পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সে একজন চোর। এ বাড়ি ও বাড়িতে চুরি করাই তার পেশা। তবে তার চুরির কায়দাটা একটু ব্যতিক্রম। সে চুরি করে দিনের বেলায়, তাও দুই শিফটে। সকাল দশটা থেকে বারোটা এবং বিকাল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা। কায়দাটাও অভিনব। মাথায় টুকরি নিয়ে পাড়া মহল্লার রাস্তায় পুরান কাপড় আছে, পুরা কাপড়- বলে ডাকতে থাকে। কোনো বাসায় তালা লাগানো দেখলেই পুরান কাপড় বেচবেন- বলে হাক দেয়। সাড়াশব্দ না পেলে সাথে থাকা একটি লোহার চিকন দন্ড দিয়ে তালা খুলে ফেলে। এতে তার সাকুল্যে ব্যয় হয় পাঁচ সেকেন্ড সময়। তারপর খালি বাসা থেকে নানা রকম মূল্যবান জিনিস নিয়ে সটকে পড়ে। সম্প্রতি এ চোরকে গ্রেফতার করেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালী থানা পুলিশ। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, গত ১৩ মার্চ পুলিশ তাকে স্টেশন রোড এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশকে সে জানিয়েছে, গত পাঁচ বছর ধরে সে এ কাজ করে আসছে। তার নাম জাহাঙ্গীর আলম। সে চোরাই জিনিসপত্র বিক্রি করত জানে আলম নামে একজনের কাছ। পুলিশ অভিযান চালিয়ে জানে আলমের বাসা থেকে ১৪৫টি মোবাইল ফোনসেট, ১০৬ জোড়া জুতা-সেন্ডেলসহ বিভিন্ন বাসা থেকে চুরি করে আনা ব্যবহার্য জিনিসপত্র উদ্ধার করেছে। জানে আলম পালিয়ে গেলেও পুলিশ তার স্ত্রী রেহেনা বেগমকে গ্রেফতার করেছে।
ঘটনাটি যেন আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত প্রবাদ- ‘চোরের দশদিন, গেরস্তের একদিন’-এর বাস্তব রূপ। জাহাঙ্গীর পাঁচ বছর ধরে নির্বিঘেœ চুরি করে আসছিল। এতদিন সে ধরা পড়েনি। এবার সে বমাল গ্রেফতার হয়েছে। জাহাঙ্গীর একজন ছোট চোর, ছিঁচকে চোরও বলা যায়। গ্রাম-গঞ্জে এ ধরনের চোরকে বলা হয় সিঁদেল চোর। এদের চৌর্যবৃত্তি গেরস্তের সর্বনাশ করে সন্দেহ নেই। তবে এটাও ঠিক যে, এরা পেটের দায়েই এই ঘৃণ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। কারণ ধরা পড়লে হাটুরে কিল আর পুলিশের প্যাদানি শরীরের ওপর দিয়েই যায়। তার ওপর আছে গারদ খাটা। ছেলেবেলায় একটি গল্প পড়েছিলাম দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসীনকে নিয়ে। একরাতে তিনি টের পেলেন তার ঘরে চোর ঢুকেছে। তিনি আলো জ্বেলে দেখতে পেলেন এক লিকলিকে শরীরের লোক তার ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। তিনি লোকটিকে কাছে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, চুরি করা যে পাপকাজ তুমি জানো? লোকটি বলল- জ্বী জনাব, জানি। তাহলে চুরি করছ কেন? কাজ করে খেতে পার না? একটু ধমকের সুরেই বললেন হাজী মোহাম্মদ মহসীন। লোকটি তখন কেঁদে ফেলে বলল- আজ তিন দিন ঘরে দানাপানি নাই। ছোট ছোট বাচ্চাগুলি ক্ষুধায় ছটফট করছে। কোনো কাজও পাইনি। তাই আপনার ঘরে চুরি করতে ঢুকেছিলাম। আমাকে মাফ করে দিন। দানবীর তখন চোরটাকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন- আর চুরি করবে না। এই টাকা দিয়ে ব্যবসা করে খাবে। চোর হাজী মহসীনের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে চলে গেল।
এখানে গল্পটির অবতারণা বললাম এজন্য যে, আমাদের সমাজে এ ধরনের ছিঁচকে চুরি যারা করে তারা নিতান্তই পেটের দায়ে করে থাকে। কিন্তু সমাজে এমন কিছু চোর আছে, যাদের চুরি না করলেও চলে, তবু তারা এ কাজটি করে। অবশ্য তা কারো ঘরে সিঁদ কেটে, বিশেষ কায়দায় তালা খুলে বা জানালার গ্রিল কেটে নয়। চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত থাকলেও সমাজে তারা চোর হিসেবে পরিচিত নয়। ভদ্রলোক বা বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। শুধু পরিচিত নয়, সমাদৃতও বটে। এরা সমাজে সম্মানিত, বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। কেন তারা চোর হিসেবে পরিচিত নন তার কারণও আছে। চোর তো চুরি করে রাতের বেলায় অথবা দিনের বেলায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। আর এরা চুরি করে প্রকাশ্য দিবালোকে এবং সবার চোখের সামনে।
