পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির সওগাত নিয়ে প্রতি বছরই আমাদের মাঝে হাজির হয় মাহে রামযান। রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাক্বওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করার জন্য মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এই সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য ও দাবি হচ্ছে মানব জীবনে তাক্বওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করা। কেবল পানাহার বর্জনের নাম রোজা নয়, বরং সিয়াম সাধনার দাবি হলো নিজেকে সংশোধন করা, আত্মগঠন করা এবং রমজানের শিক্ষা সমাজে বাস্তবায়ন করে সকল প্রকার অন্যায়-অনাচার, পাপ-পঙ্কিলতা ও প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি অর্জন করা। তাক্বওয়া বা খোদাভীতিই সকল শান্তি, নিরাপত্তা ও সুখের মূল উৎস। আল্লাহ ভীতিই মানুষকে সকল প্রকার অপরাধকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার’ (সূরা বাকারা: ১৮৩)।
তাক্বওয়ার শাব্দিক অর্থ বেঁচে থাকা। পবিত্র কোরআনে তাক্বওয়া শব্দটি তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম অর্থ ভীতি, দ্বিতীয় অর্থ আনুগত্য এবং তৃতীয় অর্থ গুনাহ বর্জন। তিনটি অর্থ একত্র করলে তাক্বওয়ার অর্থ হয়, আল্লাহর উপর ভয় রেখে তার পূর্ণ আনুগত্য সহকারে সমস্ত গুনাহ বর্জন করা। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার মিনহাজুল আবেদীন গ্রন্থে তাক্বওয়াকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথমত: শিরক থেকে বিরত থাকা বা একত্ববাদের বিশ্বাসী হওয়া। দ্বিতীয়ত: বিদআত থেকে বেঁচে থাকা বা রাসূল (সা.) এর আদর্শ অনুসরণ করা এবং তৃতীয়ত: সকল প্রকার গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা। এসব গুণাবলী অর্জনের জন্য সাধনার প্রয়োজন। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সহজে এসব গুণাবলী অর্জন করা যায়। যারা তাক্বওয়া অর্জন করে তাদের বলা হয় মুত্তাকি। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘রমজান মাস হলো, ধৈর্য ও সহানুভূতির মাস। এ মাসে যদি কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করায় তাহলে তা তার পাপমোচন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হয়।’ এ মাস মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও পারস্পরিক কলহ বিবাদ ও শত্রুতা পরিত্যাগ করে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদার-সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপনের শিক্ষা দেয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যদি এ মাসে তোমাকে কেউ গালি দিয়ে দেয় তদুপরি তুমি তাকে বল যে, আমি রোজাদার।’ মোট কথা হলো, মাহে রমজানের আহবান এবং দাবি হচ্ছে, ব্যক্তি জীবনের পরিশুদ্ধি এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে সততা, সৌন্দর্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা এবং জুলুম অত্যাচার-অনাচরের অবসান ঘটানো।
রমজান মাসে আমাদের দেশের রাজনৈতিক কার্যক্রম অনেকটা পরিচালিত হয় ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে। সারা মাস জুড়ে প্রায় প্রতিদিনই ইফতার মাহফিলে যোগদেন রাজনীতিবিদরা। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষদের নিয়েও আয়োজন করা হয় ইফতার পার্টি। তবে জাঁক-জমকপূর্ণ এসব ইফতার পার্টিতে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে উপেক্ষা করা হয়। অথচ এদেরকে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। কারণ যারাই ইফতারের আলীশান পার্টি দেন তারা অনেকে জানেনই না যে, এটা সুন্নত এবং ছওয়াবের কাজ। পবিত্র মাহে রমজান এবং সিয়াম সাধনার মধ্যে যে ইফতারের ব্যবস্থা রয়েছে এই ইফতারের সাথে রাজনৈতিক ইফতার পার্টির বহু দূরত্ব রয়েছে। কারণ এখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চর্চা করা হয়, প্রতিপক্ষকে হেয় করা হয়, গীবত-পরনিন্দা, মিথ্যা ইত্যাদির চর্চা করা হয়, ইসলামের অনেক ফরজ বিধানকেও এসব ইফতারপার্টিতে জলাঞ্জলি দেয়া হয়। মহান রাব্বুল আলামীন ইফতারের সময় রোজাদারের পাপ মোচন করেন, তার দোয়া কবুল করেন, আল্লাহ বান্দার উপর বিশেষ রহমত বর্ষণ করেন। অথচ এসময় আমরা অন্যের দোষ চর্চায় লিপ্ত থাকি। এসব সিয়াম সাধনা তথা ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ নীতিবিরুদ্ধ কাজ। এ কারণে ইফতারপার্টিগুলোকে ইসলামের অনুপম আদর্শের ভিত্তিতে সাজানো দরকার। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, পরনিন্দা এবং প্রতিপক্ষকে আঘাত করার পরিবর্তে এখান থেকে সাম্য- মুক্তি, সহমর্মিতা, সমবেদনা, সহানুভূতি, সহাবস্থান, সম্প্রীতি, উদারতা, মানবিকতা, ক্ষমা এবং মানুষকে ভালবাসার বাণী প্রচার করা দরকার। পবিত্র মাহে রমজনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে আমরা দেশের জনসাধারণের প্রতি আহবান জানাচ্ছি, আসুন হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্রতী হই। আসুন আত্মগঠন ও চরিত্র গঠনের এ মাসে আমরা সবাই মিলে দেশ ও জাতির সমস্যা ও দুর্বলতা কোথায় তা চিহ্নিত করি এবং তা দূর করার বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং শোষণ, বঞ্চনা ও পাপাচার মুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার গ্রহণ করি।’ দুঃখের বিষয় আমাদের রাজনীতিকরা এরূপ উদারতা প্রদর্শন করতে পারেন না। যদি তা তারা করতেন এবং যদি আমরা রমজানের এ শিক্ষাটুকু গ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে আমাদের সমাজের চিত্র অন্য রকম হতে পারত।
আরেকটি বিষয় হলো যে, রমজান মাস এবং ঈদ এলেই আমাদের দেশে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। আর এর দ্বারা আমাদের দেশের ব্যবসায়ী স¤প্রদায় মানুষের প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে তাদের প্রতি শোষণের পথ অবলম্বন করেন। অন্যদিকে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। অনেক দেশে রমজান এবং ঈদ এলে খাদ্যদ্রব্য এবং পোশাক-আসাকসহ প্রয়োজীয় জিনিসপত্রের দাম হ্রাস করা হয় মানুষের প্রতি সহানুভূতি হিসেবে। কিন্তু আমাদের দেশে রমজান-ঈদ এলে এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি হয়। এই পবিত্র দিনগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেয়া তো বহু দূরের কথা, কোনো কিছুর দামই স্থিতিশীল থাকে না, বরং রমজান ও ঈদ এলেই প্রত্যেক জিনিসের দাম বাড়বে- এনিয়ে মানুষের মধ্যে রীতিমত আতংক বিরাজ করে। সারা বছরের ব্যবসা যেন এই মুক্তির মাস, বরকতের মাস রমজান এবং ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করেই করে নিতে হবে। রমজান এবং ঈদে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া একটি দুঃখজনক প্রবণতা। এ প্রবণতা রোধকল্পে আমাদেরকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আসুন, আমরা রমজান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনকে সত্য ও সুন্দরের দিকে নিয়ে যাই, সকল প্রকার অন্যায়কে না বলি, মানুষকে আরো ভালবাসতে শিখি, স্বার্থপরতা ও শোষণের কাল হাত গুটিয়ে নেই এবং সহানুভূতি ও সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করি মানুষের তরে, গড়ে তুলি শান্তি ও সম্প্রীতির এক সুন্দর সমাজ।
লেখক: কলামিস্ট, গ্রন্থকার, পেশ ইমাম ও খতীব, পূর্বভাটপাড়া জামে মসজিদ, মেজরটিলা, সিলেট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।