পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যানজট রাজধানী ঢাকার দীর্ঘদিনের সমস্যা। দিন যত যাচ্ছে এ সমস্যা ততই বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে তা আজ এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে উত্তরণ ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে কলকাতাকে টপকে বিশ্বের যানজটপূর্ণ শহরের তালিকায় শীর্ষ স্থানে উঠে এসেছে ঢাকা। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিওর প্রকাশিত ‘ট্রাফিক ইনডেক্স ২০১৯’-এ বিশ্বের যানজটপূর্ণ শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান এখন শীর্ষে। বিশে^র বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহরে যানজটে কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার কথা শোনা গেলেও আমাদের অবস্থা ভয়াবহ। বিশ^ব্যাংকের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এর ফলে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে আর্থিক ক্ষতির বাইরেও যানজটের আরও ক্ষতি আছে এবং সেসবও কম উদ্বেগজনক নয়। যানজটের কারণে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি হাসপাতালে নেয়ার পথে মানুষের মৃত্যুও হচ্ছে। যানজটের কারণে মানুষের পক্ষে নির্ধারিত সময়ে কোনো গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। নগরীতে বায়ুদূষণের বড় কারণও এই যানজট। এর পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যে। যানজটের কারণে রাজধানীতে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন। এভাবে চলতে থাকলে আর কিছুদিন পর হেঁটেই গাড়ির আগে যেতে পারবে মানুষ। যানবাহনের সংখ্যা যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এ নগরীতে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম। কাজেই আগামী দিনের সেই চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই যানজটের ক্ষতি শুধু কর্মঘণ্টা বা অর্থমূল্য দিয়ে নিরূপণ না করে, সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে একে মোকাবেলা করতে হবে।
যানজট এখন রাজধানীর প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। নগরীর লোকসংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যাও। সে তুলনায় বাড়েনি সড়কের সংখ্যা ও পরিধি। যেখানে একটি নগরীর মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ এলাকা সড়ক থাকা দরকার, সেখানে ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৭/৮ শতাংশ। তাছাড়া দেশের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ের অবস্থান ঢাকায় হওয়ার কারণে রাজধানীর ওপর চাপ বাড়ছে। প্রতিদিন গ্রাম বা অন্যান্য শহর থেকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় আসছে। যানজটের অন্যতম কারণও এটি। এজন্য নীতিনির্ধারকরাই দায়ী। সময় থাকতে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং কাজে লাগালে যানজট পরিস্থিতি এতটা জটিল আকার ধারণ করত না। সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় নগরীতে গাড়ির সংখ্যা বাড়লেও গণপরিবহন সংকট হয়েছে তীব্র। গণপরিবহনের সংখ্যা ও সেবার মান বাড়লে এবং এ খাতে অরাজকতা বন্ধ হলে রাজধানীর সড়কে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি নামানোর প্রয়োজন হতো না। আশার কথা, বিলম্বে হলেও সরকার রাজধানীর যানজট নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় গুণগত পরিবর্তন আনার পাশাপাশি যানজটের কেন্দ্রবিন্দুগুলো চিহ্নিত করে নির্মাণ করা হচ্ছে বড় বড় ফ্লাইওভার। মেট্রো রেল নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নের কাজও শুরু হয়েগেছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকাকে যানজটমুক্ত নগরী হয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা কেউ দিতে না পারলেও সমস্যা যে কমবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেল লাইনের অবকাঠামো দৃশ্যমান হতে দেখে আশার সঞ্চার হচ্ছে ঢাকাবাসীর মনে। কিন্তু এ প্রকল্পের ধীর গতির নির্মাণ কাজ মানুষের ভোগান্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। মেট্রো রেলের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা দখল নেয়ায় যানজট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মেট্রো রেলের জন্য কোনো কোনো স্থানে বিদ্যমান রাস্তার এক তৃতীয়াংশ, কোনো কোনো স্থানে অর্ধেক আবার কোনো কোনো স্থানে তার চেয়ে বেশি অংশ দখলে নেয়া হয়েছে। ফলে গাড়ি চলাচলের রাস্তা হয়ে গেছে খুবই সরু। চার লেনের রাস্তা হয়েছে দুই লেনের। আবার যেসব স্থানে মেট্রো রেলের স্টেশন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত সেসব স্থান দিয়ে বড়জোর একটি করে গাড়ির চলাচলের ব্যবস্থা আছে। এই অবস্থায় মেট্রো রেল নির্মাণাধীন এলাকার যানজটের ভয়াবহতা অবর্ণনীয়। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মিরপুর ১২ নম্বর থেকে মতিঝিলের ১২/১৩ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে কখনো কখনো সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। সেক্ষেত্রে ঘণ্টায় গাড়ির গতি হয় প্রায় ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে অনেক কম। আবার মতিঝিল থেকে মিরপুর ১২ নম্বর যেতে যে সময় লাগে, প্রায় সেই একই সময়ে ঢাকা থেকে সড়ক পথে আড়াইশ’ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এখন চট্টগ্রাম পৌঁছে যাওয়া যায়।
