Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘বড় ভাইদের’ দাপট

চট্টগ্রামে গ্যাং কালচারে বিপদগামী কিশোর-যুবকেরা

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

বন্দর নগরীর বাকলিয়ায় কিশোরদের প্রেমের বিরোধে খুন হন লোকমান হোসেন। এর জেরে পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান মো. সাইফুল। পুলিশের দাবি বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাইফুলের গুলিতে মারা যান লোকমান।
সাইফুল বাকলিয়ার খালপাড় এলাকার ‘বড় ভাই’। অন্যদিকে লোকমান মেহেদী বাগের গোলপাহাড় এলাকার ‘বড় ভাই’। তাদের দুজনের নেতৃত্বে দুটি কিশোর গ্যাং রয়েছে। এক কিশোরীর সাথে ত্রিভুজ প্রেমের জেরে বিরোধে জড়ায় এই দুই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তাদের বিরোধ মেটাতে গিয়ে খুন হন লোকমান।
খালপাড় আর গোলপাহাড়ের মতো নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে অন্তত একশটি এমন কিশোর গ্যাং রয়েছে। যাদের নেতৃত্বে আছেন কথিত বড় ভাইয়েরা। এসব বড় ভাইদের উৎপাত এখন সর্বত্রই। বিশেষ করে রাজনৈতিক ‘বড় ভাইদের দৌরাত্ম্য চরমে উঠেছে। তাদের প্রশ্রয়েই বিপদগামী হচ্ছে কিশোর ও উঠতি যুবকেরা। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারামারি, খুনোখুুনির মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোরেরা। টেন্ডারবাজি, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারেও বড় ভাইয়েরা লেলিয়ে দিচ্ছে এসব গ্যাঙয়ের সদস্যদের। তাদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশ বলছে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার আর অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণে নিতে পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠছে গ্যাং কালচার। পিতা-মাতার অজান্তে কিশোর যুবকেরা এসব দলে ভিড়ে বিপদগামী হচ্ছে। পুলিশের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নিয়েও এই কালচারের লাগাম টানা যাচ্ছে না।
এক সময় দু’দল কিশোরের মধ্যে খেলা নিয়ে দ্ব›দ্ব, প্রচÐ গতিতে মোটর সাইকেল চালানো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফ্রি ওয়াইফাই জোনে বসে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি ছাড়া তেমন কোনো উৎপাতের খবর ছিল না পুলিশের কাছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে একের পর এক খুন-খারাবি আর সন্ত্রাসী ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের নাম আসছে। আসছে তাদের বড় ভাইদের নামও।
কয়েকটি ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ধরা পড়লেও তাদের বড় ভাইয়েরা আড়ালে থেকে গেছে। এ বড় ভাইয়েরা কখনো ধরা পড়ে না। কোনো ঘটনার পর কিছুদিন বড় ভাইদের নিয়ে শোরগোল শোনা যায়, পরে অন্য কোনো খবরের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। এ সুযোগে বড় ভাইয়েরা নতুন করে আবারো গ্যাং কালচারে টেনে নতুন করে গ্রæপ গঠন করে দেন।
সম্প্রতি নগরীর চান্দগাঁওয়ে চাঁদার দাবিতে পিতার সামনে এক যুবকের পায়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে দেয় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে রাস্তায় নামে স্থানীয়রা। মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে স্থানীয়রা এ ঘটনায় জড়িতদের নাম প্রকাশ করে। তাদের অভিযোগ এলাকায় কিশোর ও যুবকদের নিয়ে কতিপয় বড় ভাই অপরাধী চক্র গড়ে তুলেছে। তারাই এলাকায় বেপরোয়া সন্ত্রাস চাঁদাবাজি করছে।
নগরীর সদরঘাট এলাকায় দলীয় কোন্দলের জেরে খুন হন নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। আলোচিত এই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই খুনের ঘটনায়ও একজন বড় ভাই আছেন। তার নির্দেশে সুদীপ্তকে ঘুম থেকে তুলে এনে রাস্তায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই খুনের ঘটনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীসহ বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হলেও এখনও আড়ালে সেই ‘বড় ভাই’।
তার আগে নগরীর জামালখানে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসফারের খুনের তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে কিশোর গ্যাংয়ের চাঞ্চল্যকর উত্থান কাহিনী। আদনান ইসফার হত্যায় জড়িত আরমান, সাব্বির, মুনতাসির, মহিম ও আবু সাঈদকে গ্রেফতারের পর গণি বেকারি, চকবাজার, মহসিন কলেজ, চন্দনপুরাকেন্দ্রিক তিনজন বড় ভাইয়ের সন্ধান পায় পুলিশ। এরা হলেন জিলহাজ, এনাম ও বোরহান। এদের পেছনে আছে চন্দনপুরার রউফ।
নগরীর ষোলশহরে চেকপোস্টে তল্লাশির সময় পুলিশকে গুলি করে একদল কিশোর। পরে গ্রেফতার হয় নয়জন। ওই ঘটনায়ও বড় ভাইয়ের সন্ধান পায় পুলিশ। অস্ত্রটি উদ্ধার করা হলেও বড় ভাইকে গ্রেফতার করা হয়নি। কিশোরী তাসফিয়া খুনের ঘটনায়ও কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক সদস্যের নাম উঠে আসে। পুলিশের হিসেবে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডেই অন্তত শতাধিক এমন গ্রæপের অস্তিত্ব আছে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। তবে তাতে কোন সুফল পাওয়া যায়নি। বড় ভাইয়েরা রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকায় পুলিশি অভিযান থেমে যায় ।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এলাকাভিত্তিক গ্যাংয়ের নেতৃত্বে থাকা বড় ভাইদের ছাড় দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে কয়েকটি ঘটনায় এমন বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর তালিকা আমাদের হাতে আছে। তালিকা ধরেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, যেসব বড় ভাইয়েরা শিশু-কিশোরদের বিপদগামী করছে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা সন্ত্রাসী। গ্যাং কালচার বন্ধ করতে পুলিশের পাশাপাশি অভিভাবক, জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহŸান জানান তিনি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম

৩০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