Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শারীরের সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধে রমজান

অধ্যাপক মোঃ মোস্তফা কামাল | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০১৯, ৮:০৯ পিএম

আল্লাহ পাকের প্রিয় সৃষ্টি মানুষ। আদর ও মায়াভরা ছোয়ায় নিজ হাতে তিনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন এবং আদম ও তার সন্তানদের দিয়েছেন খিলাফতের মর্যাদা। সুতরাং তার প্রিয় সৃষ্টি মানুষেরা উপবাস থেকে, না খেয়ে কষ্ট পাক, দয়ালু আল্লাহ তা চান না। তাই প্রশ্ন জাগে আল্লাহ তায়ালা কেন এই জঠর জ্বালার কষ্টকর উপবাস রমজানকে তার প্রিয় সৃষ্টি মানুষের উপর ফরয করলেন?
এর একটা উত্তর হতে পরে, আদরের এই বান্দারা সারা বছর খাওয়া দাওয়া করে শরীরে কোলেস্টরল, মেদ-চর্বি, বিষাক্ত খাবারে দেহটাকে যেন অকেজো করে না ফেলে। তাই বিষাক্তবর্জ্য, অতিরিক্ত চর্বিসহ ক্ষতিকর পদার্থ মুক্ত করে দেহকে কর্মক্ষম ও যৌবন নবায়ন করে দেহের ফিটনেস বজায় রাখার জন্য দিয়েছেন একমাসের সিয়াম সাধনার এক অপূর্ব ট্রেনিং কোর্স।
কোরআন সুন্নাহর আলোকে শারীরিক সুস্থতায় রামাদানঃ-
আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন-“ হে ঈমান্দারগণ তোমাদের উপরে রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পুর্ববর্তীদের উপরে, যাতে তোমরা মুত্তাকি (খোদাভীরু) হতে পার (বাকারা১৮৩)। এই আয়াতে মুত্তাকি শব্দের সহজ অর্থ বাঁচতে পারা। এই বাঁচা আতিœক খোদা ভিতীর মাধ্যমে যেমন হয় , তেমনি শারীরিক রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর পদার্থ থেকে বাঁচা অর্থও হয়।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল সাঃ বলেছেনঃ-“আসসাওমু জুন্নাতুন” (হাঃনং১৯২৮ সহীহ বোখারী)। অর্থ-রোজা ঢাল স্বরুপ ।এ হাদীসে রোজা পাপের বিরুদ্ধে যেমন ঢাল, তেমনি রোগের রিরুদ্ধেও ঢাল স্বরুপ। রোজা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে রোগের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল সাঃ বলেছেনঃ “লিকুল্লি শাইয়িন যাকাতুন অ-যাকাতুল জাসাদে আসসাওমু” (হাঃ নং-১৮১৭ ইবনে মাজা) অর্থ- প্রত্যেক বস্তুর যাকাত রয়েছে আর দেহের যাকাত হলো সাওম। যাকাতের দ্বারা যেমন মাল পবিত্র হয়, সাওমের দ্বারা আতিœক পাপ মুক্তির পাশাপাশি দেহ বিষাক্ততা থেকে মুক্ত হয়।
রামাদান শব্দটি আরবী “রামদুন” ধাতু থেকে এসেছে - রামদ অর্থ জ্বালিয়ে দেয়া, পুড়িয়ে দেয়া। (মুজামুল অসীত) রামাদান যেমন পাপকে জ্বালিয়ে দিয়ে রোজাদারকে পবিত্র করে, তেমনি দেহের বিষাক্ত বর্জ্য, অতিরিক্ত চর্বিসহ ক্ষতিকর পদার্থসমুহ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিষমুক্ত হয় ।
বিজ্ঞানের আলোকে শারিরিক সুস্থতায় রামাদান : মানব দেহের সর্ববৃহত গ্রন্থি লিভার। এতে নানা প্রকার জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া সংগঠিত হয় বলে একে জৈব রসায়নাগারও বলা হয়। আমাদের খাবারের অব্যবহৃত শর্করাগুলোকে লিভার গøাইকোজেনে পরিণত করে জমা রাখে । আবার যে শর্করা দেহে ব্যবহৃত হতে পারেনা কিংবা গøাইকোজেন হিসেবে সঞ্চিত থাকেনা লিভার এই অতিরিক্ত গøুকোজকে চর্বিতে পরিণত করে জমা করে রাখে। দেহে অতিরিক্ত অ্যামাইনো এসিড, ভিটামিন, প্রোটিন, হরমোনও জমতে থাকে। বিভিন্ন