পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বছরে বাঙালিয়ানার পরিচয় মেলে আমাদের কোনো কোনো দিনে? একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবিতে যে বাঙালি বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছে তা সারা বিশ্বে এখন আন্তর্জান্তিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বলে একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব কিছুতেই কমানো যায় না। এছাড়া কোনো কাজকে যখন রাজনীতির মাঠে টেনে নামানো যেত না, তখনও আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ পালিত হতো, বিশেষ মর্যাদায় পালিত হতো। এরকম ও সার্বিক আয়োজনে আমার শৈশব-কৈশরের অভিজ্ঞতা আছে, যার সাথে রাজনীতির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না। এটাই ছিল বাঙালির আদি ও অকৃতিম পরিচয়।
গত ১৪ এপ্রিল দৈনিক ইনকিলাবে প্রথম পৃষ্ঠায় বাংলা সনের জন্মকথা শিরোনামের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এতে লেখক মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে প্রচলিত হিজরি সনকে সামান্য পরিবর্তন করে বাংলা সনের জন্ম দেয়া হয়েছিল বলে বর্ণনা করেছেন। এই নিরিখে বলা যায়, বর্তমানে আমরা যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করি তার জন্মও হয় হিজরি সনের গর্ভে। সুতরাং আজ বর্তমান বাংলা ভাষা নামে যে ভাষা আমরা ব্যবহার করছি তার জন্মের পেছনেও ইসলামী ঐতিহ্যে ভরপুর হিজরি সনের অবদান রয়েছে, এমন দাবি করাটা অসঙ্গত হবে না।
বাংলা ভাষার এমনই কপাল যে, জন্মের পর থেকে পদে পদে লড়াই করে তার অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়েছে। পাল আমলে বাংলা ভাষার জন্ম। বৌদ্ধপন্থী পাল রাজাদের আমলে তার শৈশব ভালো কাটলেও কিছুদিন পর দাক্ষিণাত্ত থেকে আসা সেনদের আমলে পাল বংশ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়। উৎখাতের পর সেন রাজবংশের শাসনামলে বাংলা ভাষার জন্য দুর্ভাগ্য নেমে আসে। সেন রাজরা ছিলেন কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন হবার পর তারা তারা সংস্কৃত ভাষাকে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তাদের কাছে প্রশ্রয় পেয়ে রাষ্ট্রীয় দরবারের সাথে জড়িত ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা এই মর্মে ফতোয়া দেন যে, সংস্কৃত ভাষা দেবতাদের ভাষা। এই ভাষা অবহেলা করে যারা মনুষ্য রচিত কোনো ভাষা। (যেমন বাংলা) ব্যবহার করে তবে তারা রৌরব নরকে নিক্ষিপ্ত হবে।
জাতির যখন এমন ঘোর দুর্দিন তখন সৌভাগ্যক্রমে বখতিয়ার খিলজী বাংলা আক্রমণ করে সেন রাজাকে পরাজিত করে বাংলা দখল করে বসেন। বখতিয়ার খিলজী ভাষার প্রশ্নে কোনো বিশেষ ভাষাকে গুরুত্ব না দিয়ে সকল ভাষার প্রতি উদার নীতি গ্রহণ করেন। ফলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ঐতিহ্যের বহু পুস্তক অনুবাদের মাধ্যমে বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধি করার কাজে সুযোগ পান সংশ্লিষ্টজনেরা। এই অবস্থা চলে সমগ্র মুসলিম শাসনামলে এবং অন্যান্য ভাষা থেকে অনূদিত হয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক রচনা চলে, ভাষার উন্নতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এ অবস্থা চলতে থাকে পলাশী আমল পর্যন্ত। ইংরেজ শাসনে বাংলা ভাষার সঙ্গে ইউরোপীয় আধুনিক বিভিন্ন ভাষা পরিচয় ঘটে। সে হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা হয়। ইংরেজ আমলে অনেক দিন অনেক মুসলিম সাহিত্য সাধক ইংরেজদের অনুগ্রহপ্রাপ্ত সকল সাহিত্য প্রচেষ্টা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গ্রাম্য পুঁথি সাহিত্য চর্চার দিকে মনোনিবেশ করলেও কিছুদিন পর তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে পুনরায় আধুনিক সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ফলে মীর মশাররফ হোসেন, শেখ আবদুল রহিম, কায়কোবাদ প্রমুখ সাহিত্যিকের আবির্ভাব লক্ষ করা যায়। সবশেষে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পর মুসলিম সাহিত্য সাধকদের আর পেছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন হয়নি।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক ও রাজনীতিসচেতন কবি। ফলে ইংরেজ আমলে তাকে লেখালেখির কারণে জেলেও যেতে হয়। এরপর বাংলাদেশে আবির্ভাব হয় অমর কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমদের। কলকাতার প্রকাশকরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন, স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, হুমায়ূন আহমদের বই ভারত থেকে জনপ্রিয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই বাজার ছাড়া করতে সক্ষম হয়।
এতো গেল ভাষা ও সাহিত্যের কথা। রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান আরো বেশি কিছুদিন আগে যে কলকাতাকে উভয় বাংলার এক নম্বর মহানগর হিসেবে বিবেচনা করা হতো, আজ কলকাতা নয় ঢাকাকেই বাংলার ভাষা সাহিত্যের রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মূলে রয়েছে রাজনীতির প্রভাব। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী আর কলকাতা এখনও বিশাল ভারতের একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজধানী।
