Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) প্রতি রমজানে ৬১ বার কোরআন খতম করতেন

আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

সমস্যা জর্জরিত বিশ্ব মানবের সকল প্রকার সমস্য নিরসনের যুক্তি সঙ্গত ও বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাধান দেয়ার একমাত্র দাবিদার আল্লাহপাকের বাণী মহাগ্রন্থ, বিশ^গ্রন্থ আল কোরআন। আল কোরআন সম্পূর্ণ আল্লাহপাকেরই বাণী। এর মধ্যে কারও কোনো সন্দেহ বা দ্বিমত নেই।
বিধর্মীরা কোরআনের নির্দেশের বিরোধিতা করছে বটে, কিন্তু কোরআন অধ্যয়ন, কোরআন গবেষণা থেকে বিরত থাকছে না। নিরলসভাবে গবেষণা করে চলেছে, যার ফলে তারা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় সাফল্য লাভ করে চলেছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। আর তারা গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে পাড়ি জমাচ্ছে। বিভিন্ন সূ² থেকে সূ²তর যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে চলেছে। সারা বিশ^টাকে হাতের মুঠোয় বন্দি করে ফেলেছে, মাটির নিচ থেকে বহু মূল্যবান ধাতু, তেল, গ্যাস আহরণ করে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করছে। মহাসাগরের তলদেশ থেকে তুলে আনছে অগণিত সম্পদ। এসব কাজের প্রেরণা কে দিয়েছে? সম্পদের সন্ধান কে বলে দিয়েছে? মানুষ কী করে জানতে পারল? এর একমাত্র উত্তর হলো- বিশ^ গ্রন্থ আল কোরআন। কোরআন অধ্যয়ন ও গবেষণা করেই তারা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে চলেছে। আর আমরা আমাদের নিজেদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনকে ছেড়ে দিয়ে পশ্চাত্যের ঘুণে ধরা উচ্ছিষ্ট নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের মহৌষধ হিসেবে গ্রহণ করার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি। কোরআনকে ছেড়ে দিয়েছি। অথচ রাসূলেপাক (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই সর্বোত্তম যে, কোরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে তা শিক্ষা দেয়’ (বোখারী)।
তিনি আরও বলেছেন, ‘আল্লাহপাক এই কিতাবের দ্বারা অনেক জাতিকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেছেন, আবার এই কিতাবের দ্বারাই অনেককে অধপতিতও করেছেন’ (মুসলিম)।
অর্থাৎ তারাই উচ্চ মর্যাদায় আসীন হয়েছেন, যারা এই কোরআনের শিক্ষাকে গ্রহণ ও স্মরণ করেছেন। পক্ষান্তরে যারা এই কোরআন থেকে শিক্ষা নেয়নি, গাফিলতির আবর্তে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে তারাই অপমানিত ও অধপতিত হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলেপাক (সা.) বলেছেন, ‘(কিয়ামতের দিন) হাফেজে কোরআনকে বলা হবে কোরআন পাঠ করতে থাক এবং বেহেশতের উচ্চ থেকে উচ্চ স্থানে আরোহণ করতে থাক। আর বিরতি দিয়ে পাঠ করতে থাক। যেরূপ দুনিয়াতে বিরতি দিয়ে পাঠ করতে। কারণ তোমার তেলাওয়াত যে আয়াতে গিয়ে শেষ হবে সেখানেই হবে তোমার অবস্থান’ (আহমদ, তিরমিজি)।
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতকারী প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে দশটি করে নেকী পেতে থাকে। সে হিসাবে এক খতম কোরআনে নেকী পাওয়া যায় তেত্রিশ লক্ষ ছিয়াশি হাজার ষাটটি। সুতরাং সমস্ত ইবাদতের মধ্যে কোরআন তেলাওয়াতই শ্রেষ্ঠ। আর নামাজের মধ্যে তেলাওয়াত করলে আরও উত্তম। হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) প্রতি রমজানে ৬১ বার কোরআন খতম করতেন, আর হজরত ইমাম শাফেয়ী (রহ.) প্রতি রমজানে ৫৯ বার কোরআন খতম করতেন।
