Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রমজানের আগেই পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি

নজরুল ইসলাম লিখন | প্রকাশের সময় : ৪ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৬ এএম

একটা সময় ছিল যখন অসাধু ব্যবসায়ীরা রমজান মাস, ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবের সময় বাড়তি চাহিদা ও সরবরাহের অপ্রতুলতার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াত; কিন্তু রমজান, ঈদ ও উৎসবকেন্দ্রিক বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের বাড়তি পদক্ষেপের কারণে এখন দুই-তিন মাস আগ থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে নেয়া হয়। তারপর রোজায় সরকারের তৎপরতা শুরু হলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে মাঝ রোজায় দাম স্বাভাবিক করার কথা বলে বাড়ানো দামের কিছুটা কমানো হয়। এভাবে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সাধারণ মানুষের পকেট কেটে হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের অর্থ। বিষয়টি যে ওপেন সিক্রেট, তা প্রমাণিত হয় হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায়। রমজানে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তাই এখনই অসাধু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই।
দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে হবে। দেশের ভোক্তাসাধারণের মধ্যে রমজানের যে ছবিটি স্থায়ী হয়ে আছে, তা খুব একটা সুখকর নয়। চিত্রটি এ রকম যে, প্রতিবছর রোজার আগে থেকেই দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। কখনো কখনো পণ্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। আর এর সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র প্রতিবছর বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় অনেকটা প্রতিযোগিতামূলকভাবে। প্রত্যেক মুসলমানের জন্যেই রমজান একটি মহান পূণ্যের মাস। কারণ এই রমজানের মাসেই পবিত্র কোরআন শরীফ নাজিল হয়েছিল। তাই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিকট রমজানের গুরুত্ব অনেক। আগামী ৬ মে দিবাগত রাতে থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার কথা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের দাম কমিয়ে কম মুনাফা কামিয়ে বেশি সোয়াব অর্জন করে। কিন্তু বাংলাদেশেই এর উল্টোটা ঘটে। একমাত্র আমাদের বাংলাদেশেই বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে, ধর্মীয উৎসবে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে দেশের ব্যবসায়ীরা।
অনেক সময় এমনও দেখা গেছে, বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জিনিপত্রের দাম বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, রোজার মাস সামনে রেখে এখন থেকেই রমজানের ভোগ্যপণ্য বাজারে আসতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে সাতটি জাহাজে ছোলা, মটরডাল, ভুট্টা, চিনি ও ভোজ্য তেলসহ পাঁচ লাখ টন রমজানের ভোগ্যপণ্য রয়েছে। পবিত্র রমজান মাস আসতে এখনো প্রায় মাসেক সময় বাকি। এত আগেই রমজানের ভোগ্যপণ্য নিয়ে আসার কারণও জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। ধারণা করা হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা ধাপে ধাপে পণ্য আনতে শুরু করেছেন। অবশ্য আগেভাগে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের যুক্তি হচ্ছে, বন্দরে জাহাজজটের ঝুঁকি এড়ানো এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আগেই তাঁরা পণ্য আনতে শুরু করেছেন। এতে রোজার সময় বাজারে কোনো অস্থিরতা থাকবে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দরে জাহাজজট, লাইটার জাহাজ সংকট কাটিয়ে কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাটে অরাজকতা বন্ধ করা, ডলারের লাগাম টানা এবং ব্যাংকঋণের সুদহার ঠিক রাখার এই চারটি বিষয়ে নজরদারি করা গেলে রোজায় বাজার অস্থির হবে না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগছে খেটে খাওয়া মানুষরা। দিনমজুর অর্থাৎ যারা প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন কিনে খায়, তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছে। খেটে খাওয়া মানুষেরা কিভাবে এই বর্ধিত মূল্যের সাথে খাপ খেয়ে চলবে? জিনিসের দামের সাথে মিল রেখে তাদের শ্রমের মূল্য তো আর বাড়েনি। কিন্তু, এমন পরিস্থিতি লাঘবে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আর সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। বাজারেও কোন জিনিসের কমতি নেই। পাইকারের গুদাম ও কৃষকের ঘরেও মজুদ আছে প্রচুর। বর্তমানে রাজনৈতিক অবস্থা একেবারেই শান্ত যাকে স্থিতিশীল বলা হয়। তারপরও প্রতিদিনই হু হু করে বাড়ছে মাছ, মাংস, আদা, রসুন, ডাল, ছোলা ও চিনিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম। রোজার মাসে আমাদের দেশে কিছু পণ্য যেমন চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেল ইত্যাদি একটু বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। চাহিদা বেশি থাকায় দোকানিরা দাম বাড়ানোর এবটা অছিলা পেয়ে যায়। বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমাণ থাকলেও দাম বাড়ানোর প্রবণতা কমে না। চাহিদা বেশি এবং সরবারাহ কম থাকলে দাম বাড়ার একটা যুক্তি হয়তো দাঁড় করানো যায়। কিন্তু আমাদের দেশে যে কোনো অছিলায় দাম বাড়ানো একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। কমার কোনো লক্ষণ কখনোই দেখা যায় না। এ রেওয়াজ চলতে দেয়া যায় না।
বাজার সূত্রে জানা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যের দাম দু’সপ্তাহের ব্যবধানে কয়েক শতাংশ বেড়েছে। যেমন- ব্রয়লার মুরগির দাম ১২০-১৩০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৫-১৭৫ টাকায়, লেয়ারের ২১০-২৩০ এবং পাকিস্তানি ককের ২৬০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯০-৩০০ টাকায়। গরুর মাংসের দাম ৪৮০ থেকে বেড়ে ৫৫০ ও খাসির মাংসের কেজি ৭০০-৭৫০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮০-৮০০ টাকায়। এছাড়া নানা ধরনের সবজির কেজি ১০০ টাকা যেমন ছুঁয়েছে, তেমনি মাছ, তেল-মসলা সবকিছুরই দাম বাড়ানো হয়েছে অযৌক্তিক হারে। যেহেতু নতুন কৌশলে সরকারকে ফাঁদে ফেলে অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষের পকেট কেটে যাচ্ছে, সেহেতু সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এখনই সতর্ক হতে হবে। অন্যথায় বেপরোয়া ব্যবসায়ীরা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই।
পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্যে ক্ষনস্থায়ী উদ্যোগ নিয়ে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না, দেশে পণ্যের চাহিদা এবং আর্ন্তজাতিক বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য সরকারের কাছে থাকতে হবে। আগাম ব্যবস্থা নিয়ে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পর তৎপরতা চালালে হবে না। তাই বছরজুড়েই পণ্যমূল্যের ওপর নজরদারি রাখতে হবে। আর্ন্তজাতিক বাজারের আগাম তথ্য থাকতে হবে। সেই অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের দক্ষ মার্কেট ইন্টেলিজেন্স থাকতে হবে। সিস্টেমেটিক উপায়ে বাজারের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
ব্যবসায়িরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছামাফিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করে থাকে। মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। এ ব্যাপারে খুচরা বিক্রেতারা সবসময় পাইকারি বিক্রেতাদের ওপর দোষ চাপিয়ে থাকেন। আর পাইকারি বিক্রেতারা চোষ চাপান আমদানিকারক বা উৎপাদকের ওপর। আমরা মনে করি, যৌক্তিক মূল্যে পণ্য বিক্রির বিষয়ে সরকারের যথেষ্ঠ করণীয় রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্যের সাথে চলতে গিয়ে রীতিমত হাঁপিয়ে ওঠছে। তারা এর প্রতিকার চেয়ে বিভিন্নভাবে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সরকার জনগণের দাবি পূরণে বারবার কেবলই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আশার কথা, বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও সিন্ডিকেটের দাম বাড়ানোর বিষয়টি বক্তব্যে তুলে ধরেছেন এবং রমজানে দাম বাড়াতে দেয়া হবে না বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু এখনই বাজার মনিটরিং করে ব্যবস্থা না নিলে এটা যে কেবল কথার কথা হয়ে থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে ভোক্তাদেরও কৌশলী হতে হবে এবং রমজানের শুরুতেই আগাম অনেক দিনের বাজার করে জমা রাখার প্রথা ছাড়তে হবে। এতে করে বাড়তি চাহিদা দেখিয়ে ও জোগানের স্বল্পতার কথা বলে বাড়তি দাম নেয়ার পথ রুদ্ধ হতে পারে। সর্বোপরি, রমজান সংযমের মাসের অর্থ হলো খাওয়া-দাওয়া ও অপচয় কম করা এবং বেশি বেশি ইবাদত করা।
লেখক: কলামিস্ট ও সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রমজান


আরও
আরও পড়ুন