মেট্রো রেলের মতো মেগা প্রজেক্টের অবকাঠামো নির্মাণ করতে গেলে সাময়িকভাবে জনদুর্ভোগ বাড়ে এবং সাধারণত মানুষ তা মেনেও নেন। তাই বলে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোনো পরিকল্পনা থাকবে না তা তো হতে পারে না। তবে প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়- রিকশা, ভ্যানসহ তিন চাকার গাড়ি এবং থ্রি-হুইলার গাড়ির চলাচলে নিয়ন্ত্রণ, কিছু গাড়ির রুট পরিবর্তন এবং যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা না করে নির্ধারিত স্থানে গাড়ি থামানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা, ফুটপাত সংকুচিত করে গাড়ি চলাচলের রাস্তার বিস্তার বাড়ানো, মেট্রো রেলের কাঠামো নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত গাড়ি, যন্ত্রপাতি এবং নির্মাণ সামগ্রী নির্ধারতি স্থানের বাইরে না রাখা, ফুটপাত হকারমুক্ত রাখা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যথাযথ গুরুত্ব দেয়াসহ আরো অনেক কিছুই প্রজেক্ট পরিকল্পনায় আছে। এ পরিকল্পনা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে, বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই বললেই চলে। ফলে মিরপুর ১২ নম্বর থেকে রোকেয়া সরণি হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত রাস্তায় যানজট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই অবস্থার নিরসন না করেই আগারগাঁও থেকে ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত অংশের মেট্রো রেলের নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছে। এতদিন মিরপুরের মানুষ না হয় কষ্ট করে হলেও যাতায়াত করেছে, কিন্তু এখন যে অংশে নির্মাণ শুরু হয়েছে সেটিকে শুধু রাজধানীর লাইফ লাইন না বলে, বরং দেশের লাইফ লাইন বলাই ভালো। কারণ সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়, সচিবালয়, উচ্চ আদালত, প্রেসিডেন্টের বাসভবনসহ দেশ পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে গরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে চলাচলের জন্য এ রাস্তাটির গুরুত্ব সর্বাধিক। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, বুয়েট, বারডেম, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের মতো আরও অনেক গরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তো আছেই। এখন মিরপুরের মতো অবস্থা যদি আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশেও হয় তাহলে শুধু রাজধানীবাসী নয়, বরং গোটা দেশবাসীই ভোগান্তির শিকার হয়ে বিপর্যস্থ হবে।
নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেল রুটের যানজটকে সহনীয় রেখে রাজধানী তথা দেশবাসীকে কিছুটা হলেও সস্তিতে রাখার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। বিদ্যমান ট্রাফিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সেটা খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। আমাদের ট্রাফিক বিভাগের দক্ষতা এবং সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। তারা স্বল্প সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়েও ঢাকার মতো সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং অপরিকল্পিত একটি নগরীকে যতটা যানজটমুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন তা প্রশংসনীয়। এটাও সত্য, ট্রাফিক বিভাগের অনেক সৎ, দক্ষ সদস্যের পাশাপাশি কিছু অসাধু লোকজনও আছেন, যাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার পাশাপাশি নানা অভিযোগ আছে। এমনকি রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখনো গাড়ি বিশেষ করে ট্রাক, মিনি ট্রাক, ভ্যান থামিয়ে অর্থ আদায়ের দৃশ্যও চোখে পড়ে হরহামেশা। তাছাড়া পরিবহন সেক্টরের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি আছেন যারা ট্রাফিক বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। তাই সদিচ্ছা এবং সক্ষমতা থাকলেও ট্রাফিক বিভাগের সীমাবদ্ধতাগুলো অস্বীকার করার উপায় নেই। অনেকে মনে করছেন, মেট্রো রেল নির্মাণ কাজে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করতে পারলে যানজট এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করত না। কারণ হাতির ঝিল, পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে তারা তাদের সক্ষমতা ও আন্তরিকতা দেখিয়ে যাচ্ছেন। ইতোপূর্বে তারা সাময়িকভাবে রাজধানীর যানজট মোকাবেলায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে সফল হওয়ার দৃষ্টান্তও তারা রেখেছেন। তাছাড়া বর্ষা সমাগত। মিরপুর, কাজীপাড়া, সংসদ ভবনের সামনের রাস্তা, মতিঝিলসহ মেট্রো রেল রুটের বিভিন্ন অংশে এমনিতেই পানি জমে নদী হয়ে যাওয়ার দৃশ্য আমরা গত কয়েক বছর থেকেই দেখছি। কোনো কোনো সময় পানি জমে গাড়ি চলচাল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়, অনেক স্থানে তখন নৌকা দিয়ে মানুষকে যেতে হয়। এখন মেট্রো রেলের জন্য রাস্তার অর্ধেক অংশ দখল হয়ে যাওয়ার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।