এক সময় মুসলমানদের মধ্যে কোরআন পাঠের একটি রেওয়াজ ছিল, সকাল বেলা ফজরের নামাজান্তে প্রতি ঘর থেকে কোরআন পাঠের আওয়াজ ভেসে আসত। মসজিদে-মক্তবে, এমনকি কোনো কোনো বাড়ির বৈঠক ঘরে, ঘরের বারান্দায় কোরআন শিক্ষা দেয়ার প্রচলন ছিল। প্রতিটি মুসলমান তার সন্তানকে প্রথমে নিয়ে যেত কোরআন পাঠদানকারী হুজুরের নিকট। হুজুর তাকে শিক্ষা দিতেন আলিফ, বা, তা, ছা। কোরআন পড়া শিক্ষা দিতেন। সাথে শিক্ষা দিতেন, নামাজ, রোজা, অজু, গোছলের মাসলা-মাসায়েল।
বর্তমানে সে শিক্ষা প্রায় উঠে গেছে। সে স্থান দখল করে নিয়েছে পাশ্চাত্য শিক্ষা। ইসলামী তাহজীব-তামদ্দুনের পরিবর্তে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা। আজ সমাজে যে অশান্তি, অন্যায়, অবিচার, জুলুম নির্যাতন শত শিকড় ঘেরে শক্ত হয়ে বসেছে, তার কারণ হলো মুসলমানগণ কোরআনের শিক্ষা থেকে বহু দূরে চলে গেছে। যে মুসলমান জাতি একদিন সারা বিশে^ সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল, আজ সেই জাতিই বিশ^ সমাজে অবহেলিত অপমানিত। কবির ভাষায়,
‘ওয়ে যমানে মে মোয়াজ্জাজ থে, মুসলমান হো কার,
আব তুম খার হয়ে, তারেকে কোরআন হো কার।’
অর্থাৎ ‘সে যুগে তারা মুসলমান হিসেবেই ছিলেন সম্মানিত, আর তোমরা পবিত্র কোরআন ভুলে গিয়ে হয়েছ অপমানিত।’
তবে পবিত্র কোরআন পাঠ করা, এর অর্থ বুঝা এবং সে অনুযায়ী আমল না করলেও একটি ব্যাপারে জাতি যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে চলেছে। কোনো অবস্থায়ই যেন এর মধ্যে কোনো ত্রুটি না হয় সে বিষয়ে তী² দৃষ্টি রাখছে আর সেটি হলো কোরআনের পবিত্রতা রক্ষা করা। কোনো অবস্থাতেই যেন এর প্রতি কোনো বেআদবী প্রকাশ না পায় তাঁর জন্য কোরআনকে গেলাপবন্দী করে পরম যতে্নর সাথে তাকে আলমারীতে রেখে দেয়। এ ছাড়াও কোরআনের আয়াত অথবা সূরাকে অত্যন্ত সুন্দর করে লিখে আয়নায় বাঁধিয়ে বরকতের জন্য ঝুলিয়ে রাখে। কারণ জাতি জানে, যে ঘরে কোরআন থাকে সে ঘরে আপদ-বিপদ, রোগ-বালাই, ভ‚ত-প্রেত থাকে না। কিন্তু আফসোস, আমরা কোরআনের হক আদায় করতে ভুলে গেছি। আল্লাহপাক আমাদেরকে যে আমানত দিয়েছেন, সে আমানতের যোগ্য সম্মান দিতে পারিছ না। মানুষ যতই শিক্ষিত হচ্ছে ততই কোরআন শিক্ষার হার কমে যাচ্ছে। এর কারণ হলো, আমরা কোরআন শিক্ষার গুরুত্ব জনগণের মাঝে তুলে ধরতে পারছি না। কোরআন শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারিছ না। কোরআন পাঠের বিরোধিতা যেভাবে হচ্ছে, সে তুলানয় সিকি ভাগও প্রতিরোধ হচ্ছে না। বরং তাদের ষড়যন্ত্রের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে চলেছি। যে সময়টাতে কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়, অর্থাৎ সকাল বেলা, স্কুলের সময় সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে ঠিক ঐ সময়। যাতে কোনো ছেলেমেয়ে কোরআনী মক্তবে যেতে না পারে। এভাবে যে স্কুলের সময় নির্ধারণ করা হলো, কেউ তো এর প্রতিবাদ করল না। কারণ আমরা স্বীকার করে নিয়েছি যে, আরবী পড়িয়ে সময় নষ্ট করার পেছনে কোনো যুক্তি নেই।
আসল কথা হলো, পবিত্র কোরআন যে এত প্রয়োজনীয়, এর মধ্যে যে একজন মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের সমস্ত দিকনির্দেশনা আছে, কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান আছে, আছে বিজ্ঞানের কথা, সাহিত্যের কথা, চিকিৎসা শাস্ত্রের কথা, ইতিহাসের কথা, শাস্তিপূর্ণ পারিবারিক জীবনযাপনের কথা, কৃষির কথা, ব্যবসার কথা, অণু-পরমাণুর কথা, আসমান-জমীন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, বৃক্ষ-তরুলতা, রাত-দিন, সকাল-সন্ধ্যার কথা, সর্বোপরি রয়েছে আল্লাহ পাকের তাওহীদের কথা, আল্লাহ পাকের প্রতি আনুগত্যের কথা, আত্মসমর্পণের কথা, ইবাদতের কথা, আখেরাতের কথা, কিয়ামতের ভয়াবহ দিনের কথা, দোযখের আজাবের কথা, বেহেশতের পরম সুখের কথা এবং কীভাবে বললে বা ইবাদত করলে আল্লাহপাকের দিদার লাভ হবে, আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হবেন, রাসূলেপাক (সা.)-এর প্রতি আনুগত্যের স্বরূপ ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো জনগণের মধ্যে তুলে ধরার উদ্যোগের স্বল্পতা, জানার আগ্রহ সৃষ্টির ব্যাপারে উদাসীনতা, দায়িত্ব-সচেতনতার অভাব ইত্যাদিই আজ পবিত্র কোরআন শিক্ষার অনাগ্রহের মূল কারণ।
