Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাড়ছে আম বাগান বাড়ছে উৎপাদন, নেই সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থাপনা

রেজাউল করিম রাজু | প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০১৯, ২:৩০ পিএম

বিরুপ আবহাওয়া ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা করে গাছে গাছে বড় হচ্ছে আমের গুটি। হাইব্রীড জাতের গুটি গুলো গায়ে গতরে বেশ পরিপুষ্ট হয়েছে। শুরু হয়েছে বিষ বালাইমুক্ত আমের জন্য ফ্রুট ব্যাগিং লাগানো। এবার বারো কোটি আম পরবে ব্যাগ।
গাছে গাছে দোলাখাচ্ছে থোকায় থোকায় আম। এর সাথে আম চাষীর স্বপ্ন দুলছে। প্রকৃতির বিরুপ আচরন যেমন শংকা জাগাচ্ছে আবার তেমনি ভাল ফলনের স্বপ্ন কম নয়। গতবছর ভাল ফলন হলেও পায়নি ভাল দাম। বিদেশে রফতানীর জন্য আম প্রস্তুত করেও পাঠাতে পারেনি নানা জটিলতার কারনে। ফলে লোকসান গুনতে হয়েছে। সারাদেশে আমের বাগান বাড়ছে। কৃষিবিদদের হিসাবে প্রতিবছর নতুন বাগান যোগ হচ্ছে পাঁচ হাজার হেক্টর করে। এরমধ্যে বানিজ্যিক ভাবে আম উৎপাদন করা হচ্ছে আমের রাজধানী রাজশাহী অঞ্চলসহ ২৩ জেলায়। বাড়ছে বাগান বাড়ছে উৎপাদন। নেই সুষ্ঠ বাজার ব্যাবস্থাপনা।
আর্ন্তজাতিক বাজারে বাংলাদেশের আমের চাহিদা বাড়লেও রফতানীতে মনোযোগ নেই। সুষ্ঠ পরিকল্পনা করা হলে ব্যাপক আম রফতানী করা যাবে। আসবে বৈদেশিক মুদ্রা। সাথে বাঁচবে আম চাষীরা। বিগত বছর গুলোয় আম রফতানী নিয়ে হতাশ হওয়া আর রফতানীর নামে রাজশাহীর আম বলে নি¤œমানের আম পাঠানোর বিষয়টা ঘুরে ফিরে আলোচিত হচ্ছে। যার কারনে গত মওসুমে সামান্য পরিমান আম রফতানী হতে পেরেছে। মাত্র ২৩১ টন আম রফতানী হওয়া। সর্বকালের নিম্ন পরিমান।
২০১৭ সালে একজন আম চাষী আম রফতানীর ক্ষেত্রে জটিলতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করলে বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। মাঠ পয্যায়ের তদন্ত করে সত্যতা মেলে। কমিটি পরবর্তীতে বাস্তব ভিত্তিক প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা প্রনয়ন করে। কিন্তু ২০১৮ সালে সুপারিশমালা অনুসরন না করে পুরানো পথে হাটায় আম রফতানী কমে যায়। এবার যেন সুপারিশমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয় এমন প্রত্যাশা আম চাষীদের।
গত বছর আম রফতানী শুরুর আগে উদ্ভিদ সংঘ নিরোধ ইউং কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর জানিয়েছিল ২৮জন রফতানী কারক ৩১২জন আম চাষীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে মাত্র ২৩১ মে:টন আম রফতানী করা সম্ভব হয়্ এরমধ্যে ৭০টন চুক্তি ভিত্তিক আম চাষীদের কাছ থেকে নেয়া হয় আর অজ্ঞাত কারনে ১৬১টন ঢাকার স্থানীয় আড়ত থেকে সংগ্রহ করে রফতানী করা হয়্। এতে বোঝা যায় খাতা কলমের মধ্যে চুক্তি সীমাবদ্ধ ছিল।
আম বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষন করে বলছেন কোন বছরই আম রপ্তানির ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় না। যেমন চলতি মৌসুমে কি পরিমান আম রপ্তানি হবে তা আম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের (আমচাষী, আম রপ্তানিকারক, স্থানীয় কৃষি বিভাগ, আম গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় প্রশাসন) কেউ জানেন না। যদিও আমবাগান ব্যবস্থাপনা শুরু হওয়ার পূর্বেই চাষীদেরও জানানো প্রয়োজন ছিল। রপ্তানির পরে ত্রুটিসমুহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নজরে আসে ফলে কিছু করার সুযোগ থাকে না।
