পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে রাসূলে পাক (স) বোরাকে আরোহণ করে ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ শুরু করলেন, সাথে হযরত জিব্রাইল (আ)। প্রতিটি আকাশের পাহারারত ফেরেস্তা হযরত জিব্রাইল (আ)-এর কাছ থেকে জেনে নিলেন তিনি কে এবং তিনি কি আমন্ত্রিত? তিনি কি আল্লাহর রাসূল? তিনি কি বাণীপ্রাপ্ত?
হয়রত জিব্রাইল (আ)-এর কাছ থেকে হ্যাঁ-সূচক জবাব পেয়ে খুলে দিলেন আকাশের দ্বার। এমনিভাবে একে একে তিনি প্রতিটি আসমান অতিক্রম করতে লাগলেন। প্রথম আসমানে দেখা হল হযরত আদম (আ)-এর সাথে। ২য় আসমানে হয়রত ইয়াহইয়া ও হযরত ঈসা (আ), ৩য় আসমানে হযরত ইউছুফ (আ), ৪র্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ), ৫ম আসমানে হযরত হারুন (আ), ৬ষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ), ৭ম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হয়রত জিব্রাইল (আ)। এখানে থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সিদরাতুল মুনতাহাতে। এখান থেকে রাসূলে পাক (স) রফরফে করে আরশে মুয়াল্লায় যাত্রা করলেন। এবারে কিন্তু জিব্রাইল (আ) সাথে নেই। কারণ এখান থেকে উপরে ওঠা তার জন্য নিষেধ। আরশে মুয়াল্লায় গিয়ে আল্লাহপাকের সাক্ষাৎ পেলেন, কথা হল দুই ধনুক বা তার চেয়েও কাছ থেকে।
কথা হয় অনেক। সংখ্যা সম্পর্কে রাসূলে পাক (স) আমাদের কিছুই বলে যাননি। কিছু ভন্ড দায়িত্ব জ্ঞানহীন নামধারী আলেম বলে বেড়ায় যে, মিরাজে আল্লাহপাকের সাথে কথা হয়েছে ৯০ হাজার, আল্লাহপাক নাকি রাসূলে পাক (স)-কে বলে দিয়েছিলেন যে, আপনি ৩০ হাজার কথা সর্বসাধারণ্যে প্রচার করবেন। ৩০ হাজার কথা বিশেষ শ্রেণী, যাদেরকে আপনি উপযুক্ত মনে করবেন তাদের কাছে প্রকাশ করবেন। এই ৩০ হাজার কথার নাম মারেফাত। আর বাকি ৩০ হাজার কথা কারও কাছে প্রকাশ করবেন না।
উপরোক্ত কথাগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। হাদিস-কুরআনেও এর কোনো প্রমাণ নেই। আল্লাহপাকের কাছ থেকে তাঁর উম্মতদের জন্য তুহ্ফাস্বরূপ নিয়ে এলেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, নামাজ কিন্তু পূর্বেও ছিল। তবে তখন ছিল দুই ওয়াক্ত, ফজর এবং মাগরিব। তাও ছিল দুই রাকাত। মিরাজ থেকে যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে এলেন তা হল ফজর ২ রাকাত, জোহর ৪ রাকাত, আসর ৪ রাকাত, মাগরিব ৩ রাকাত এবং এশা ৪ রাকাত। সাথে নামাজের সময়ও নির্ধারণ করে দেয়া হল।
রাসূলে পাক (আ) বলে দিয়েছেন যে, এই নামাজই হল মুমিনদের জন্য মিরাজ। মক্কা মুয়াজ্জমায় এসে তিনি এই মিরাজের কথা জনসম্মুখে প্রচার করতে শুরু করলেন। আরবের লোকেরা এই কথা শুনে হাসি-ঠাট্টা করতে শুরু করল। রাসূলে পাক (সা)-এর এই দাবীর মধ্যে যে কোন সত্যতা নেই তা প্রামাণ করতে কাফেররা উঠে পড়ে লেগে গেল। মুহূর্তের মধ্যে এই কথাগুলো সারা আরবের লোকদের কানে পৌছে গেল।
কোরেশী কাফেররা আজ মহাখুশি। কারণ তারা রাসূলে পাক (স)-কে যুক্তি দিয়ে আজ পর্যন্ত জব্দ করতে পারেনি। এবারে তারা আচ্ছা করে জব্দ করবে। সিন্ধান্ত নিল যে, তারা রাসূলে পাক (স)-কে বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে প্রশ্ন করবে। কারণ তাদের জানা ছিল যে, রাসূলে পাক (স) কখনও বায়তুল মুকাদ্দাস সফর করেননি। এখন তিনি দাবী করছেন যে, তিনি গত রাতে বায়তুল মুকাদ্দাস সফর করে সেখানে ২ রাকাত নামাজও আদায় করে এসেছেন। কাফেররা এমন কতগুলো প্রশ্ন ঠিক করে নিল, যেগুলো দু’একরাব বায়তুল মুকাদ্দাস সফরকারীও সঠিকভাবে বলতে পারবে ন।