খাবার ও ঔষধের যেমন মেয়াদ থাকে , মেয়াদের পর বিষাক্ত হয়ে যায়, তখন ব্যবহার করলে উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি হয়। এসব পদার্থেরও মেয়াদ থাকে প্রায় এক বছর, একবছরের মধ্যে দেহের স্টক শেষ না হলে তা টক্সিনে পরিণত হয়। এভাবে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে, শিরায় উপশিরায়, ধমনীতে , কোষে অতিরিক্ত পদার্থসমুহ এবং বর্জ্য পদার্থ সমুহ জমতে থাকে। লিভার খাবার হজমে অতিরিক্ত চাপে অকেজোর দিকে চলে যায়। অগ্ন্যাশয় অতিরিক্ত ইনসুলিন উৎপাদনের চাপে অকেজোর দিকে চলে যায়। ফলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হয় এবং শরীরের প্রতিটি অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। কোষগুলো মরতে থাকে। দেখা যায় অসংখ্য রোগ শরীরে বাসা বাধে। শরীর তার ফিটনেস হারিয়ে ফেলে। মানুষটি অকর্মা হয়ে যায়। আল্লাহপাক চাননা তার প্রিয় সৃষ্টি, তার খলিফা অকালেই অকেজো হয়ে , অকাল বার্ধক্য বরণ করুক।। তাই যৌবনকে নবায়নের জন্য, শরীরের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য বাধ্যতামুলক একমাসের সিয়াম সাধনা ফরয করলেন।
প্রখ্যাত স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ডাঃ শেলটন তার “সুপিরিয়র নিউট্রিশন” গ্রন্থে বলেছেন- উপবাসকালে শরীরের মধ্যস্থিত, প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করা জাতীয় পদার্থসমূহ স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোতে পুষ্টি বিধান হয়।
এক মাসের রোজা এক বছরের ক্ষতিকর পদার্থ সমুহ নিঃশেষ করে দেয় : গবেষকদের মতে সিয়ামের সময় দিনের প্রথম ৫/৬ ঘন্টায় সাহরীর খাবার থেকে দেহ এনার্জি দিয়ে চলে, দিনের বাকি পুরো সময়টা দেহের জমানো স্টক দিয়ে চলে।
স্টক কিভাবে শেষ হয় : (১) সিয়ামের ১ম সপ্তাহের মধ্যে দেহের জমে থাকা গøুকোজকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।
(২) ২য় সপ্তাহের মধ্যে ফ্যাটগুলোকে সুগারে রুপান্তর করে এনার্জি পেয়ে অতিরিক্ত ফ্যাটমুক্ত করে।
(৩) ৩য় সপ্তাহের মধ্যে অতিরিক্ত ভিটামিনগুলোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।
(৪) শেষের দিকে অতিরিক্ত অ্যামাইনো এসিড, প্রোটিন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।
সিয়ামের এই সময়টাতে কোষের অভ্যন্তরে জমে থাকা বর্জ্য এবং তার নিজের ভেতরের ক্ষতিগ্রস্ত প্রোটিন কণাকে, ক্ষতিগ্রস্ত কোষকে নিজেই নিজেদের অংশবিশেষ ‘খেয়ে ফেলে’। এই পদ্ধতিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অটোফাজি। সুস্থতার জন্যই এটা দরকারি। অটোফাজিতে বিঘœ ঘটলে কোষের বর্জ্যগুলো পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করা কোষের পক্ষে আর সম্ভব হয় না। তখনই বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এসবের মধ্যে রয়েছে বেড়ে ওঠা থেকে বুড়িয়ে যাওয়া এবং ক্যানসার, পারকিনসনস , টাইপ টু ডায়াবেটিস। রোগের কাছে হার মানা প্রভৃতি অটোফাজি থিওরী আবিস্কার করে ২০১৬ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জিতে নিয়েছেন জাপানের বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওশুমির। সিয়ামসাধনার এই উপবাসের মাধ্যমেই আটোফাজি অর্জন সম্ভব। (তবে সিয়ামটা হতে হবে সুন্নতি পদ্ধতিতে অর্থাৎ খাওয়ার বাড়াবাড়ি বর্জন করতে হবে)।