অন্যান্য ইসলামী দেশে যেভাবে কোরআন চর্চা হয়, গবেষণা হয়, প্রতিযোগিতা হয়, এভাবে আমাদের দেশের কোনো সংগঠন দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসেনি। কোরআন আবৃত্তির কোনো প্রতিযোগিতা নেই, দায়সারা গোছের যে ব্যবস্থা রেডিও-টেলিভিশনে রাখা হয়েছে, প্রয়োজনের তুলনায় তা উল্লেখ করার মতো কিছুই নয়।
কোরআন আবৃত্তি বা কেরাত যে কত শ্রুতিমধুর, একবার কেরাত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করলে বোঝানো যাবে না। একজন ভালো ক্বারী যখন কোরআন আবৃত্তি করতে থাকেন, তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, কিন্তু শোনার আগ্রহ এতটুকুও কমে না। গানের অনুষ্ঠান তখন তার নিকট মনে হবে তুচ্ছ।
পাষাণ হৃদয় হযরত ওমর (রা.) এই কোরআন শুনেই ইসলাম গ্রহণ করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সাহাবায়ে কেরামগণ কেরাত শুনিয়েই বিধর্মীদের ইসলামের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতেন। তেলাওয়াত করতেন বলে হযরত ওসমান এবনে আবিল আস (রা.)-কে তায়েফের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন (এবনে হেশাম)। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যিনি ভালো কেরাত করতেন তাকেই নামাজে ইমাম এবং দলের নেতা বানিয়ে দিতেন। একবার রাসূলেপাক (সা.) যুদ্ধাভিযানে প্রেরণের জন্য একদল সাহাবাকে জমা করলেন, সিপাহসালার নির্বাচনের জন্য তিনি কেরাত প্রতিযোগিতা শুরু করে এক অল্প বয়স্ক সাহাবীকে সিহপাহসালার নির্বাচন করলেন, কারণ তার কেরাত ছিল সবচেয়ে সুন্দর। আল্লাহপাক রাসূল (সা.)-কে কোরআন আবৃত্তি সুবিন্যস্ত ও স্পষ্টভাবে করতে আদেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ কোরআন তেলাওয়াত করতে হবে তারতীলের সাথে তথা সহজ ও সঠিকভাবে। প্রতিটি অক্ষরের মাখরাজ আদায় করে রাসূলেপাক (সা.) স্বশব্দে সুললিত স্বরে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। (মাজহারী) পরিষ্কার, বিশুদ্ধ উচ্চারণসহ শব্দে অন্তর্নিহিত অর্থ চিন্তা করে তা দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়াই আসল তারতীল।
আমাদের দেশে বহু মাদরাসা আছে, মক্তব আছে, সেখানে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয় কীভাবে? অধিকাংশ মাদরাসা-মক্তবেই তারতীল নেই। আরব দেশগুলোতে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় ছেলে মেয়েরা ক্লাব গড়ে তোলে, সেখানে কেরাত প্রতিযোগিতা হয়। এ কাজে সরকারও তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য পুরষ্কার দেয়। আমাদের দেশে সে ব্যবস্থা নেই। যদি থাকত তাহলে আমার বিশ্বাস, অশ্লীল গানের আসর বন্ধ হয়ে যেত। মানুষ গানের আসরে না গিয়ে চলে যেত কোরআন মাহফিলে। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে তারতীলের সাথে কোরআন তেলাওয়াত করার, বোঝার ও সে অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন।
(রচনাবলী থেকে সংগৃহীত)



 

Show all comments
  • MD Zakir Hossain ২৪ মে, ২০১৯, ১১:১৬ এএম says : 0
    MsssAllah
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
আরও পড়ুন