দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মি’রাজ শব্দটি ‘উরজুন’ ধাতু থেকে উৎসারিত। এর অর্থ- সিঁড়ি, ঊর্ধ্বারোহণ বা উর্ধ্বারোহণের বাহন। মে’রাজের একটি অংশ হলো ‘ইসরা’। কুরআনে শব্দটিকে ‘আসরা’ বলা হয়েছে। ‘ইসরা’ ধাতু থেকে ‘আসরা’ শব্দটি উদগত হয়েছে। এর অর্থ- রাতে নিয়ে যাওয়া বা রাত্রিকালীন ভ্রমণ। যেহেতু রাসূল (সা.)-এর মি’রাজ রাত্রিকালে হয়েছিল, তাই এটিকে ইসরা বলা হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা রাসূল (সা.)-কে এক রাত্রিতে বা রাত্রীর কিছু অংশে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, এরপর সেখান থেকে সপ্তাকাশ, সিদরাতুল মুনতাহা, জান্নাত ও জাহান্নাম এবং উর্ধ্বজগতের অন্যান্য বড় বড় নিদর্শন দর্শনের উদ্দেশ্যে জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে রাত্রীবেলা ভ্রমণ করান। মাসজিদে হারাম থেকে মাসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে ‘ইসরা’ এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বে গমনকে মি’রাজ বলা হয়।
মহান আল্লাহ তা’লা তাঁর প্রিয় হাবীবকে যত মু’জিযা দান করেছেন সেগুলির মধ্যে অন্যতম বিস্ময়কর মু’জেযা হলো ইসরা ও মি’রাজ। এজন্যই মে’রাজের আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ পাক ‘সুবহানা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা কেবল অত্যাশ্চর্য্য ঘটনার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মে’রাজ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শ্রেষ্ঠ মু’জিযা।
মহান আল্লাহ তালা কুরআনের সুরায়ে বনী ইসরাঈল এবং সুরায়ে নাজম-এ মি’রাজের বর্ণনা দিয়েছেন। ইরশাদ ফরমান- “পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন আল-মাসজিদুল হারাম হতে আল-মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা-বনী ইসরাঈল-১)
সূরায়ে নাজ্ম এর প্রথম দিকের আয়াতগুলোতে রাসূল (সা.) আল্লাহর নিদর্শন দর্শনের বিবরণ দিতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’লা বলেন- “সিদরাতুল মুনতাহার কাছে, যার কাছে রয়েছে মু’মিনদের বসবাসের ঠিকানা জান্নাত; সে সেদরাটি তখন যেরকম জ্যোতি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার সেরকম আচ্ছন্ন ছিলো, এখানে তাঁর (রাসূল সা.) কোন রকম দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি এবং তার দৃষ্টিও সীমালঙ্ঘন করেনি। অবশ্যই সে তার মালিকের বড় বড় নিদর্শনসমুহ দর্শন করেছে।” (সুরা নাজম- ১৪ থেকে ১৮)
একাধিক বিশুদ্ধ হাদীসে মি’রাজের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। হজরত ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে হঠাৎ আমার কাছে জিবরাইল (আ.) একটি সাদা রঙের ‘বোরাক’ নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমি এতে আরোহণ করলাম, অতঃপর মসজিদে প্রবেশ করলাম এবং সেখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করলাম। এরপর আমি মসজিদ থেকে বের হলাম। তখন জিবরাইল (আ.) একটি শরাব ও একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। তখন আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি ফিতরাতকেই গ্রহণ করেছেন।’ (মুসলিম)
নবী করীম (সা.) এর মাক্কি জীবনের শেষলঘেœ নবুওতের একাদশ বছরে রজব মাসের ২৭ তারিখ রাত্রীতে মে’রাজের মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতাগণ ‘বোরাক’ তথা আল্লাহর কুদরতি দ্রæতগতিসম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাহনের মাধ্যমে নিয়ে যান মাসজিদে হারাম (বায়তুল্লাহ) থেকে মাসজিদে আকসা (বায়তুল মুকাদ্দাস) পর্যন্ত। তারপর উর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণে মহানবী (সা.) বিশ্বস্রষ্টার নভোমন্ডলের অপরূপ দৃশ্যাবলি দেখে তিনি বিমোহিত হন। সপ্তাকাশে ফেরেশতারা তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং নবীগণের সাথে সাক্ষাত করেন। জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করেন। তিনি আল্লাহর বিধি-বিধান, ভাগ্যলিপি অবিরাম লিখে চলতেছে যে কলম সেটাকেও লিখনরত দেখতে পান। ফেরেশতাদের গমণাগমণের শেষ সীমানা সিদরাতুল মুনতাহা দেখেন। সিদরা হচ্ছে- বদরিকা বৃক্ষ, এই বৃক্ষের মূল শিকড় ষষ্ঠ আকাশে এবং শাখা-প্রশাখা সপ্তম আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। সেখানে আল্লাহ তা’লার নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রঙ-বেরঙের প্রজাপতি ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করছিল। ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিলেন। সেখানে রাসূল (সা.) জিবরাইল (আ.) কে স্বরূপে দেখতে পান। তাঁর ছয়শত পাখা ছিল। সেখান থেকেই একটি দিগন্তবেষ্টিত সবুজ রঙের কুদরতি বাহন ‘রফরফে’ (সবুজ রঙের গদিবিশিষ্ট পাল্কীকে রফরফ বলা হয়) আরোহণ করে কল্পনাতীত দ্রæতবেগে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে মোয়াল্লার সন্নিকটে এবং আল্লাহর দরবারে হাজির হন। সেখানে আল্লাহ তা’লার সঙ্গে সাক্ষাত ও কথোপকথন হয়।
আল্লাহ নিজে তাঁকে সালাম বলে অভিবাধন জানান এবং তুহফা (আত্তাহিয়্যাতু) প্রদান করে সম্মানিত করেন। আল্লাহ তা’লা রাসূল (সা.)-কে খলীল ও হাবীবরূপে গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর নৈকট্য, সান্নিধ্য ও দিদার লাভ করার পর জ্ঞান গরিমায় মহিয়ান হয়ে তার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন। করুণা ও শুভেচ্চার নিদর্শনস্বরুপ মে’রাজ রজনীর উপহার হিসেবে আল্লাহর বান্দাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ওই রাতেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার নির্দেশ হয়। পরে তা হ্রাস করে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেওয়া হয়। এবং এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের সওয়াবের সমপরিমাণ করে দেওয়া হয়। এর দ্বারা সকল ইবাদতের মধ্যে নামাজের বিশেষ গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। (তাফসীরে মা’রিফুল কুরআন)
মে’রাজের অন্যতম উপহার হলো পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাজ। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে তাকে তাঁর উম্মাতের জন্য নামাজের মহান নিয়ামত প্রদান করেছেন। নামাজের মাধ্যমেই উম্মাত দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বোচ্চ নিয়ামত লাভ করতে পারবে। নামাজকে গ্রহণ করলে মে’রাজের উপহার গ্রহণ করা হয়। মে’রাজ আল্লাহর সাথে মানুষের স¤পর্ক গভীর করে তোলে। মু’মিনের মে’রাজ হচ্ছে নামাজ।
রজব মাসেই মে’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। রজব বরকতময় একটি মাস। রজব ও শাবান মাসদ্বয়কে রাসূল (সা) রমজানের প্রস্তুতির মাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রাসূল (সা.) রজব ও শা’বান মাসে, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ও শা’বানা ওবাল্লিগনা রামাজান’- এই দোয়াটি বেশি বেশি পাঠ করতেন।
ইসলামের ইতিহাসে যেসব যুগান্তকারী ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তন্মধ্যে রাসূল (সা.)-এর মে’রাজের স্থান সর্বশীর্ষে। মহানবী (সা.) যখন জাগতিক ও পারিপার্শিক অসহায় অবস্থার সম্মুখীন হন, পিতৃব্য আবু তালিব ও বিবি খাদিজা (রা.) এর আকস্মিক ইন্তেকাল হয়, অন্যদিকে কাফেরদের অত্যাচার তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলে; তখন মে’রাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা’লা স্বীয় হাবীবকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে সান্তনা দেন। সম্মান প্রদর্শন করেন। এমন তিনটি মর্যাদায় ভুষিত করেন যা পূর্বে কেউ পাননি, আর কেউ পাবেনও না। আল্লাহপাক রাসূল (সা.)-কে যে তিনটি মর্যাদায় ভুষিত করেন তা হচ্ছে- ১. ‘সাইয়্যিদুল মুরসালীন’- সকল রাসূলগণের সরদার। ২.‘ইমামুল মুত্তাকীন’- সকল মুত্তাকীদের প্রতিনিধি। ৩.‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’- সর্ববিশ্বের করুণা। আল্লাহ তা’লা রাসূল (সা.)-কে এভাবেই সম্মান প্রদর্শন করেন, শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন এবং আদর্শ সমাজ সংস্কারের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। মুসলিম উম্মাহের জন্য রাসূল (সা.)-এর মে’রাজ অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূণ। ইসলামী সংস্কৃতিতে প্রতিবছর মে’রাজ রজনী খুবই ভাবগাম্ভীর্যের সহিত পালিত হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।