বিঞ্জানীদের অভিমত পুরো এক দিনের উপবাস শরীরের ১০ দিনের বিষাক্ততা মুক্ত করতে পারে। এহিসেবে ৩০ দিনের রোজা ৩০ গুন ১০= ৩০০ দিন + সাওয়ালের ৬ রোজা ৬০দিন= ৩৬০দিন বা একবছর। (বছরে ৫ দিন রোজা রাখা হারাম তাই ৩৬৫ দিন না হয়ে ৩৬০দিন)। এ জন্যই হাদীসে এসেছে- আবূ আইউব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেউ যদি রামাযানের সিয়াম পালন করে এবং পরে এর অনবর্তীতে শাউয়ালের ছয় দিন সিয়াম পালন করে, তবে সে যেন সারা বছরই সিয়াম পালন করল। - ইবনু মাজাহ ১৭১৬, মুসলিম, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৭৫৭।
প্রাণীজগতে সিয়ামের দৃষ্টান্ত : মানুষের শারীরিক ফিটনেস আনয়নে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় সিয়াম দেহকোষে প্রভাব বিস্তার করে দৈহিক উন্নতিতে যেমন ভুমিকা রাখে। প্রাণীজগতেও তেমনটি ভুমিকা রাখে।
১) যেসব প্রাণী হাইবারনেশন বা শীত নিদ্রাযাপন করে সে সব প্রাণী শীতের ৫/৬ মাস একটানা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়, কোন কিছুই খায়না । দেহে আগের জমানো চর্বিগুলো নিঃশেষ করে বেচে থাকে, বর্ষা এলে চর্বিমুক্ত দেহে নব যৌবন ফিরে পায়- যেমন ঃ বর্ষা এলে ব্যাঙ উচ্চ গলায় যৌবনের গান গায়। কুইচ্চা, কয়েক প্রজাতির সাপ, মেরুভল্লুকও এমনটা করে থাকে।
২। মনার্ক প্রজাপতির জীবন চক্রে দেখা যায় প্রথম দিকে এরা পাট ক্ষেতে লম্বাটে কীট পোকা থাকে কিছু দিন পর এরা একধরণের সুতা দিয়ে সারা দেহ আবৃত করে ফেলে, একটি পুটলি আকারে গাছে ঝুলতে থাকে, খানা দানা বন্ধ থাকে, কিছুদিন পর খোলস ভেঙ্গে প্রজাপতি হয়ে বেড়িয়ে আকশে উড়ে। মুলত উপবাসের একটি প্রক্রিয়ায় তার জীবনে এই পরিবর্তন ঘটে। মানবের দেহ ও আতœায় সিয়ামের মাধ্যমে কাংখিত পরিবর্তন সম্ভব।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে সিয়াম : মানুষের সুস্থতার জন্য ডাক্তাররা রোগীকে ডায়েট কন্ট্রোল ও মেডিকেল ফাস্টিং এর এডভাইস করে থাকেন। যা ইসলামের সিয়ামের কাছাকাছি, এটি ইসলামের সিয়ামের কন্সেপ্ট থেকেই নেয়া হয়েছে।
১৯৭৬ সালে মস্কোরবিঞ্জানী নিকোলাইড বলেছেন-প্রাণীজগতের সুস্থতার জন্য ৩/৪ সপ্তাহের উপবাস অপরিহার্য।
পাশ্চাত্যেও চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. ক্লাইভ বলেন সিয়াম সাধনার বিধান স্বাস্থ্যসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত। সেহেতু ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে অন্যসব এলাকার তূলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় রোগ ব্যাধি অনেক কম দেখা যায়।
চিন্তাবিদ ডক্টর ডিউই, উপবাস থাকা প্রসঙ্গে বলছেন, রোগজীর্ণ এবং রোগক্লিষ্ট মানুষটির পাকস্থলি হতে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, সত্যিকাররূপে উপবাস থাকছে রোগটি।›
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে তার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সিয়াম পালনের তাওফিক দান করুন। আমীন।

আরবী বিভাগ খাড়াতাইয়া ইসঃ ফাযিল (ডিগ্রী) মাদরাসা, বুড়িচং, কুমিল্লা।
e-mail: [email protected]
পবষষ: ০১৮১৪ ৩৮৬৪৮৬

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রমজান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