Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এই প্রজম্মেই ফিস্টুলার হোক অবসান

প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

প্রতি বছর ২৩ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক ফিস্টুলা দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্ব সহকারে এ বছর দিনটি পালিত হয়েছে। এ বছর ফিস্টুলা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ছিল “এই প্রজন্মেই ফিস্টুলার হোক অবসান”।
ফিস্টুলা বলতে এ ক্ষেত্রে মহিলাদের ফিস্টুলা বোঝানো হয়েছে। মহিলাদের ফিস্টুলা এমন একটি রোগ যখন আক্রান্ত মহিলার যোনিপথ দিয়ে সবসময় প্র¯্রাব বা পায়খানা বা উভয়ই ঝরতে থাকে। বাধাগ্রস্ত প্রসবের ফলে যোনিপথ এবং মুত্রপথের মাঝখানের পাতলা পর্দা ছিড়ে গেলে এমনটা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে শুধু প্র¯্রাব ঝরতে থাকে। কোন কোন সময় যোনিপথ এবং পায়খানার মাঝখানের দেয়াল ছিড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যোনিপথ দিয়ে পায়খানা ঝরতে থাকে। যদি উভয় পাশের দেয়াল ছিড়ে যায় তাহলে পায়খানা এবং প্র¯্রাব দুটোই ঝরতে পারে। সবসময় প্র¯্রাব বা পায়খানা ঝরার ফলে আক্রান্ত মহিলাদের শরীরে ঝাঁঝালো গন্ধ থাকে। জীবন তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠে। তারা অনেকেই বিবাহ বিচ্ছেদের শিকার হন। কেউ কেউ পরিবার এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তাদেরকে স্বাভাবিক গৃহস্থলীর কাজে পরিবার থেকে অংশ নিতে দেয়া হয় না এবং পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা অংশ নিতে পারেন না। এমনও দেখা গেছে তাদেরকে ঘরে শুতে পর্যন্ত দেয়া হয় না। ঘরের বাহিরে এমনকি গোয়াল ঘরেও তাদেরকে ঘুমাতে হয়।
শারিরিকভাবে ফিস্টুলা আক্রান্ত মহিলারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। যেহেতু তাদের সবসময় প্র¯্রাব ঝরে তাই তারা কম পানি খাওয়ার চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে প্র¯্রাবের ঘনত্ব বেড়ে যায়, বারে বারে প্র¯্রাবের কারণে সংক্রমণ হয়, কোন কোন সময় মুত্র থলিতে পাথর হয় এবং কিডনী বিকল হওয়ার মত পরিস্থিতিও তৈরি হয়। সবসময় প্র¯্রাব ঝরার ফলে তাদের ত্বকে অনেক সময় ঘা হয়ে যায়।
ফিস্টুলা একজন মহিলাকে সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। এ যেন মৃত্যুরও অধিক যন্ত্রণা। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন, বিষণœœতায় ভোগেন এবং আত্মহত্যার কথা ভাবেন।
অথচ এমন মর্মান্তিক ব্যধি সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। মূলতঃ বাধাগ্রস্ত প্রসব থেকে ফিস্টুলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে যেহেতু এখনো ৬০ শতাংশেরও অধিক প্রসব বাসায় হয়ে থাকে, তাই মহিলারা অধিক হারে ফিস্টুলার ঝুঁকিতে থাকেন। যদি সবার জন্য দক্ষ হাতে প্রসব সেবা নিশ্চিত করা যায় তাহলে ফিস্টুলা প্রতিরোধ করা কঠিন হবে না। কোন প্রসব যদি ১২ ঘণ্টারও বেশি বাধাগ্রস্ত থাকে সেক্ষেত্রে সব মহিলাদেরই দ্রুত সেবার জন্য হাসপাতালে নিতে হবে নইলে ফিস্টুলা ও অন্যান্য প্রসবজনিত সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়।
বাধাগ্রস্ত প্রসব ছাড়াও কোন কোন সময় মহিলাদের অস্ত্রপচারজনিত আঘাত থেকেও ফিস্টুলা হতে পারে। তলপেটে বা প্রসবের রাস্তায় কোন অস্ত্রপচার হলে সেক্ষেত্রে এই সম্ভবনা সৃষ্টি হয়। জরায়ু অপসারণের জন্য যে অস্ত্রপচার করা হয় সেখানেই ফিস্টুলা হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তাই প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দক্ষ হাতে উপযুক্ত পরিবেশে সব অস্ত্রপচার নিশ্চিত করা জরুরি।
