Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে বোরো ধানে চিটা, কৃষক দিশেহারা

নেত্রকোনা জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:২১ পিএম | আপডেট : ১২:২৩ পিএম, ১০ এপ্রিল, ২০১৯

ধান উদ্ধৃত জেলা হিসেবে পরিচিত নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে ব্যাপক হারে বোরো ধানে চিটা দেখা দেয়ায় কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, নেত্রকোনা জেলার ৫টি হাওর উপজেলাসহ ১০টি উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত করা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার ৯শত ৫২ হেক্টর জমি। শেষ পর্যন্ত আবাদ করা হয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬ শত হেক্টর জমি। এরমধ্যে ২৩ হাজার ৮শত হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধান, ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৪ শত ৮০ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল এবং ৩ শত ২০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। চাল হিসাবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৭ লাখ ২৫ হাজার ৮শত ২১ টন।


হাওরাঞ্চলে বছরের ৭/৮ মাস পানি থাকায় তাদের একমাত্র ফসল হচ্ছে বোরো ফসল। এ সফল ঘরে তুলে তারা সারা বছর পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করে আসছে। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি বিয়ে সাদি দিয়ে থাকে। বোরো ধানের চারা তর তর করে বেড়ে উঠায় কৃষকের চোখে মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। সবুজ ধানের শীষে বাতাসের দোল খাওয়ার সাথে সাথে তাদের নানা ধরনের স্বপ্নও দোল খেতে শুরু করে। আগামীর স্বপ্নে কৃষকরা বিভোর হয়ে পড়ে। সবুজ ধান সোনালী বর্ণ ধারণ করার পর (ব্রি আর-২৮) ধানে চিটা দেখা দেয়ায় তাদের সেই স্বপ্ন অনেকটাই ফিকে হয়ে পড়তে শুরু করেছে। মাত্র কয়েকদিন আগেও যে কৃষক সোনার ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে আনন্দে উদ্বেলিত ছিল, আজ তাদের চোখে মুখে চরম হতাশার চাপ।


প্রতিবছর চৈত্রের শেষ দিকে হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু হয়। হাওরাঞ্চলের কৃষকরা প্রতি বছর প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়া এবং আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থাকেন। পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে প্রায় প্রতি বছর আগাম বন্যায় তলিয়ে যায় কৃষকের সোনালী ফসল। এ বছর হাওরাঞ্চলে পাহাড়ী ঢল ও আগাম বন্যা দেখা না দিলেও ধানে ব্যাপক চিটা দেখা দেয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপুতা হাওর, শনির হাওর, তেতুলিয়া, গাগলাজুর, সুয়াইর, বরান্তর, হাটনাইয়া, আদর্শনগর, খালিয়াজুরী উপজেলার চাকুয়া, জগন্নাথপুর, পাংগাসিয়া, কির্তনখোলা, কটিচাপরা, সেনের বিল, জালর বন, সোনাতোলা, বল্লীর চৌতরা, জগন্নাথপুরের বড় হাওর, বাজোয়াইল, পাঁচহাট, নগর, বোয়ালী, মদন উপজেলার মাঘান, গোবিন্দশ্রী, কদমশ্রী, গনেশের হাওরসহ বিভিন্ন হাওরে ধানে ব্যাপক চিটা দেখা দিয়েছে।
খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের কৃষক হারুন অর রশিদ বলেন, আমি ৩০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। এর মধ্যে ২৩ একর জমিতে ব্যাপক চিটা দেখা দিয়েছে। বল্লী গ্রামের কৃষক বাবুল মিয়া বলেন, তার ১৫ একর জমির ১৩ একর জমিতেই চিটা ধান হয়েছে। গছিখাই গ্রামের শফিকুলের ১৫ একরের মধ্যে ১০ একর চিটায় আক্রান্ত হয়েছে।


মোহনগঞ্জ উপজেলার ডিঙ্গাপোতা হাওরে বরান্তর গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া বলেন, আমি ১৫ একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। প্রতি কাটায় যেখানে ৬/৭ মন ধান পেতাম, এবার প্রতি কাটায় একমন ধান পাব কিনা সন্দেহ। হাটনাইয়া গ্রামের কৃষক মজিদ মিয়া বলেন, আমি মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে দার দেনা করে ১০ একর জমি করেছি। সব জমিতেই চিটা দেখা দেয়ায় কিভাবে দার দেনা সুদ করবো, ভেবে পাচ্ছি না। খুরশিমুল গ্রামের কৃষক জামাল মিয়া কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমার সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে। কিভাবে সংসারের সারা বছরের খাবার যোগাড় করবো।
মদন উপজেলার কদমশ্রী গ্রামের কৃষক জব্বার মিয়া বলেন, বিএডিসি থেকে ২৮ জাতের ধানের বীজ কিনে বিপদে পড়েছি। দৃশ্যমান ধানের শীষ দেখা গেলেও ভেতরে চাল নেই। মনিকা গ্রামের কৃষক সাদেক মিয়া বলেন, একদিকে ধানে চিটা দেখা দিয়েছে। অপরদিকে ধান কাটার শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।


মদন উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার গোলাম রসুল বলেন, এটা বীজের কোন সমস্যা নয়। এটা হলো শীতজনিত সমস্যা। শীতের কারণে ধানের ক্ষেতে ধানের শীষে কালা রং ধারণ করেছে।
নেত্রকোনা জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আনিসুর রহমান বলেন, হাওরে বোরো ধানে ব্যাপক চিটা হওয়াতে কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষকরা যতটুকু ধান উঠাতে পারছেন, তার যেন ন্যায্যমূল্য পায় সেদিকে সরকারকে সুদৃষ্টি দিতে হবে। এনজিওগুলো এবং মহাজনরা যাতে কৃষকের উপর সুদের জন্য অত্যাচার নির্যাতন চালাতে না পারে সেই দিকেও স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ খেলায় রাখাতে হবে।
এদিকে ধানে চিটা হবার কারণ নির্ণয়ের জন্য গাজীপুর কৃষি গবেষণা ইনিষ্টিটিউটের তিন বিজ্ঞানী প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহম্মদ আশিক, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হীরেন্দ্র নাথ বর্মন, উদ্ভিদ রোগতত্ব বিভাগের অফিসার ড. তুহিনা খাতুন নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী এবং মদন উপজেলার বিভিন্ন হাওর এলাকার আক্রান্ত বোরো জমি পরিদর্শন এবং কৃষকদের সাথে কথা বলেন। এ ব্যাপারে তারা কৃষকদের কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেন। কর্মকর্তারা অভিমত দেন যে, ২৯ জানুয়ারী থেকে ৩১ জানুয়ারী পর্যন্ত রাতে তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে এবং দিনে ২৫ থেকে ২৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকায় বীজ তলা তৈরী ও চারা রোপন কালে বোরো ধানের চারা কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়। ফলে ধানে ব্যাপক আকারে চিটা দেখা দিয়েছে।


এ ব্যাপারে নেত্রকোনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-রিচালক মোঃ হাবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি হাওরাঞ্চলে বোরো ধানে চিটা দেখা দেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন, এবং কলমাকান্দা উপজেলার হাওরাঞ্চলের প্রায় ৬ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান কোল্ড ইনজুরিতে আক্রান্ত হয়েছে। বিষয়টি সরকারের উর্ধ্বতণ কর্মকর্তাদেরকে জানানো হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নেত্রকোনা

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