পক্ষান্তরে পাকিস্তানের সাথে সংযোগ ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংগ্রাম ইতিহাসের মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, সে সংগ্রামে ভারতে সাহায্যের প্রয়োজন পড়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেলে আটক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি প্রথম লন্ডন যান। লন্ডনে যেয়ে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন ভারতীয় বাহিনীর একটি অংশ বাংলাদেশে রেখে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে এই বিষয়ে তার ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফিরার পথে নয়াদিল্লীতে বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি কালে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, আপনার বাহিনী আমার দেশ থেকে কখন ফেরৎ আনবেন? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর অপসারণ সহজ হয়ে ওঠে।
আমরা আজকের এই আলোচনা শুরু করেছিলাম বাংলা সনের জন্ম কথা নিয়ে ইতিহাসের নিরিখে আমরা আবিষ্কার করেছি বাংলা সন ইসলামী ঐতিহ্যে ভরপুর হিজরি সনের গর্ভজাত সন্তানের মতো। আমরা আরও লক্ষ করেছি, বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্ন নিয়েও আমরা তরুণদের তাজা রক্ত অকাতরে ঢালতে পেরেছি।
বাংলাদেশের যে স্বাধীনতার সংগ্রাম তাতে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সাহায্যে পেয়েছি এই জন্য আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ আছে, যেখানে মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পাওয়ার জন্য আমাদের তরুণ তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছে। সেই নিরিখেই আসে ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখের কথা। এখন সারা পৃথিবীতে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এটা আমাদের কম গৌরবের কথা নয়। মাতৃভাষার এই মর্যাদা ইসলামীর আর্দশের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। কোরআন শরীফে সূরা ইব্রাহীমের চার নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আমরা সকল রসূলকে তাঁর কওমের মাতৃভাষার বাণী দিয়ে পাঠিয়েছি, যাতে করে তাঁরা আমার বাণীকে সহজে বুঝিয়ে বলতে পারে সকলকে।
বাংলা সন ও বাংলা ভাষার পর প্রশ্ন আসে আজকের বাংলাদেশ নামের যে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য আমরা গর্বিত যে একটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র তার ঘোষণা প্রথম আমরা শুনতে পাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম প্রত্যাবর্তন করেন তার ঘোষণার মধ্যে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি যখন পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও দিল্লী হয়ে ঢাকা ফেরেন, তার মুখে সেই দিনই উচ্চারিত হয়, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। কিন্তু শুধুমাত্র উচ্চারণের মধ্যেই তার কাজ সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই লাহোরে একটি ইসলামিক সামিট অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে বাংলাদেশ আমন্ত্রিত হয়। কিন্তু ভারত এই সামিটে যোগদানের বিরুদ্ধে ছিল। এমতাবস্থায় মওলানা ভাসানীর পরামর্শ কামনা করেন বঙ্গবন্ধু। মওলানা ভাসানী সোজাসোজি না বলে একটু ঘুরিয়ে জবাব দেন: তুমি যদি একটি স্বাধীন দেশের নেতা হয়ে থাক তাহলে তোমার মন যা চায় তা কর। আর যদি তুমি ভারতের আশ্রিত রাষ্ট্রের নেতা হয়ে থাক তাহলে ভারত যা চায় তাই কর। বঙ্গবন্ধু তাঁর মনের মতো উত্তর এর ভিতরে পেয়ে গেলেন। তিনি লাহোর ইসলামিক সামিটের যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধু যেদিন লাহোরের ইসলামিক সামিটে যোগদান করতে যান সেদিন দিল্লীতে বঙ্গবন্ধুর কুশপুতলিকা দাহ করা হয়।
আজকের এই নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে আমরা কী পেয়েছি? এক. বাংলা সন ইসলামিক ঐতিহ্যের গর্ভজাত, তা প্রমাণিত হয়। দুই. বাংলাভাষাকে আমাদের দেয়া বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অনুষ্ঠিত করেছে আমাদের তরুণরা, যা আমাদের বাংলাভাষার রাজধানী কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের সুযোগ করে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ লাহোর ইসলামিক সামিটে আমন্ত্রিত হলে এককালের মিত্র রাষ্ট্র ভারত তার বিরোধিতা করে। এরপরও ঐ সামিটে যোগদানের ফলে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। এতে এও প্রমাণিত হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু শুধু একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নই দেখেননি, সেই দেশ যাতে মুসলিম বিশ্বের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকে তার নির্দেশানাও দিয়েছেন। এতে এটা স্পষ্ট হয় বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষপাতি ছিলেন, তা নয়, ভারতের আধিপত্যবাদী দূরাকাক্সক্ষা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।