আজকাল এ ধরনের চোর ও চুরির খবর মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে উঠে আসছে। আমরা তাদের চুরি এবং বিশাল সম্পদশালী হয়ে ওঠার কাহিনী পড়ে বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলি। কারা নেই এ চৌর্যবৃত্তিতে? সরকারি কাজের ঠিকাদার, অফিসের ছোট-বড় কর্তারা, আমলা, পুলিশ কেউ বাদ নেই এ কর্মকাÐ থেকে। এমন কি জাতির দেখভাল করার অঙ্গীকার করে ভোট নেন যারা, সে রাজনৈতিক নেতাদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধেই এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ আছে। কখনো তারা নিজেরাই করেন, আবার কখনো তা সম্পন্ন করেন বিশ্বস্ত তল্পিবাহকদের দ্বারা।
সম্প্রতি এ ধরণের বেশ কয়েকটি চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। ওই ঘটনাগুলোতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিশাল বিত্ত- বৈভবের বিবরণ মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনার শত কোটি টাকার সম্পদের খবর এখন সবার জানা। সাকুল্যে ত্রিশ হাজার টাকা বেতনের ওই কর্মচারি কীভাবে এত টাকা-কড়ির মালিক হলো সে রহস্য এখন আর অজানা নেই কারো। যে পন্থায় সে এত সম্পদ গড়েছে তাও এক ধরণের চৌর্যবৃত্তি। আবজালের খবরের পরপরই পাওয়া গেল ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ-ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) রমিজউদ্দিন সরকার ও তার স্ত্রী সালমা পরভীনের অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ থাকার খবর। এর কয়েকদিন পরেই পত্রিকায় প্রকাশিত হলো রাজধানীর মহাখালিস্থ জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের হিসাব রক্ষক জুয়েল, তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নামে শতকোটি টকার সম্পদের বিবরণ। এর কয়েকদিন পরে খবর বেরোলো ক্রিসেন্ট গ্রæপ নামে একটি ব্যবসায়ী গ্রæপের রাষ্ট্রায়ত্ব বানিজ্যিক ব্যাংক জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে ভ‚য়া রপ্তানির কাগজপত্র জমা দিয়ে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খবর। এই সাগরচুরির সাথে ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত এ কথা বলা হয়েছে দুদকের পক্ষ থেকে। উল্লিখিত ঘটনার যারা হোতা তারা কি চট্টগ্রামের তালাভাঙ্গা চোর জাহাঙ্গীরের গোত্রভ‚ক্ত নয়? গত ৩ মার্চের একটি পত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের টোল কালেক্টর রফিকুল ইসলামের ১০ কোটি টাকার জমি থাকার খবর। তিনি আবার সংস্থাটির সিবিএ নেতা। ফলে আলাদিনের চেরাগ হাতে আসতে সময় লাগেনি তার। আরেকটি চমকপ্রদ খবর বেরিয়েছে ২ মার্চের ওই পত্রিকাতেই। তাতে বলা হয়েছে, সরকারি খাদ্যগুদামের ২৮ জন পরিদর্শক (এলএসডি ইন্সপেক্টর) প্রমোশন নিতে চায় না। যাতে তাদের প্রমোশন আটকে যায়, সেজন্য তারা নিজেদের এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) জমা না দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তদবির করেন। কেন তারা প্রমোশন নিতে চান না? কারণ প্রমোশন নিলে তারা যে চেয়ারে বসবেন সেখানে দুর্নীতির সুযোগ কম। ওই পত্রিকাটির আগের দিনের খবরে বলা হয়েছে, নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবে আছে সমবায় অধিদপ্তর। অর্থ লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন সমিতির কর্মকর্তাগণ। এ ধরনের লুটপাট-আত্মসাৎ- দুর্নীতির খবর প্রতিনিয়তই বেরোচ্ছে।
যে প্রবাদটির কথা ওপরে উল্লেখ করেছি তাতে ‘চোর’ শব্দটি প্রতীকি অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে চোর বলতে সব ধরনের দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিতদেরকেই বোঝাানো হয়েছে। এই যে চৌর্যবৃত্তি শুধু জাহাঙ্গীরদের মধ্যেই সীমিত নেই। তা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সর্বত্র। ঠিক যেন মহামারি। গত ৪ মার্চ একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমানের লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়। এই যে লাভের গুড় হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, কারা খাচ্ছে তা? সে পিঁপড়াদের পরিচয় কী? ওই প্রতিবেদনেই তুলে ধরা হয়েছে তাদের পরিচয়। বলা হয়েছে, বিমানের অভ্যন্তরে জেঁকে বসা দুর্নীতিই এই লোকসানের কারণ। আর ওই দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না।