বাল্য বিবাহকে ফিস্টুলার জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয়। দেশব্যাপী উপযুক্ত বয়সে বিয়ে নিশ্চিত করা গেলে মহিলাদের ফিস্টুলা সমস্যা প্রশমিত হবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে কম বয়সে গর্ভধারনের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। সবাই এ ব্যাপারে সচেষ্ট হলে পরিবার পরিকল্পনা সেবার মাধ্যমেও আমরা ফিস্টুলা সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে পারি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সারা বিশ্বে বর্তমানে ১০ থেকে ২০ লক্ষ মহিলা ফিস্টুলা নিয়ে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন। প্রতিবছর এ সংখ্যার সাথে আরো ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ মহিলা যোগ হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০০৩ সালে টঘঋচঅ ও এনজেন্ডারহেল্থ পরিচালিত এক সমীক্ষায় জানা যায় প্রায় ৭০,০০০- এর মত মহিলা তখন আমাদের দেশে ফিস্টুলার মত রোগের উপসর্গ নিয়ে বাস করছিলেন। প্রতিবছর এই সংখ্যার সাথে আরো ২০০০ নতুন ফিস্টুলা রোগী যোগ হচ্ছে বলে মনে করা হয়। তাই ফিস্টুলা এখনো বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নারী স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত।
আশার কথা ফিস্টুলা অপারেশনের মাধ্যমে ভালো হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন ডাক্তার। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ফিস্টুলা রোগীদের অস্ত্রপচার ও আনুষঙ্গিক সেবা দেয়া হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই সেবা পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে ঃ
১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি ফিস্টুলা সেন্টার, শাহবাগ।
২। আদ্-দ্বীন হাসপাতাল (ঢাকা-খুলনা-যশোর)।
৩। ল্যাম্ব হাসপাতাল-পার্বতীপুর, দিনাজপুর।
৪। কুমুদিনি হাসপাতাল-মির্জাপুর, টাঙ্গাইল।
৫। মাম্্স হাসপাতাল-ইস্কাটন, ঢাকা।
৬। ডাঃ মুত্তালিব কমিউনিটি হাসপাতাল-বিজয়নগর, ঢাকা।
৭। ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার-ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
৮। হোপ ফাউন্ডেশন হাসপাতাল-কক্সবাজার।
এছাড়া কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই সেবা পাওয়া যায়।
সমাজের সচেতন অংশ এক্ষেত্রে অনেককে সহায়তা করতে পারেন। কারণ অনেকেই জানেন না যে ফিস্টুলার চিকিৎসা আছে-অথবা কোথায় কোথায় চিকিৎসা পাওয়া যায় ইত্যাদি। ফিস্টুলা আক্রান্তরা সাধারণত অত্যন্ত গরীব হয়ে থাকেন এবং তারা প্রত্যন্ত এলাকায় কিছুটা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। তাদের কাছে ফিস্টুলা চিকিৎসা বার্তাটা পৌঁছে দিতে পারাটা খুবই জরুরি।
ফিস্টুলা আক্রান্তদের শুধু চিকিৎসা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। এসব মহিলাদের পরিবার ও সমাজের সাথে মিলিয়ে দেয়ার দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে। তাহলেই তারা ফিরে পাবেন তাদের স্বাভাবিক জীবন। এক্ষেত্রে সামাজিক সংগঠন, সমাজপতি, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
সামাজিক ও পারবারিক পুনর্মিলন ছাড়াও সব ফিস্টুলা আক্রান্তদের জন্য প্রয়োজন সামাজিক পুনর্বাসনের সুবিধা। কারণ ফিস্টুলা রোগীরা হতদরিদ্র, সহায় সম্বলহীন। দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও হাসপাতাল ফিস্টুলা রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করে থাকে। ফিস্টুলার মত ব্যাধি কোন সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মা ও শিশু স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। ফিস্টুলার মতো ব্যাধির উপস্থিতি আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। তাই আমাদের ফিস্টুলার প্রতিরোধে ও প্রতিকারে একযোগে কাজ করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই এই প্রজন্মেই হতে পারে ফিস্টুলার অবসান।
ষ ডা. শেখ নাজমুল হুদা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এই প্রজম্মেই ফিস্টুলার হোক অবসান
আরও পড়ুন