প্রশ্নগুলো ঠিক করে তারা এসে হাজির হয় রাসূলে পাক (স)-এর খেদমতে। প্রশ্নকারীদের দলপতি ছিল মোতেম ইবনে আদী। প্রশ্ন করা শুরু করল। রাসূল (স) বলেন, তাদের প্রশ্নগুলো এতই জটিল ছিল যে, এর উত্তর দেয়া সম্ভব ছিল না। আল্লাহপাক আমার এই অসহায়ত্ব দেখে মসজিতটিকে আমার সামনে এনে হাজির করে দিলেন। আমি মসজিদটি দেখছিলাম আর তাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। প্রশ্নগুলো এ ধরনের ছিল, যেমন-মসজিদটি দেখতে কেমন? এর মধ্যে কয়টি দরজা, কয়টি জানালা, কয়টি সিঁড়ি এবং কোনদিকে কয়টি মেহরাব ইত্যাদি।
আপনারা তো গাউসুল আযম সমজিদে সব সময়ই নামাজ পড়েন। আপনাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বলুন তো এই মসজিদে কয়টি জানালা, কয়টি ফ্যান, কয়টি বাতি, কয়টি পিলার, উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারবেন কি? পারবেন না। কারণ আপনারা আসেন নামাজ পড়তে, পিলার গণনা করতে আবশ্যই নয়। রাসূলে পাক শত শত মাইল পথ বিদ্যুতের চেয়েও বেশী গতিসম্পন্ন বোরাকে চড়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে এসে সমস্ত নবী-রাসূলের সাক্ষাৎ পেয়ে মহানন্দে বিভোর। তারপর আবার তাঁকে আল্লাহপাক সমস্ত নবী-রাসূলের ইমাম হিসেবে মনোনয়ন করে আরো আশ্চর্যান্বিত করেছেন। সেখানে তাঁর পক্ষে কি মসজিদের পিলার, দরজা, জানালা, গণনা করার কোনো সুযোগ ছিল? কাফেরদের ধারণা ছিল, তিনি তাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিশ্চয়ই দিতে ব্যর্থ হবেন। তিনি হয়ে যাবেন মিথ্যাবাদী।
আল্লাহপাক কি চান তাঁর হাবীব কাফেরদের সামনে লজ্জিত হোন, মিথ্যাবাদী হোন? কখনও না। আল্লাহপাক হযরত জিব্রাইল (আ)-কে নির্দেশ দিয়ে দিলেন, যাও জিব্রাইল আমার হাবীবের সামনে বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদটিকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দাও। আমার হাবীব যেন সঠিকভাবে তাদের উত্তর দিতে পারেন। তাঁর জন্য যখন যা দরকার তাই করে দেব।
রাসূলে পাক (স) তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর তো দিলেনই, উপরন্তু বলতে লাগলেন আমি অমুক কাফেলাকে অমুক স্থানে দেখে এসেছি। কাফেলার উট হারিয়ে গেছে। আমি তাদের উটের সংবাদ দিয়ে এসেছি। আর একটি কাফেলা বয়জা থেকে সানিয়াতুত তানয়িম পর্যন্ত চলে এসেছে। তাদের কাফেলার প্রথম উটটি ধুসুর রঙের। তার উপর দুইটি বোঝা একটি সাদা রঙের, অন্যটি জরিদার কাপড় দ্বারা মোড়ানো। একথা শুনে তারা প্রমাণের জন্য সানিয়াতুত তানয়িমের দিকে লোক পাঠিয়ে দিল। সেখানে গিয়ে তারা রাসূলে পাক (স)-এর বর্ণনা মত সবই সঠিকভাবে পেয়ে গেল। দ্বিতীয় কাফেলা সম্পর্কে রাসূলে পাক (স) যা যা বলেছিলেন, সেটিও নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল। কাফেররা লা জওয়াব হয়ে ফিরে গেল।
একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, রাসূলে পাক (স) নিজ শক্তিতে মহাশূণ্যে ভ্রমণ করেননি। আল্লাহপাক নিজে এর ব্যবস্থা করেছেন। আর আল্লাহপাকের জন্য অসম্ভব বলে কিছু নেই। রাসূলে পাক (স) আল্লাহপাকের কাছে মহান মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহপাকের পরই যার স্থান। আল্লাহপাক সম্পর্কে যদি আমাদের সঠিক ধারণা থাকে, তাঁর শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে যদি আমাদের নির্ভুল ঈমান থাকে, তাহলে মিরাজ কোনো অসম্ভব ঘটনাই নয়। অসম্ভব, অবাস্তব বলে কোন বিষয় আল্লাহপাকের অভিধানে নেই। তাই আসুন, সকল প্রকার দ্বিধাদ্ব›দ্ব ভুলে গিয়ে আল্লাহপাকের শক্তি-কুদরতের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে আমাদের ঈমানকে সুদৃঢ় করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুন। আমীন।
(সংকলিত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।