দেশ থেকে দুর্নীতি হটানোর লক্ষে দুদক বেশ কোমর বেঁধেই নেমেছে। মাঝে মধ্যেই দুদক চেয়ারম্যানের হুমকি ধামকির আওয়াজ পাওয়া যায়। কিন্তু দুর্নীতি বন্ধের কোনো আলামত নেই। সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট দুদককে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, যে বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারে না, সে বিড়াল রেখে লাভ কী? আদালত এখানে ইঁদুর ও বিড়াল রূপক অর্থেই ব্যবহার করেছেন। দুর্নীতিবাজরা ইঁদুর আর দুদক বিড়াল। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে দুদকের ব্যর্থতাকেই যে এ মন্তব্যের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অবশ্য কেউ কেউ বলে থাকেন, দুর্নীতির ইঁদুর ধরার সে বিড়াল বাহিনীর মধ্যে ‘কালো বিড়াল’ ঢুকে পড়েছে। ফলে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসছেনা।
গত বছরের ২৪ নভেম্বর সমকালের একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘চোর পালনই পেশা’। তাতে বলা হয়েছিল, হযরত আলী ওরফে রকি নামে এক ব্যক্তির পেশা হচ্ছে চোর পালন। ২০জন সুদক্ষ চোরের একটি দল আছে তার। তার পোষা চোরেরা রাতের বেলায় বিভিন্ন বাড়ির গ্রিল কেটে ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বা স্বর্ণের অলঙ্কারের মতো মূল্যবান জিনিস চুরি করে রকির কাছে দেয়। রকি এ চোরদের থাকা-খাওয়া, ছোট-খাট ঝামলো সামলানো এবং ধরা পড়লে জামিনের ব্যবস্থা করা এবং চোরাই মাল বিক্রির ব্যবস্থা করে থাকে। গত ২০ নভেম্বর মিরপুরের মনিপুর স্কুলের সামনে চোরাই পণ্য বিক্রির সময় সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। রকির চোরের খামারের মতো অনেক খামার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের দেশে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এসব খামারের অস্তিত্ব বোঝা যায় না। কিন্তু চোখ বন্ধ করে যদি একটু দেখার চেষ্টা করি, তাহেলে এর অস্তিত্ব সহজেই বোঝা যাবে। সরকারি আধাসরকারি, স্বায়ত্ত¡শাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে এ ধরনের খামার। এগুলোতে এক বা একাধিক রকি আছে, যাদেরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে তস্কর সিন্ডিকেট।
চোরের দশদিন গেরস্তের একদিন কথাটা আমরা জানি। মাঝে মাঝে এর বাস্তবতাও দেখি। তারপরও এদের দৌরাত্ম্য কমছে না। জাহাঙ্গীররা চুরি করে েেপটের দায়ে, আর আবজাল-রমিজউদ্দিনরা করে লোভে। কারও কারও তো অভ্যাস হয়ে গেছে এ কুকর্মের।
ছোটবেলায় শোনা একটি গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। কোকাচোরা (আসলে হবে খোকাচোরা) নামে এক চোর শেষ বয়সে আর সিঁদ কেটে চুরি করতে পারেনা। এদিকে সন্তানরাও ব্যবসা-বানিজ্য করে ভালোই আছে। তারা পিতাকে বলল-বাবা তুমি চুরি ছেড়ে দাও। মানুষ নানা কথা বলে, আমরা রজ্জা পাই। কোকা চুরি ছেড়ে দিলো। কিন্তু অমাবশ্যার রাত এলেই সে অস্থির হয়ে ওঠে। অবশেষে সে নিজের পুত্রদের ঘরেই সিঁদ কাটতে শুরু করলো। এক ছেলের ঘরের জিনিস আরেক ছেলের ঘরে নিয়ে যায়। গল্পটির মাজেজা হলো অভ্যাস আসলে বদলায় না।
জাহাঙ্গীরের ধরা পড়ার মধ্য দিয়ে যেমন চোরের দশদিন গেরস্তের একদিন প্রবাদের যথার্থতা প্রমাণিত, তেমনি আবজাল-রমিজ-জুয়েলেদের চুরির ঘটনা উদঘাটিত হওয়াও একই কথা বলে। কিন্তু এতে কী ওইসব ভদ্রবেশী তস্করদের বোধোদয় হবে? মনে হয় না। কারণ- চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’ প্রবাদটির উদ্ভবতো এমনি এমনি হয়নি!
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।