পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত মঙ্গলবার সাদাপোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতারকে ভয়াবহ বলে আখ্যায়িত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। কাউকে গ্রেফতার করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় থাকতে হবে বলেও মন্তব্য করেন আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্টের এমন মন্তব্যের পরও থেমে নেই সাদাপোশাকে গ্রেফতার এবং গ্রেফতারের পর পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্তর মৃত্যুর ঘটনা। একের পর এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে চলেছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে এ ধরনের দু’টি ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। একটি ঘটেছে নরসিংদীতে। আরেকটি রাজশাহীতে। নরসিংদীর ঘটনা থেকে জানা যায়, ডিবি পরিচয় দিয়ে সাদাপোশাকে বাড়ি থেকে দ্বীন ইসলাম নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সে লাশে পরিণত হয়। দ্বীন ইসলামের মা জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার ভোর ৫টায় সাদা পোশাকধারী একদল সশস্ত্র লোক তার বাড়ি গিয়ে ডিবি পরিচয় দিয়ে দ্বীন ইসলামকে হাতকড়া পরায়। কেন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে ডিবি পুলিশ জানায়, পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আসলে সব জানা যাবে। বাড়াবাড়ি করলে গুলি করব। এতে তিনি চুপ হয়ে যান। পরদিন সকাল ১০টায় দ্বীন ইসলামের মা ডিবি অফিসে গেলে সেখান থেকে জানানো হয় সে এখানে নেই। পরবর্তীতে তিনি হাসপাতালে তার ছেলের লাশ পান। নরসিংদীর পুলিশ সুপার আমেনা বেগম দাবি করেছেন, দ্বীন ইসলাম বড় ধরনের অপরাধী। গ্রেফতারের পর ডিবি’র হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে লোকজন তাকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত হাফিজুর রহমান রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে। হাফিজুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ও মহানগরীর ১৯ নং ওয়ার্ড ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র শিবির দাবী করেছে, হাফিজুরকে পরিকল্পিতভাবে কারাগারে পাঠিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তাকে চারদিন ডিবি কার্যালয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, উল্লেখিত দুই যুবকের মৃত্যু পুলিশ হেফাজত ও বিচারাধীন অবস্থায় হয়েছে। সাদাপোশাকে গ্রেফতার এবং পুলিশ হেফাজত ও বিচারাধীন অবস্থায় অভিযুক্ত’র মৃত্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা এবং আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও প্রতিকার না হওয়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার।
দেশে বিচারের আগেই অভিযুক্ত আসামীর মৃত্যু এবং সন্দেহভাজনকে সরাসরি ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করার অপসংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এটা যে এক ধরনের বিচারহীনতা এবং অভিযুক্তকে আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সচেতন এবং বোধসম্পন্ন মানুষমাত্রই মনে করে, অভিযুক্তকে আইনের নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে দোষী ও নির্দোষী প্রমাণ করার সুযোগ দেয়া তার মৌলিক অধিকার। আইনেও আসামীর ন্যায্য আইনী সহায়তা পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি, বিচারের আগেই অভিযুক্ত’র মৃত্যুবরণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার ইত্যাদির নামে আসামীর মৃত্যু হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবী অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি ও তার কথিত বাহিনী এতটাই শক্তিশালী যে তাদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ দাবী যে অনেকটা কল্পকাহিনীতে পরিণত হয়েছে এবং ধোপে টিকছে না, তা দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বক্তব্য-বিবৃতি, যুক্তি ও ব্যাখ্যা থেকেই বোঝা যায়। দেশের মানুষ দেখছে সারা দেশে একের পর এক অপহরণ, গুম ও খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এসব বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রে সচেতন মহল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই আঙ্গুল তুলছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ সরকারের আমলে প্রায় ৪০৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটেছে। এসবের বেশিরভাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধ’র মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। এ নিয়ে দেশ ও বিদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করতে দেখা গেছে। এমনকি গুম ও অপহরণের শিকার হওয়া অনেক ব্যক্তির পরিবারও সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ তুলেছে। পত্র-পত্রিকাগুলো অহরহ মাস ও বছরওয়ারি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে এবং ধরছে। এসব অপহরণ, গুম, খুন ও বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনার মধ্যেই পুলিশের হেফাজতে সন্দেহভাজনদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। নরসিংদীর দ্বীন ইসলামকে কোন অভিযোগে ডিবি পুলিশের হেফাজতে জীবন দিতে হলো, তার কারণ জানা যায়নি। জটিল থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত রাজশাহীর হাফিজুর রহমানের মৃত্যু নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। যে আসামীই হোক সে যখন পুলিশ হেফাজতে থাকে, তখন তার আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনি তার সুস্থ ও অসুস্থতার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বও পুলিশের রয়েছে। এমনকি রিমান্ডে নিয়ে অভিযুক্তকে নির্যাতন করা যাবে না, এমন আইনী বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এসব নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করছে না। উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিলেও তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ও সর্বেসর্বা মনে করছে। তার কতিপয় সদস্য গ্রেফতারকৃতদের ন্যূনতম আইনি সহায়তা দিতেও যেন রাজী নয়। আইন-আদালতের ধার না ধেরে নিজেরাই সরাসরি বিচার করে ফেলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হচ্ছে, অপরাধী ও অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে আইনী প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি করা। সে দোষী না নির্দোষ সাক্ষী-সাবুদের মাধ্যমে আদালতই তা নির্ধারণ করবে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই যদি বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তবে তা বিচার ব্যবস্থার প্রতি চরম অবজ্ঞা ও উপেক্ষার শামিল। কোনো সভ্য দেশে আইনের ধারক-বাহক কর্তৃক এ ধরনের আইন অমান্য’র নজির বিরল।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ধারাবাহিকভাবে অপহরণ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের যে অভিযোগ দেশে-বিদেশে উঠছে, তাতে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। সর্বত্র উদ্বেগ প্রকাশিত হলেও, তা দূর করার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নেয়া হচ্ছে বলে দৃশ্যমান নয়। আইনের লোক কর্তৃক একের পর এক আইন বহির্ভূত কর্মকা- সংঘটিত এবং হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ বাহিনীর চেইন অফ কমান্ড অত্যন্ত শিথিল হয়ে পড়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক পুলিশ নিয়ে সাম্প্রতিক মন্তব্য থেকেই তা বোঝা যায়। আমাদের কথা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বই হচ্ছে সাধারণ মানুষের বন্ধু হয়ে তাদের জানমালের হেফাজত করা। আবার অপরাধীর প্রতি কঠোর হয়ে আইনের আওতায় আনা। এখন এই কাজের পরিবর্তে যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখে মানুষকে দূরে থাকতে বা এড়িয়ে চলতে হয়, তবে এ বাহিনীর ভাবমর্যাদা বলে কি কিছু থাকে? সাধারণ মানুষের কি আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে? এ পরিস্থিতি আর কতকাল চলবে এবং কবে বন্ধ হবে, তা আমরা জানি না। তবে আমরা আশা করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কতিপয় সদস্য কর্তৃক বেআইনি, অমানবিক ও হয়রানিমূলক কর্মকা- বন্ধ ও এরূপ কাজ থেকে বিরত রাখতে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সাধারণ মানুষের প্রতি মানবিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ বৃদ্ধি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।