাপন পদ্ধতি এবং সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে বেড়ে ওঠা মানসিক চাপ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষনা প্রতিষ্ঠান হেল্থ ইফেক্ট ইনস্টিটিউট ও ইনস্টিটিউট ফর হেল্থ মেট্রিক্স অ্যান্ড অ্যাভুলিউশন যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণা জরিপে ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শধুমাত্র বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ২২ হাজারের বেশী মানুষের মৃত্যু ঘটে বলে তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ফসিল জ্বালানীর ব্যবহার এবং শিল্পায়নে বাংলাদেশ শিল্পোন্নত কোনো দেশের সমকক্ষ নয়। চীন বা ভারতেরও কাছাকাছি নয়, তারপরও বাংলাদেশের রাজধানী কেন বিশ্বের অন্যতম দূষিত বায়ুর শহর? বাংলাদেশ কোনো ল্যান্ডলক্ড কান্ট্রি নয়, হিমালয় থেকে নেমে আসা অসংখ্য নদী বাংলাদেশকে করেছে নদীমাতৃক। তিব্বত, নেপাল ও ভারত হয়ে নদীগুলো বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। নদী ছাড়াও অসংখ্য বিল-ঝিল, হাওর-বাওরের এ দেশে পানির সংকট একটি চরম বাস্তবতা। দেশের নদী বিধৌত অঞ্চলগুলোতেও এখন সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নদীতে পর্যাপ্ত পানির অভাবে অধিকাংশ বড় সেচ প্রকল্পে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। খোদ রাজধানী ঢাকায় সুপেয় পানির যে সংকট দেখা যাচ্ছে, কোনো ল্যান্ডলক্ড বা মরুভ’মির শহরেও সুপেয় পানির এমন সংকট দেখা যায় না। ঢাকার চারপাশে নদীর পানির দূষণ এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, এখন কোনো পরিশোধন প্রক্রিয়ায় এই পানিকে নিরাপদ ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যাচ্ছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ লাইনের প্রায় পুরোটাই মারাত্মক ক্ষতিকর নানা উপাদান দ্বারা দূষিত। শহরের ৯৪ভাগ আবাসিক গ্রাহককে ওয়াসার পানি ফুটিয়ে পান করতে হচ্ছে। এর ফলে শুধু পানি ফুটাতে বছরে শত শত কোটি টাকার গ্যাস পোড়ানো হচ্ছে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। নিরাপদ পানি সরবরাহে ওয়াসার ব্যর্থতার উপর ভর করেই ঢাকায় ব্যঙের ছাতার মত মিনারেল ওয়াটার প্লান্ট বা বোতলজাত পানির রমরমা ব্যবসায় জমে উঠেছে। বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব তথাকথিত মিনারেল ওয়াটারের বেশীরভাগই অনিরাপদ ও দূষিত বলে প্রমানিত হয়েছে। যে দেশের সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষ শহরে মানুষের কাছ থেকে সব রকম রাজস্ব আদায় করেও নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে না। যে দেশের মানুষ নিজেদের নদী এবং বাতাসকে দূষিত ও বিষাক্ত করে তোলার মধ্য দিয়ে নিজেদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ করে দিতেও কোনো সঙ্কোচ বা বাঁধা অনুভব করে না, সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদি হওয়ার আর কিছুই থাকে না। আমরা বাংলাদেশে এখন এমনই এক সংকটকাল অতিক্রম করছি। দূষিত পানির যে কোনো নদী সংশ্লিষ্ট জনপদের জন্য অভিশাপ বা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ঢাকার বুড়িগঙ্গাসহ চারপাশের নদীগুলোর দূষণ এই শহরটিকে অস্তিত্বের সংকটে ঠেলে দিয়েছে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এখন থেকে শক বছর আগে লন্ডনের টেমস নদীর পানিও আমাদের বুড়িগঙ্গার মত দূষিত হয়ে পড়েছিল। সেই যুগে নদী দূষণের অভিশাপ ও জঞ্জাল মুক্ত করতে লন্ডনের নগর কর্তৃপক্ষ সফল হয়েছিল। উন্নত বিশ্বে এমন আরো অনেক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। এসব দৃষ্টান্ত সামনে রেখে ঢাকার নদীগুলো একদিন দূষণমুক্ত হবে। আবারো এসব নদীতে গোসল করতে নামবে মানুষ। সেখানে মাছ ও জলজ উদ্ভিদ জন্মানোর মত পরিবেশ ও বায়োলজিক্যাল উপাদান ফিরে আসবে। জেলেরা আবার মাছ ধরবে। এমন স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নের মধ্যেই আমাদের সত্যিকারের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও নিরাপত্তা।

বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তার সাথে বেড়ে চলেছে বায়ুদূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ ও শব্দদূষণের মাত্রা। কয়েকদিন আগে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশ কুয়েতে ৬৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পৌছে যায়। একে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ প্রাকৃতিক তাপমাত্রা হিসেবে ধরা হচ্ছে। এয়ারকন্ডিশন্ড বাড়ি ও কর্মস্থলে অভ্যস্থ মরুভ’মির দেশের নাগরিকরা হয়তো এই তাপমাত্রা নিয়ে ততটা বিচলিত নয়। তাদের বাতাস এখনো ঢাকার মত দূষিত হয়নি, তারা নদী দূষণেও আক্রান্ত নয়। এমনকি আমাদের অনেক এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানিও আর্সেনিকে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। বিষাক্ত বাতাস, দূষিত ও বিষাক্ত পানি নিয়ে আমাদের পক্ষে কি কখনো শারিরীক-মানসিক সুস্থ্য জাতি গড়ে তোলা সম্ভব। আর কোটি কোটি মানুষ অসুস্থতার সম্মুখীন হওয়া কোনো জাতির পক্ষে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা সাংস্কৃতিকভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সাবেক আমলের উন্নয়নের গতানুগতিক ধারণা এখন আমূল পাল্টে গেছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়ন করতে গিয়ে পরিবেশগত বিপর্যয়, বিশ্বের উষ্ণায়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন ও ভয়ঙ্কর সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে বিশ্ব। এ কারণেই সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা টেকসই উন্নয়নের মানদন্ড নির্ধারণ করেছে জাতিসংঘ। পরিবেশগত সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং মানুষের মানবিক গুন ও মূল্যবোধ বাদ দিয়ে সভ্যতার উন্নয়ন অগ্রগতি কল্পনা করা যায় না। ফসিল জ্বালানী নির্ভর আত্মঘাতী উৎপাদন ব্যবস্থার বিপরীতে বিশ্ব যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানী, পারমানবিক জ্বালানী এবং অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর জ্বালানী ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা সুন্দরবনের মত অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রতিরক্ষাব্যুহকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার অবিমৃশ্যকারী প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছি। সামান্য কিছু সুবিধাভোগি ও দলকানা ব্যক্তি ছাড়া দেশের প্রায় সব মানুষ এখনো সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নের বিপক্ষে রয়েছে। আমাদের দেশে তেলের খনি নেই, লোহা স্বর্ণ বা মূল্যবান ধাতুর খনি নেই। জনসংখ্যার তুলনায় কৃষিজমি ও বনভূমি অপ্রতুল। তবে বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন আমাদের, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার আমাদের, ভ‚-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষ্ময়কর প্রবাল-দ্বীপ সেন্ট মার্টিন আমাদের, সেই রয়েছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ও অর্থনৈতিকভাবে বিপুল সম্ভাবনাময় পাবর্ত্য চট্টগ্রাম। এই ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর উপর ভর করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের অপরিমেয় সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়ে আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিক কুশীলবদের যত ভাবনা ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হচ্ছে মূলত এসব ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনাকে ঘিরেই। কথা ছিল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে দেশের প্রথম বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কোম্পানীর সাথে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্প গত সাত বছরেও উৎপাদনে যাওয়ার কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি। অথচ এর চারবছর পরে শুরু করেও চীনা সহযোগিতায় সমান ক্ষমতাসম্পন্ন (১৩২০ মে.) পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র খুব শীঘ্রই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে চলেছে। একইভাবে প্রস্তাবিত মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জাপান সরকার সম্প্রতি দেড় বিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে। গত এক দশকে দেশের বিদ্যুৎখাতের উপর অগ্রাধিকারভিত্তিক জোর দেয়া হলেও প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। এখনো অনেক বেশি দাম দিয়ে রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দের প্রথম ইউনিটের কাজ সমাপ্তির পথে রয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শেষ হতেও খুব বেশী দেরি হবে না বলে জানা যাচ্ছে। বাংলাদেশে অবকাঠামো উন্নয়নে খুব দ্রæত কাজ শেষ করার অনন্য রেকর্ডং রয়েছে জাপানীদের। সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে মাতারবাড়ি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শেষ হতেও খুব বেশি দেরি হবে না। পাশাপাশি রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজও দ্রæত এগিয়ে চলেছে। এহেন বাস্তবতায় রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে বিতর্ক নতুন মাত্রা লাভ করেছে। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় সুন্দরবনকে ইতিমধ্যে এনডেনর্জাড শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। আগামী শুক্রবার থেকে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠেয় ইউনেস্কোর ৪৩তম অধিবেশনে বিশ্ব ঐহিহ্য হিসেবে সুন্দরবনের অবস্থান পুন:নির্ধারণ করবে ইউনেস্কো। বিশেষত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরেই সুন্দরবন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তি ও আশঙ্কা। বিশ্বের সব মানুষ যাই বলুক, সুন্দরবন নিয়ে শঙ্কা ও সংকটের ভুক্তভোগি হবে বাংলাদেশের মানুষ। বিদ্যুতের অনেক বিকল্প থাকলেও আমাদের জন্য সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। যেখানে দূষণ, নিরাপত্তা ও পরিবেশগত কারণে বিশ্বের অনেক তাপবিদ্যুৎ ও পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, সেখানে বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার আগেই সুন্দরবনে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সরকাকে নতুন সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