কন্ট্রাক্ট ফামিং পদ্ধতিটি আম রপ্তানির ক্ষেত্রে ভালো হলেও যথাযথভাবে তা অনুসরণ করা হয় না। যেমন প্রতি বছর আম সংগ্রহ করার পরপরই সংশ্লিষ্ট চাষীর সাথে চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয় না। কোন কোন সময় দেখা গেছে, আম রপ্তানি শুরুর কয়েক মাস আগে তাড়াহুড়ো করে সাদা কাগজে নামেমাত্র চুক্তি সম্পাদন করা হয়। যেখানে গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলোর একটিও উল্লেখ থাকে না। কোন জাতের আম, কখন নেয়া হবে, কত টাকা কেজি হিসেবে নিবেন এবং কত টন আম নিবেন সেই বিষয়ে কোন উল্লেখ থাকেনা। যদিও সাদা কাগজে চুক্তির কোন বৈধতা বা আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে চাষীরা তাদের নিজেদের খেয়াল খুশিমত আম উৎপাদন করে থাকেন। বিগত কয়েক বছর এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করলেও কোন লাভ হয়নি।
হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে অথবা নারায়নগঞ্জের শ্যামপুরে আমের কোয়েন্টোইন পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। আমের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চাষী প্রথমে আমবাগান থেকে আম সংগ্রহ করেন এবং প্যাকিং করে রপ্তানির জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে আসেন। পরে সেখান থেকে রপ্তানিকারকেরা আম বাছাইকরণ করে ক্রয় করে থাকেন এবং পুনরায় প্যাকিং করে নারায়নগঞ্জের শ্যামপুরে যান। সেখানে পুনরায় খোলা হয় এবং কোয়েন্টোইন পরীক্ষা সম্পন্ন করে নির্ধারিত কার্টুনে প্যাকিং করা হয়। ফলে দেখা যায়, পরিবহনের সময় ঘর্ষনজনিত কারণে আমের গায়ে দাগ পড়ে এবং ৫০-৬০ ভাগ আম বাদ পড়ে যায়। ফলে বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, একজন রপ্তানিকারক রপ্তানির জন্য ১০০০ কেজি আম চাষীর কাছ থেকে ক্রয় করলে ৫০০/৬০০ কেজি আম কোয়েন্টাইন পরীক্ষার সময় বাতিল করা হয়। সে কারণে আমদানিকারকের চাহিদানুযায়ী এবং এয়ারস্পেস বুকিং মোতাবেক আম পাঠাতে পারেন না এবং পরবর্তীতে আম রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয়।
আম রপ্তানির সমস্ত প্রক্রিয়ায় কোন আম বিশেষজ্ঞ বা আম গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। আম রপ্তানির পরিকল্পনা থেকে শুরু করে চাষী নির্বাচন/বাগান নির্বাচন, আম বাগান ব্যবস্থাপনা, আম উৎপাদন পদ্ধতি, আম সংগ্রহ, প্যাকিং প্রত্যেক ধাপে আম গবেষকের সংশ্লিষ্টতা/মতামত অবশ্যই প্রয়োজন আছে যা গত বছরগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলে চলতি মৌসুমে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে বিগত বছরের পূনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।
কোন জেলার আম কখন রপ্তানি হবে সে বিষয়ে কোন নির্দেশনা নেই। রপ্তানিকারকেরা এই বিষয়ে মূখ্য ভুমিকা পালন করে থাকে সেটি মোটেই যৌক্তিক নয়। আম সংগ্রহ করার ১০-১৫ দিন পূর্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল আম রপ্তানিকারক অঞ্চল/জেলাসমুহ সরেজমিন পরিদর্শন করে এবং আম সংগ্রহের বিষয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন যা রপ্তানির সময় অনুসরণ করা হবে।
আমের কোয়ান্টোইন পরীক্ষন শুধু নারায়নগঞ্জের শ্যামপুরে না করে আম রপ্তানিকারক জেলাসমুহে করলে আমচাষী ও রপ্তানিকারক উভয়েই উপকৃত হবেন এবং তা সাশ্রয়ী হবে। সেক্ষেত্রে সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আমের কোয়ারেন্টাইন পরীক্ষণ করলে ফলপ্রসু হবে।
যে সকল চাষী/রপ্তানিকারকের আমে নন-কমপ্লায়েন্স আসবে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে যা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। বরং সমঝোতার মাধ্যমে এক-দুইজন রপ্তানিকারতদের দ্বারা সমস্ত আম রপ্তানি করা হয়। ফলে রপ্তানি না বেড়ে কমছে প্রতি বছর।
আম রপ্তানি কোন জটিল বিষয় নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়গুলো এক সাথে পরিকল্পনা করে আম রপ্তানি করলে খুব সহজেই মোট উৎপাদনের ছোট একটি অংশ আম রপ্তানি করা গেলে প্রায় দেড় দু’ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বিষয়গুলো নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আম

২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