Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকার জন্য দায়ী দুই প্রধান দলই

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে একবার অনুকূল পরিবেশে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি নিজের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন দলীয় নেতানেত্রীদের সমালোচনা করতে ছাড়েন না, অথচ জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে খুব কমই সমালোচনা করেন, এটা কেমন কথা?

উত্তরে তিনি বললেন, দেখ আবদুল গফুর, তুমি তো রাজনীতি দেখছো অনেক দিন। আর আমি অন্তত তোমার ডবল সময় রাজনীতি দেখেছি। তুমি কি এমন একটা দৃষ্টান্ত দেখাতে পারো, যেখানে কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে উঠে ও ক্ষমতার সামান্যতম অপব্যবহার করেনি বা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে থাকতে পেরেছে? এমন দৃষ্টান্ত এদেশে দেখাতে পারবে না। কিন্তু জিয়া সেটা পেরেছিল। দেশ ও জাতির জন্য যা যা করা সম্ভব তা করতে সে কখনও ভোলে নাই। শুধু তাই নয়। দেশের যে প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটি আমাদের দেশে আগাগোড়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, সেই আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে প্রথম সরকারের আমলেই গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করে, সেখানে সামরিক বাহিনী থেকে আগত রাজনীতিতে নবাগত হয়েও জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেন।

এছাড়াও জিয়াউর রহমান এদেশের জনগণের বিশ্বাসের আলোকে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার উপর বিশ্বাস’কে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ঘোষণা করে এদেশের জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। এভাবে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করেই জিয়াউর রহমান ক্ষান্ত হননি, নিজেও ব্যক্তিগতভাবে সহজ সরল জীবনযাপন করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন ইসলামী মূল্যবোধকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দানই যথেষ্ট নয়, বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানো অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশ নদী-মাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত। কারণ উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলের ছোট-বড় সকল নদ-নদী বাংলাদেশের উপর দিয়ে সমুদ্রে (বঙ্গোপসাগরে) পতিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বর্ষা মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি পাত হয়। কিন্তু বর্ষাকাল চলে গেলে এ দেশ পানিশূন্যতার কবলে পড়ে। তাছাড়া এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী ভারতের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

যদিও আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী একাধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর প্রাকৃতিক পানি-প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ, তবুও আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত মুখে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে দাবি করলেও উজানের দেশ হওয়ার সুযোগে গঙ্গা, তিস্তা প্রভৃতি নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে তার প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ থেকে বঞ্চিত করে চলেছে। ফলে এসব নদ-নদী হয়ে আসা পানি প্রবাহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ খাল বিল জলাশয় প্রভৃতি জলশূন্য হয়ে পড়ে। এসব নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েও বাস্তবে কোনো লাভ হয় না প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্রীয় নেতাদের অনুকূল মনোভাবের অনুপস্থিতিতে।

এসব কারণেই বাস্তববাদী জননেতা জিয়াউর রহমান গ্রহণ করেন তার বিখ্যাত খাল-খনন কর্মসূচী। শুধু তাই নয়, জনগণকে এ কাজে উদবুদ্ধ করার মানসে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় নেতা (প্রেসিডেন্ট) হয়েও নিজে এসব কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করতেন। এখনও জিয়াউর রহমানের কথা মনে আসলে তাঁর যে ছবিটি জনগণের মানসপটে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে খাল-খনন কাজে অংশগ্রহণ করে ক্লান্ত হয়ে খনন কাজের ব্যবহৃত পোশাকে বিশ্রামরত জেনারেল জিয়াউর রহমানের ছবি।

আগেই বলেছি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে যেখানে বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় সেখানে জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করেন। সে কারণে জিয়ার শাসনামলে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জিয়া খাল কেটে কুমীর আনার ব্যবস্থা করছেন বলে হাস্যকর সমালোচনা করতে কখনও ভুলতেন না। অথচ খাল-খনন কার্যে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে এ কাজকে অধিকতর সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিতে পারতেন তারা।

এটুকু বুঝতে কারো কষ্ট হবার কথা নয়, যে যদি দেশের সকল দল এ মহৎ কাজে সরকারকে সহযোগিতা দান করতো তাহলে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে দেশের কৃষি ব্যবস্থা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। পানির জন্য এমনকি বন্ধু রাষ্ট্রের চরম উপেক্ষার কারণে হা-পিত্যেশ করেও মরতে হতো না। জনগণের খননকৃত খালে সংরক্ষিত পানির সাহায্যে শুষ্ক মৌসুমেও কৃষি কাজ সফলভাবে চালিয়ে নেয়া সম্ভব হতো।

এতো গেল দেশের অভ্যন্তরের বিরাজমান সমস্যাসমূহের কথা। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও জিয়াউর রহমানের সাফল্য ছিল অসাধারণ ও ঐতিহাসিক। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য ছিল ঐতিহাসিক। ফলে তাঁর কর্মতৎপরতার কারণে তিনি ওআইসির অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন।

এর সুফল হয়েছিল এই যে, মধ্যপ্রাচ্যের দুটি মুসলিম দেশের মধ্যে যখন দ্ব›দ্ব চরম আকার ধারণ করে, ওআইসির পক্ষ থেকে তাঁকে এ সমস্যা নিরসনের জন্য মধ্যস্থ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়। দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তুলে উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান ছিল ঐতিহাসিক। এসবই করেন জিয়াউর রহমান, যিনি মূলত রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, মূলত যিনি ছিলেন একজন সৈনিক এবং পরবর্তীকালে সেনাবাহিনী থেকে আগত রাজনীতিবিদ।

এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে থাকাকালের তাঁর কর্মকাÐের কথাও আলোকপাতের দাবি রাখে। পাক-ভারত যুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন লাহোরের অদূরে খেমকারান সেক্টরে কর্মরত। ঐ সেক্টরে তাঁর অসমসাহসিক কর্মকাÐের ফলেই সেদিন লাহোর ভারতের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায়। এ কারণে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে তার অসমসাহসিকতার ভুয়সী প্রশংসা প্রকাশিত হয়েছিল। অথচ এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানে একটা ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল যে, বাঙালিরা যুদ্ধ করতে জানে না, তারা একটি অসামরিক জনগোষ্ঠী। জিয়াউর রহমানের এসময়কার অসমসাহসিক ভূমিকার কারণে তাদের এসব ধারণার অসত্যতা প্রমাণিত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটি আওয়ামী লীগ, অপরটি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সুদীর্ঘ সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। ১৯০৬ সালে ঢাকায় নওয়াব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার একাংশ ১৯৪৯ সালে ঢাকায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে এটির আত্মপ্রকাশ ঘটে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে। ঐ সম্মেলনের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগ গঠনের স্বপক্ষে এই ব্যাখ্যা দেন, মুসলিম লীগের মাধ্যমে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন, তা পরবর্তীকালে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কতিপয় নেতার পকেট মুসলিম লীগে পরিণত হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আমরা আম জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আম জনগণের মুসলিম লীগ তথা আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করছি।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকার একজন সাংবাদিক হিসেবে ঐ সম্মেলনে আমারও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সম্মেলনে গঠিত রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও নীতি কী হবে সে সম্পর্কে ‘মূলদাবী’ শীর্ষক একখানি মুদ্রিত পুস্তিকা পাঠ করছিলেন, অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক। এতে অন পয়েন্ট অফ অর্ডার প্রতিবাদ জানিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আগত ডেলিগেট জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, আমরা এখানে এসেছি একটা বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করতে। এতে এতো আদর্শের কচকচানি কেন?

একথার জবাবে ‘খামোশ’ বলে গর্জন করে উঠে সভাপতির আসন থেকে মওলানা ভাসানী বলেন, মুসলিম লীগ আদর্শের পথ ত্যাগ করে গণবিচ্ছিন্ন পকেট মুসলিম লীগে পরিণত হয়ে গেছে বলেই আমরা আদর্শের ভিত্তিতে আম জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করতে এসেছি। কারো যদি আদর্শ বদহজম হয় সে চলে যেতে পারে। এরকম লোকের আমাদের প্রয়োজন নেই। এর প্রতিবাদে রাগে গটগট করতে ফজলুল কাদের চৌধুরী সম্মেলন থেকে ওয়াক আউট করে চলে যান। পরে এই সভায় মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, জনাব আতাউর রহমান খানকে সহসভাপতি ও জনাব শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী লীগের প্রথম নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।

এতে প্রমাণিত হয় যে, আওয়ামী লীগ ১৯৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করলেও ১৯০৬ সালে গঠিত নিখিল ভারতে মুসলিম লীগের সাথে এর দীর্ঘ সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। পাকিস্তান আমলে ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ আমলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত হয়েছে।

সে তুলনায় বিএনপির (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি) আয়ুষ্কাল অত্যন্ত ক্ষুদ্র। বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আমলে। অথচ পরবর্তীকালে এই বিএনপি যে নিরপেক্ষ নির্বাচনে একাধিকবার দেশের প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগকে হারিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল, এটা তার পক্ষে কম কৃতিত্বের কথা নয়।

দেশে বর্তমানে আওয়ামী সরকারের অগণতান্ত্রিক রাজনীতির কারণে দেশে কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। এটা কোনক্রমেই ভালো কথা নয়। এর জন্য মূলত আওয়ামী লীগ সরকার দায়ী। তবে আওয়ামী লীগ সরকার এজন্য মূলত দায়ী হলেও বিএনপির মতো একটি জনপ্রিয় সংগঠন যে আওয়ামী লীগের অগণতান্ত্রিক রাজনীতির কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার উপযোগী আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারছে না সে ব্যর্থতার জন্য সঙ্গত কারণে তাদেরও দায়ী করতেই হবে। কারণ যে দলটি অতীতে নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়ী হয়ে একাধিকবার ক্ষমতাসীন হয়েছে তার তো বিপুল জনসমর্থন থাকার কথা। নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন বিএনপির সেরকম জনসমর্থন রয়েছে। সে জনসমর্থনকে ব্যবহার করে বিএনপি দেশে অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না কেন? এ প্রশ্নের একমাত্র জবাব বিএনপি নেতৃত্বের কার্যকর আন্দোলন সৃষ্টির ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে বিএনপি নেতৃত্ব বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বাস্তবে কার্যকর শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলবে এটাই দেশের গণতন্ত্র-ভক্ত জনগণের ঐকান্তিক কামনা ও প্রত্যাশা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতান্ত্র


আরও
আরও পড়ুন