 

 


সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বন্ধ হবে কবে?
আবু জাফর সিদ্দিকী

টেলিভিশনের পর্দায় তাকালে বা পত্র-পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে দুই যুবক নিহত, তিন গরু ব্যবসায়ীকে ধরে নিয়ে গেছে বিএসএফ, দুই দিন পরে তাদের লাশ ফেরত পাঠায়। এই হচ্ছে আমাদের সাথে প্রতিবেশী ভারতের আচরণ। প্রতিবেশী দেশের আচরণ কি এটা হওয়া উচিত? ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার প্রতিশ্রæতি দেওয়ার পরও সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা বন্ধ হয়নি। এমনকি সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনও দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারেনি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। দুই দেশের মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতিশ্রæতি রক্ষা না করার এ ধরনের উদাহরণ খুব কম। ভারতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় কোথাও কোনও দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যদি প্রতিবেশির সঙ্গে সমস্যার সমাধান না করা যায়, তাহলে জাতিসংঘে যাওয়ার বিকল্প নেই। ২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সীমান্তে প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। পরবর্তীতে ২০১১ সালে বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তিও করে। ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয় বারবার। এরপরও চলছে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা। এদের মধ্যে ১২ জনকে গুলি করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে। ২০১৫ সালে হত্যা করা হয় ৪২ জনকে, সে বছর তাদের নির্যাতনে আহত হয়েছে ৬৮ জন, ২০১৬ সালে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। আর ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএসএফ ১৮ জনকে হত্যা করে। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের হাতে মারা গেছে ৯৩৬ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে বিএসএফের হাতে ৭৬৭ জন ও ভারতীয়দের হাতে ১৬৯ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে।

বিজিবির দেওয়া তথ্য মতে, ২০০৯ সালে ৬৭ জন, ২০১০ সালে ৬০ জন, ২০১১ সালে ৩৯ জন, ২০১২ সালে ৩৪ জন, ২০১৩ সালে ২৮ জন, ২০১৪ সালে ৪০ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন, ২০১৬ সালে ৩১ জন এবং ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ জন নিহত হয়েছে। পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গেও তো ভারতের সীমান্ত আছে, সেখানে তো এসব হচ্ছে না। বাংলাদেশ সীমান্তে হচ্ছে কেন? ভারত বাংলাদেশের বন্ধু ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কিন্তু বহুল আলোচিত সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। দু’দেশের সীমান্তে নিয়োজিত বাহিনীগুলোর মধ্যে ঘন ঘন পতাকা বৈঠক এবং বিজিবি ও বিএসএফ-এর নিয়মিত শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বরং বাংলাদেশিদের হত্যাকান্ড ঘটেই চলেছে। বাংলাদেশের নাগরিকরা অপহরণেরও শিকার হচ্ছে।

ফেলানী হত্যা ঘটনার পরেও বিএসএফ দায়মুক্তির সুযোগ পেয়েছে। বিচার এমনভাবে হয়েছে যে, দায়মুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। একদিকে ফেলানীর মামলা নষ্ট হয়েছে, আরেকদিকে রিটটিও সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। এ ধরনের হত্যা বন্ধের জন্য যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে না। দু’দেশের মধ্যে সমঝোতা এবং এ সম্পর্কিত চুক্তি অনুযায়ী যদি কোনো দেশের নাগরিক অনুমতি ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম করে, তবে তা অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা এবং সেই মোতাবেক ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নিয়ম। গুলি করে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করা কেন? যেখানে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, মানুষ পাচার এবং চোরাচালান বন্ধে যৌথ উদ্যোগ ও দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও আস্থা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে দুই দেশ কাজ করছে, সেখানে সীমান্তে গুলি-হত্যা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। কষ্টে বুকটা ফেটে যায় যখন দেখি আমার বোন ফেলানীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে বিএসএফ, যখন দেখি গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে ঐ ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। আফসোস তাদের বিচার হয়না। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে সীমান্ত বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা, তবুও দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি দু’দেশের সরকারের।

আর কত দিন চলবে এভাবে সীমান্তে হত্যাকান্ড? আর কত মায়ের বুক খালি হবে? এই বর্বরতার একটা শেষ চাই, এই নৃশংসতার অবসান চাই। সম্প্রতি এ হত্যাকান্ড আরও বেড়ে গেছে। সকলের এখন একটাই প্রশ্ন সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধ হবে কবে? এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে একমাত্র ভারত সরকার। আর এ হত্যাকান্ড বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে যেতে হবে জাতিসংঘে।

সীমান্তে যে কোনো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিদ্যমান আইনে বিচার হবে এবং এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সীমান্তে হত্যা বন্ধের ব্যাপারে ভারতের কাছে কঠোর ও দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করা। আমরা আর সীমান্তে হত্যার বর্বরতা দেখতে চাই না।

লেখক: প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সুন্দরবন

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন