Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাইবার ক্রাইম ও অনলাইন ব্যাংকিং নিরাপত্তা প্রসঙ্গে

প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। বিশ্বের তাবৎ জনগোষ্ঠী নানাভাবে তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত হওয়া এ সময়ের অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন ব্যাংকিং, কেনাকাটা ও লেনদেনের মধ্য দিয়ে গত এক দশকে সারাবিশ্বে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশও এর বাইরে নেই। তথ্যপ্রযুক্তির এই অবাধ বিস্তারের মধ্যদিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনিক সেবাসহ প্রতিটি সেক্টরের তথ্য ও সেবা অতি সহজেই সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়ার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হলেও ইতিমধ্যেই এ খাতে বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এক সময়ের আন্ডার ওয়ার্ল্ডের অপরাধীরা এখন সাইবার ক্রাইমে যুক্ত হচ্ছে। প্রত্যেক ব্যাংক হিসাবধারী ব্যক্তি, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যন্ত এখন সাইবার অপরাধীদের হ্যাকিং-এর টার্গেটে পরিণত হয়েছে। এমনকি বিশ্বের সকল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম রিজার্ভার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক পর্যন্ত এখন হ্যাকারদের জালিয়াতি ও ম্যালওয়ারিং-এর শিকার হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তিখাতের বিকাশ, অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুব বেশী না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে সাইবার হামলা এবং অর্থ লোপাটের ঘটনা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। এসব কারণে ডিজিটাল বাংলাদেশ শ্লোগান নিয়ে বর্তমান সরকার তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য জনগণের সামনে তুলে ধরেছিল তা’ এখন অনেকটা মøান হয়ে গেছে।
চলতি বছরের শুরুতে ঢাকাসহ সারাদেশে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের ঘটনা ব্যাপক আকারে ধরা পড়ে। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে দেখা গেছে। তবে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফ্ট কোড হ্যাক করে শত শত কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পর ব্যাংকিং সেক্টরের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। রিজার্ভ সংরক্ষণে ব্যর্থতা বা দায়িত্বহীনতার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেয়া হলেও ব্যাংকিং সেক্টরের আন্তঃব্যাংকিং লেনদেনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোন কার্যকর উদ্যোগ এখনো দেখা যাচ্ছেনা। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ক্রেডিটকার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন অথবা আন্তঃব্যাংকিং ফর্জারির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এটিএম কার্ড জালিয়াতির অপরাধে গত কিছুদিনের মধ্যে কয়েজন বিদেশী নাগরিককেও আটক করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। একটি আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধীচক্র গত ১৫ মে সকালে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাপানের বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে প্রায় দেড়শ’ কোটি ইয়েন তুলে নিয়েছে বলে জানা যায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটিকেই সাম্প্রতিক সময়ে সবচে বড় ও নজিরবিহীন অনলাইন ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুধু ব্যাংকিং সেক্টরেই নয়, সাইবার অপরাধ এখন সমাজের প্রতিটি স্তরেই ঢুকে পড়েছে। গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দেশে সাইবার অপরাধ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ফেইসবুক, ইমো, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলিং ও সামাজিক রাজনৈতিক চরিত্র হননের পথ বেছে নিচ্ছে সাইবার অপরাধীরা। ভুক্তভোগীদের খুব সামান্য অংশই এসব অপরাধের শিকার হয়ে আইন আদালতের দ্বারস্থ হন। এরপরও গত কয়েক বছর ধরে সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা বছরে ৫গুণ হারে বাড়ছে বলে জানা যায়।
সারাবিশ্বেই সাইবার অপরাধ বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে বিশেষত অনলাইন ব্যাংকিং সেক্টরের নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক অবস্থায় উপনীত হয়েছে। গতকাল সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রূপালী ব্যাংক থেকে এটিএম কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের খবর পাওয়া যায়। প্রকাশিত খবরের তথ্য সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য উঠে আসলেও দেশের ব্যাংকগুলোর অনলাইন নিরাপত্তা যে অত্যন্ত নাজুক এ বিষয়টি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। সাইবার অপরাধ দমনের নামে দেশে ইতিমধ্যে কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের তথ্যপ্রযুক্তি আইনকে অনেকে নিবর্তনমূলক আইন হিসেবেও অভিহিত করেছেন। এসব আইনের লক্ষ্য কি সাইবার নিরাপত্তা নাকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় বিরোধী মতের লোকদের দমন করা, সে বিষয়েও বিতর্ক রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিন্নমতাবলম্বীদের পাকড়াও করলেও ব্যাংকিং খাতসহ সার্বিক সাইবার নিরাপত্তায় তাদের তৎপরতার কোন সুফল দেখা যাচ্ছে না। গত এক দশকে দেশের প্রভাবশালীরা ব্যাংকিং সেক্টর থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। এখন অনলাইন ম্যালওয়্যারিং-এর মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকের গ্রাহক থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল লোপাটের ধারাবাহিক ঘটনার পরও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছেনা। ব্যাংকগুলোর বেশীরভাগই এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পালন করে কোডিং সিস্টেম ও এটিএম বুথের প্রযুক্তিগত নিরাপত্তায় যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। অন্যদিকে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম বিভাগ সাইবার অপরাধ দমনের চেয়ে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপর নজরদারী বৃদ্ধিতেই যেন বেশী আগ্রহী। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিসহ সাম্প্রতিক সময়ের এটিএম কার্ড জালিয়াতির হোতাদের খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের শৈথিল্য অথবা ব্যর্থতা দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ও আর্থিক খাতকে নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতার গভীর সংকটে ফেলে দিতে পারে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে এই নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা থেকে মুক্ত রেখে আর্থিক খাতে জনগণের আস্থা বজায় রাখতে কর্তৃপক্ষ যথাশীঘ্র কার্যকর উদ্যোগ নেবেন, এটাই এই মুহূর্তে সবার প্রত্যাশা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সাইবার ক্রাইম ও অনলাইন ব্যাংকিং নিরাপত্তা প্রসঙ্গে
আরও পড়ুন