Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কবে ফিরবে স্বজনরা

গুম হওয়া পরিবারের অব্যক্ত আর্তনাদ

বিশেষ সংবাদদাতা : | প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

৯ বছরে ৫০৭ জন, ১৮ সালে ৯২, তিন মাসে ১২

সন্তান ও স্বজনদের গুম করেও ক্ষ্যান্ত হয়নি। এখনো অব্যাহত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বুকের ধন হারিয়ে এখন নিজেদের বেঁচে থাকাও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্তানদের ফিরে পেতে শত দুয়ারে ঘুরেও মেলেনি আশার আলো। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে তাদেরকে। কারো কপালে মিলেছে প্রিয় সন্তানের লাশ। যদিও এখনো শত মায়ের বুকে চাপা পরে আছে কষ্টের পাথর। সবার জিজ্ঞাসা- কবে ফিরে আসবে তাদের বুকের ধন। গতকাল রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আপনজন হারানো অসহায় স্বজনদের অভ্যক্ত হাহাকার আর আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ। দীর্ঘ সাত বছর আগে গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদী লুনা অভিযোগ করে বলেছেন, আমার স্বামীকে ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার সাথে নাটক করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি অনেকবারই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন মঞ্চে গিয়ে আমার স্বামীর সন্ধান চেয়েছি। আশা করেছিলাম যেহেতু আমাকে কথা দেয়া হয়েছে এখন আমার স্বামীকে আমি ফেরত পাব। কিন্তু পরে মনে হয়েছে ¯্রফে একটি নাটক।
গতকাল শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত গুম ও গণতন্ত্রের অব্যাহত সঙ্কট শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন। বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদ, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন এলাকার গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা অংশ নিয়ে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
অন্যদিকে ২০১৩ সালের ৪ জানুয়ারী র‌্যাবের পোশাক পরিহিত একটি বাহিনী প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে যায় বিএনপি নেতা সাদেকুলকে। সাদেকুলের খোঁজে পরিবারের সদস্যরা যখন র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট টিমের প্রধানের কাছে যান তখন র‌্যাবের সিও হাসিঠাট্টা করে বলেছিলো গুলিস্তানেও তো র‌্যাবের পোশাক পাওয়া যায়। সাদেকুলকে যে র‌্যাব ধরে নিয়ে গেছে তার কি প্রমাণ? র‌্যাবের পোশাক পরিহিত কেউ সাদেকুলকে ধরে আনলে তারা যে র‌্যাব ছিলো এমন প্রমাণ কি? এরপর সাদেকুলকে খুজে বের করেত র‌্যাব ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিলো। আমারা আশা করেছিলাম সাদেকুলকে ফিরত পাবো। কিন্ত আজও সাদেকুলকে ফেরত পাইনি। গতকাল সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে গুম ও গণতন্ত্রের সংকট শীর্ষক এক আলোচনায় বিএনপি নেতা সাদেকুলের বোন মারুফা বেগম এভাবে তার ভাইয়ের গুমের ঘটনার বর্ণনা দেন।
মারুফার মতো আরো অর্ধ শতাধিক পরিবার এ আলোচনায় স্বজনদের গুম হওয়া এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে স্বজনের খোঁজ পেতে গিয়ে নানাভাবে লাঞ্চিত হওয়ার বর্ণনা দেন। এমনকি গুম হওয়া ব্যক্তিরা বিএনপি করার কারণে তাদের সন্তানদের বার বার ধরে নিয়ে টাকা আদায় করারও অভিযোগ উঠে আসে পুলিশের বিরুদ্ধে। মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির আয়োজনে এ আলোচনা সভায় বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনরা বক্তব্য রাখেন।
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদী আরো বলেন, সারাদেশে এখন গুম যেন মহামারী আকার ধারণ করেছে। দেশে তো অনেক দিবসই আছে। তাই তিনি গুমের একটি দিবস ঘোষণা করারও দাবি করেন। গুমকে তিনি জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিটি গুমেরই বিচার হবে। আর যতদিন না আমরা আমাদের স্বজনদের ফেরত পাচ্ছি ততদিন অন্তত বিচাররের দাবিতে হলেও এভাবে আমাদের কণ্ঠকে উচ্চকিত করেই দাবি জানিয়ে যাব।
আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে ড. শাহদীন মালিক বলেন, গুম করা মানবতাবিরোধী অপরাধ। এখন সরকারের আশিবাদপুস্ট হয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর যে সকল ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গুম করা, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত একদিন তাদের বিচার করা হবে। হয়তো সময় দিয়ে বলা যাচ্ছে না তবে তাদের বিচার হবেই। সরকারের যে সকল কর্মকর্তা সরকারের অণ্যায় আদেশ মানতে না পেরে ওএসডি হয়ে আসেন তারাই একদিন গুম এবং বিচার বহির্ভূত হত্যকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিস্ট আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসবেন।
আলোচনা সভায় ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, গুম মানবতাবিরোধী অপরাধ। জাতিসংঘের মাধ্যমে এ মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। মামলা করার সুযোগ রয়েছে। তাই আসুন যে সকল পরিবারের সদস্যরা গুম হয়েছে তারা মামলা করি। এসব মামলা দ্রুত নিস্পুত্তির জন্য আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে যাই। তিনি যেনো এসব মামলা দ্রুত নিস্পত্তির আদেশ দেন তার কাছে আমরা দাবী করি।
আনু মোহাম্মদ বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে যেভাবে মানুষকে গুম করা হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন মানুষকে ধরে নিয়ে গুম করছে, বিনা বিচারে মানুষকে হত্যা করেছে দেশটা কি এ জন্য স্বাধীন হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে টাকা খরচ করে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়, দামি দামি যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম দেওয়া হয় এসব সবই সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায়। আর সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় প্রশিক্ষন নেওয়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এখন মানুষ গুম করা বাহিনীতে পরিনত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ২০১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী গুম হওয়া রাজধানীর পল্লবী থানার যুবদল নেতা নুরে আলমের স্ত্রী বলেন, গাজিপুরের বাসা থেকে পুলিশের লোকজন তার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু থানা ও ডিবিসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে গিয়েও আজ পর্যন্ত তার স্বামীর খোজ পাননি। তার স্বামী গুম হওয়ার পর পুলিশ তার দুই ছেলেকে কয়েকবার ধরে নিয়ে গেছে। এরপর টাকা দিয়ে ছেলেদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে।
আলোচনার শুরুতে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০৭ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এক বছরে ৮০ জনকে গুম করা হয়েছে। ২০১৯ সালে জানুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ১২ জন গুম হয়েছেন। এর মধ্যে ২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ১ জন ফিরে এসেছে, ৫ জনকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার দেখিয়েছে আর ৪ জনের কোজ আজও পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালেই শুধু ৯২ জন গুম হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ১০ জন ফিরে এসেছে, ৪৭ জনের বিরুদ্ধে ফৌসদারী মামলা করা হয়েছে আর ২৭ জনের কোন খোজ আজও মেলেনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বজনরা

২৮ এপ্রিল, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